আমার নিভৃতচারী বাবা

১ নভেম্বর প্রয়াত হয়েছেন দেশের যশস্বী সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত। ‘গণসাহিত্য’ সাংবাদ সাময়িকী এবং ‘কালি ও কলম’–এর খ্যাতিমান সম্পাদকের মৃত্যুর পর এই প্রথম তাঁকে নিয়ে লিখলেন তাঁর মেয়ে দিঠি হাসনাত। এই লেখায় সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত নন, ধরা আছে কন্যাঅন্তঃপ্রাণ এক বাবার মুখ।

মেয়ে দিঠি হাসনাতের সঙ্গে আবুল হাসনাত।কোলাজ: আমিনুল ইসলাম।

বাবাকে নিয়ে এভাবে লিখতে বসতে হবে, কখনো ভাবিনি। ছয় মাস ধরে বাবা আমাকে অনেকবার বলেছেন, নিউইয়র্কে করোনাকালে তোমার যে অভিজ্ঞত হলো, ‘প্রথম আলো’র জন্য তা লেখো। লিখব লিখব করে আলসেমি করেছি আমি। লকডাউনের সময়টাতে করোনা থেকে সুস্থ হয়ে গান নিয়ে বন্দিদশা ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি। বাবার কথামতো লিখতে বসিনি। তবে সেই বসলাম লিখতে এবং তা বাবাকে নিয়েই, তিনি চলে যাওয়ার পর।

এর আগে অনেক বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে লেখার কথা ভেবেছি মনে মনে, কিন্তু গুছিয়ে উঠতে পারিনি। কারণ, আমার জীবনে বাবার ব্যাপ্তি, আমার বাবা, আবুল হাসনাতের অস্তিত্ব এতটাই ব্যাপক যে কোথা থেকে শুরু করব, বুঝে উঠতে পারিনি। এখনো অথই সাগরে ভাসছি। এত বড় মাপের, কাজপাগল, নিভৃত মানুষটাকে নিয়ে কথা বলার জন্য আমি খুব তুচ্ছ মানুষ। শুধু বলতে পারি তাঁর ভালোবাসার কথা, তাঁর মননের কথা।

শৈশব থেকেই আমার পৃথিবীজুড়ে ছিলেন বাবা আর মা। আমি অনেক সৌভাগ্যবান যে একমাত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও যৌথ পরিবারে আমার দাদুর বাড়িতে আমাদের পুরান ঢাকার যুগীনগরের বাড়িতে বড় হয়েছি অনেক মানুষের মধ্যে—দাদা–দাদু, কাকা–কাকি, ফুফু–ফুফাদের মধ্যে।

দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় আবুল হাসনাত, তাঁর স্ত্রী নাসিমুন আরা হক ও মেয়ে দিঠি হাসনাত
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমার শৈশব কেটেছে সবার মধ্যে হই হই করে, সবার মধ্যমণি হয়ে। কিন্তু এখন যখন নিজের মেয়ে শ্রেয়সীকে বড় করছি, তখন বুঝতে পারছি আমার শৈশবে মা-বাবা কতটা করেছেন আমার জন্য। প্রথমে বাবা আমার জগৎ তৈরি করেছেন। কী বই পড়ব? অনেক ছোটবেলায় আমাকে বই পড়ে শুনিয়েছেন মা ও বাবা। তারপর যখন পড়তে শিখেছি, শুধু বই কিনে দিয়েছেন। আমার জীবনের প্রথম দুটো বই ‘বালিশের সঙ্গে আড়ি’ রুশ সাহিত্য আর ‘ছোটদের রবীন্দ্রনাথ’ হায়াৎ কাকার লেখা। এরপর আমাকে রুশ শিশুসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাবা। মাও অনেক বই কিনে দিয়েছেন।

শৈশবের অনেক সময়ই আমার মা-বাবার সঙ্গে কেটেছে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে ও মহিলা পরিষদে। বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন ‘সংবাদ’ অফিসে। অফিসে নিয়ে গিয়ে আমাকে একটা কাগজ দিতেন ছবি আঁকতে। আমাকে বসিয়ে রেখে তিনি পেজ মেকআপ করতেন, প্রেসের কাজ সারতেন।

অবচেতনে আমি বাবার কাছে কী পেয়েছি, তা অনুধাবন করছি অনুক্ষণ। শৈশব যৌথ পরিবারে হই হই করে কাটলেও বাবা আমাকে নিজস্ব এক জগতের ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার কৈশোরের শুরুতে বাবা–মা তখন ভীষণ ব্যস্ত, তবে ‘সংবাদ’ সাময়িকী, আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়নসহ নানা সাংগঠনিক ব্যস্ততা থাকলেও আমার সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্ব এতটাই বেশি যে কখনো একা লাগেনি। কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পর বাবা আমাকে কোথাও যেতে দিতেন না, চারতলা থেকে দোতলায় দাদুর বাসায়ও যেতে দিতেন না। ‘আমার কাছে থাকবে, আমি অফিস থেকে আসার পরে।’ সব সময় আমাকে এমনভাবে চোখে হারাতেন, আর তাঁকে আমি বলতাম, এমন কেন করো?

আমার অবচেতন মনে প্রাক্-শৈশবেই গান ঢুকে গেছে। তা সে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা দেবব্রতই হোক অথবা উচ্চাঙ্গসংগীতের রথী-মহারথী, ওস্তাদ আমীর খানই হোক না কেন। আমার শৈশবের সকাল কেটেছে ওস্তাদ আমীর খানের ললিত শুনে। সেই বয়সে তা বোঝার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু কৈশোর থেকে উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি আমার যে আকর্ষণ তৈরি হলো, তাতে বাবার ভূমিকা মুখ্য। সংগীতের ওপর বাবার যে পড়াশোনা আর চর্চা ছিল, অনেকেই তা জানেন না। শৈশবে বাবা, কাইয়ুম কাকা (চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী) ও খসরু কাকার (ড. সাইদুর রাহমান) একটা মজার শখ ছিল। ক্যাসেট বা এলপি সংগ্রহের শখ। বাবা কোনো ক্যাসেট কিনলে যদি তা কাইয়ুম কাকা বা খসরু কাকার সংগ্রহে না থাকত, আমি সেটা তাঁদের ক্যাসেট করে দিতাম। আর খসরু কাকা যখন আমার গান শোনার আগ্রহ জানতে পারলেন, তখন কোনো ক্যাসেট কিনলেই তিনি আমার আর বাবার জন্য আরেক কপি কিনে খেলারাম ভাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। আবার মা-বাবার সঙ্গে প্রতি মাসে ‘গানের ডালি’তে ক্যাসেট কিনতে যেতাম আমি। শেষে রেকর্ড ঘেঁটে ঘেঁটে ক্যাসেট করা আর গান শোনা আমার নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ক্যাসেট কিনতাম দেখে বাবা বলেন, ‘তুমি টিফিন ঠিকমতো খাও, মা। আমি তোমাকে ক্যাসেট কিনে দেব।’

এভাবে বাবা আমার সংগীতের রুচি তৈরি করেছেন, কান তৈরি করেছেন। আমার অবচেতন মন কেমন করে রাগ-রাগিণীর সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, নিজেই বলতে পারব না। শুধু রবীন্দ্রনাথকে বোঝা এবং তাঁর বিষয়ে পড়াশোনাটা বাবার মতো আমারও একটা প্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নতনি শ্রেয়সীর সঙ্গে আবুল হাসনাত।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মনে আছে, যখন উদয়ন স্কুলে পড়ি, অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার আগে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসসমগ্র পড়েছি। একেকটা বই পড়ে তা নিয়ে মা–বাবার সঙ্গে আলোচনা করা ছিল আমার একটা প্রিয় বিষয়। আর বই পড়ার ব্যাপারেও বাবা ছিলেন ভীষণ উদার, কখনো বলেননি যে এই বই পড়ো, ওই বই পোড়ো না, এই গান শোনো, ওই গান শুনো না। তিনি চেয়েছেন, আমি নিজে যেন খুঁজে নিই কোনটা গ্রহণ করব, আর কোনটা করব না।

জীবদ্দশায় কখনো তিনি কোনো সুবিধা নেননি—না আমাদের জন্য, না চাকরির জন্য। কখনো নীতির বাইরে যাননি। আমাকে শিখিয়েছেন কখনো চাকরির ইন্টারভিউতে টাকাপয়সা নিয়ে যেন কথা না বলি। তাঁকে বলতাম, বাবা, এই নীতি এখনকার সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। তবু তিনি বলতেন, এই রকমই বিনয়ী হতে হবে, একসময় না একসময় মানুষ বুঝতে পারবে। বাবা আমাকে শিখিয়েছেন, কীভাবে ভাবতে হবে, চলতে হবে। কেউ অন্যায় করলে নীরবে-নিভৃতে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন বাবা। একবার ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকার জন্য লিখলাম ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। বাবার সে কী খুশি, আমি যে লিখতে চেষ্টা করছি সে জন্য। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ও উপন্যাসসমগ্র আমার পড়া, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আনুষঙ্গিক বইগুলো বাবা খুঁজে বের করে দিতেন আমাকে, যেন পাশাপাশি সেগুলো পড়তে পারি। বিভূতি রচনাবলি, মানিক রচনাবলি পড়তে উৎসাহিত করেছেন। কৈশোরে তিনি আমাকে শঙ্খ ঘোষের লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ‘সকাল বেলার আলো’ বইয়ের মাধ্যমে। বইটি আমি অনেকবার পড়েছি। আর ওই একই সময়ে বাবার লেখা কিশোর সাহিত্যগুলোও পড়ছি—‘ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়’, ‘টুকু ও সমুদ্রের গল্প’ ইত্যাদি। এভাবে বাংলা সাহিত্যের নানা লেখকের জগতে যখন ডুবে গেছি, কৈশোরের একাকিত্ব যে কখন ভুলে গেছি, বুঝতে পারিনি। সেই সঙ্গে একটু একটু করে ডুবে গেছি গানের জগতে। ছায়ানটে ভর্তি হয়েছি পঞ্চম শ্রেণি পড়া অবস্থায়। সংগীতশিক্ষার জন্য বাবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাকে জড়িত করতে চাননি। কিন্তু অনেকটা মা আর আমার আগ্রহেই ফরম কিনে নিয়ে আসেন। আমি ভর্তি হই। আমাকে তাঁরা নিয়ে যেতেন ইউল্যাব স্কুলে, তৎকালীন ছায়ানটে। আমাকে ক্লাসে দিয়ে বাবা বা মা ছায়ানটের অফিসে একটা বই নিয়ে পড়তেন। ছায়ানটে সংগীতশিক্ষার সময়েও আমাকে বোঝাতেন যে কারোর চিন্তার দ্বারা যেন আমরা প্রভাবিত না হই। ভালো গান গাইতে গেলে সব রকম গান শুনতে হবে, পক্ষপাতদুষ্ট হলে চলবে না। রবীন্দ্রসংগীত শুধু সংগীত নয়, এটা একটা দর্শন, জীবনবোধ। এসব বুঝতে গেলে সংকীর্ণ হওয়া চলবে না। রবীন্দ্রসংগীত, উচ্চাঙ্গসংগীত, লোকসংগীত, নজরুলসংগীত—সব বিষয়েই জানার ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। কোন শিল্পীর গান শুনবে, কাকে গ্রহণ করবে, কাকে বর্জন করবে, তা নিজেই বিচার করতে শেখো। কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো ব্যক্তি যেন তোমাকে প্রভাবিত করতে না পারে—বাবা এগুলো শিখিয়েছেন আমাকে। তাঁর সংগ্রহের উচ্চাঙ্গসংগীত শুনতে শুনতে, রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতে বাসতে, সেই কৈশোরেই উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি আমি। রাগ-রাগিণীর বিশাল জগৎ সম্মোহন করতে থাকে আমাকে।

জীবদ্দশায় কখনো তিনি কোনো সুবিধা নেননি—না আমাদের জন্য, না চাকরির জন্য। কখনো নীতির বাইরে যাননি। আমাকে শিখিয়েছেন কখনো চাকরির ইন্টারভিউতে টাকাপয়সা নিয়ে যেন কথা না বলি। তাঁকে বলতাম, বাবা, এই নীতি এখনকার সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। তবু তিনি বলতেন, এই রকমই বিনয়ী হতে হবে, একসময় না একসময় মানুষ বুঝতে পারবে। বাবা আমাকে শিখিয়েছেন, কীভাবে ভাবতে হবে, চলতে হবে। কেউ অন্যায় করলে নীরবে-নিভৃতে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন বাবা।

বলা বাহুল্য, এই জগতের সঙ্গেও বাবা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন। রবিশঙ্করের শুদ্ধ কল্যাণের এই ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রয়েছে। প্রথমে আমি অনেক বেশি সেতার ও সরোদ শুনতে থাকি মা-বাবার সঙ্গে। ওস্তাদ আমজাদ আলী খান, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর প্রমুখ দিয়ে আমার প্রবেশ শুরু হয় এই জগতে। এরপর বাজনা থেকে ভোকাল শুনতে শুরু করি পণ্ডিত ভীমসেন যোশী, বিদুষী কিশোরী আমেনকর, বিদুষী গিরীজা দেবী, ওস্তাদ রশিদ খান। পুরোনোদের মধ্যে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ আমীর খান, বড়ে গোলাম আলী শোনা শুরু করি বাবার সংগ্রহের রেকর্ড থেকে।

শৈশব থেকেই ঢাকায় যত রবীন্দ্রসংগীত, উচ্চাঙ্গসংগীত আর চিত্র প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান হতো, মা–বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন সেখানে। এমনকি তাঁদের বন্ধুদের আড্ডায়ও আমি সব সময় তাঁদের সঙ্গে গিয়েছি। তাঁদের, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতির আড্ডায় আমি বড় হয়েছি। বাবা এইভাবে একটু একটু করে তৈরি করে দিয়ে গেছেন আমার মনোজগৎ।

নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর যখন আমি উচ্চাঙ্গসংগীত শিখতে দিল্লিতে শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভাবছি, বাবা মন খারাপ করেছেন, আমাকে ছেড়ে তিনি থাকতে চাননি। কিন্তু যখন গিয়ে বলেছি তাঁকে, ‘তুমি চেয়েছ আমি মাস্টার্স করি, করেছি। শুধু আমাকে কিছুদিন সব ভুলে গান শিখতে দাও।’ তখন তিনি আর না করেননি। মাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে দিল্লির হোস্টেলে রেখে এসেছেন। নিজের অনেক কষ্ট হলেও গান শিখতে উৎসাহিত করেছেন আমাকে। চিঠি লিখে আমাকে বলেছেন, গান শেখার পাশাপাশি দিল্লির চিত্রকলা প্রদর্শনী, থিয়েটার, উচ্চাঙ্গসংগীতের সব অনুষ্ঠান দেখার চেষ্টা করবে।

আমাদের শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্রের পাশেই ছিল সংগীত নাটক একাডেমি, ললিতকলা কেন্দ্র, উল্টো দিকে দূরদর্শন ভবন, কাছেই ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা ও ত্রিবেণী কলা কেন্দ্র। আর শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্রের মিলনায়তনে রোজই তো অসাধারণ কিছু না কিছু হচ্ছে। একদিন গিরীজা দেবী গান গাইছেন তো আরেক দিন লীলা স্যামসনের নাচ দেখছি, আবার হয়তো পরের দিনই ললিতকলা কেন্দ্রে যতীন দাসের চিত্র প্রদর্শনী। এসব দেখতাম আর প্রায় প্রতিদিনই বাবাকে বলতাম, ‘আজকে যতীন দাসের প্রদর্শনী দেখলাম; সেদিন শাবানা আজমি–জাভেদ আখতার এসেছিলেন কাইফি আজমির জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর জীবন নিয়ে নাটক করতে; কদিন আগে আমাদের মিলনায়তনে ফরিদা খানম শুনবার সুযোগ হলো।’ সব শুনে বাবা আমাকে বলতেন, ‘যা দেখছ, সব লিখে রাখো। যতটা পারো গান শেখার পাশাপাশি দেখতে থাকো।’ রেওয়াজের ক্লাসের জন্য ততটা সময় পেতাম না, কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি বাবার কথা রাখতে। কত কিছু শুনেছি, দেখেছি ওই দুই বছরে!

দিল্লিতে ওই দুই বছরের অভিজ্ঞতা আমাকে ভীষণভাবে ঋদ্ধ করেছে, যা পরবর্তী সময়ে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে, একাত্তর টিভিতে সংস্কৃতি ও বিনোদনবিষয়ক প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে বিস্তর সহায়তা করেছে আমাকে। আবার বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সময় বিভিন্ন শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি এবং সেগুলো যখন ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত হয়েছে, দারুণ খুশি হয়েছেন বাবা। ওই লেখাগুলো নিয়ে বারবার বই করার জন্য তাগাদা দিয়েছেন আমাকে—আলসেমি করে আমি দেরি করেছি। এখন মনে হয়, আলসেমি না করে বইটা করলে বাবা হয়তো সেটা দেখে যেতে পারতেন।

নিউইয়র্ক বইমেলায় আবুল হাসনাত ও দিঠি হাসনাত
ছবি: মুনিরা মোরশেদ মুন্নী

ধীরে ধীরে চিত্রকলা ভালোবাসতে শিখলাম। মনে আছে, বাবা চিত্র প্রদর্শনীতে নিয়ে আমাকে ছেড়ে দিতেন, আমি বুঝি না বুঝি, ঘুরে ঘুরে দেখতাম। আর বিমূর্ত চিত্রকলা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, ‘নিজে বোঝার চেষ্টা করো। আমি বলে দিলে তোমার ভাবনায় বিঘ্ন ঘটবে।’ অবার আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন তিনি শফিউদ্দীন আহমেদের ওপর একটা বই লিখছিলেন। চিত্রকলাসংক্রান্ত বইপত্র মূলত তখনই পড়া শুরু হয় আমার। মৃণাল ঘোষের বই, সালভাদর দালির ডায়েরি, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ওপর বই, ভিনসেন্টকে লেখা থিওর চিঠি—এগুলো বাবার সঙ্গে পড়তে থাকি আমি। শফিউদ্দীন স্যারের বইটার কাজ বাবা খুব যত্নসহকারে করেছেন। শফিউদ্দীন আহমেদ আর বাবা দুজনেই ছিলেন একধরনের মানুষ—নিভৃতচারী ও খুঁতখুঁতে। বাবা প্রায়ই টিকাটুলীতে শফিউদ্দীন স্যারের বাসায় যেতেন, আর তিনি বাবাকে যে গল্পগুলো করতেন এবং তাঁর আঁকা ছবি দেখে এসে বাবা লিখতেন—পুরো পাঁচ বছর আমি বাবার এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। এখন বুঝতে পরি, সেই সময়ই আমার ভেতর চিত্রসমালোচনা পড়ার ভিত্তিটা স্থাপন করে দিয়েছিলেন বাবা। চিত্রকলা বিষয়টা কত ব্যাপক এবং শিল্পকলার প্রতিটা বিষয় যে একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তখন সেটা আমি বুঝতে শিখেছি। চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, কবিতা ও উচ্চাঙ্গসংগীত একে অপরের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে আছে, বাবার হাত ধরেই সেটা আমি বুঝতে শিখেছি। তাঁর খুব প্রিয় বিষয় ছিল নন্দনতত্ত্ব। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে সেই নন্দনবোধের চর্চাই তিনি করে গেছেন। আর বাবার দেওয়া এই সব জ্ঞান আগেই বলেছি, পরবর্তীকালে আমাকে সংস্কৃতিবিষয়ক সাংবাদিকতায় ভীষণভাবে সাহায্য করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে এসে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্সে, মিডিয়া অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ ক্লাসে এই একই শিক্ষা আবারও দারুণভাবে সহায়তা করেছে আমাকে—বাবাকে সে কথা জানাতেই ভীষণ খুশি হয়েছেন তিনি।

নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর যখন আমি উচ্চাঙ্গসংগীত শিখতে দিল্লিতে শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভাবছি, বাবা মন খারাপ করেছেন, আমাকে ছেড়ে তিনি থাকতে চাননি। কিন্তু যখন গিয়ে বলেছি তাঁকে, ‘তুমি চেয়েছ আমি মাস্টার্স করি, করেছি। শুধু আমাকে কিছুদিন সব ভুলে গান শিখতে দাও।’ তখন তিনি আর না করেননি। মাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে দিল্লির হোস্টেলে রেখে এসেছেন। নিজের অনেক কষ্ট হলেও গান শিখতে উৎসাহিত করেছেন আমাকে। চিঠি লিখে আমাকে বলেছেন, গান শেখার পাশাপাশি দিল্লির চিত্রকলা প্রদর্শনী, থিয়েটার, উচ্চাঙ্গসংগীতের সব অনুষ্ঠান দেখার চেষ্টা করবে।

নির্যাতনকারী সঙ্গীর সঙ্গে দুর্বিষহ বিবাহিত জীবন থেকে বের হয়ে আমি যে আবার গান আর পড়াশোনা শুরু করতে পেরেছি, তা সম্ভব হয়েছে মা-বাবা আর আমার মেয়ে শ্রেয়সীর জন্য। শ্রীমতী শান্তি শর্মা ও সোনিয়া রায়ের কাছে ইন্দোর ঘরানায় তালিমের সুযোগ পাওয়ার পরও যখন দুর্বিষহ বিবাহিত জীবনের যন্ত্রণায় গান, বাবার দেওয়া শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা জীবন থেকে চলে গিয়েছিল, তখন বাবা ছিলেন আমার প্রধান আশ্রয়। তাঁর নিবিড় আশ্রয়–প্রশ্রয়েই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে প্রবাসে সংগ্রাম করেছি। শিক্ষকতা করে, স্বাভাবিক শান্তির জীবনে গান ও পড়াশোনায় আবার ফিরতে পেরেছি। তাই হয়তো একটুখানি প্রশান্তিও তাঁকে দিতে পেরেছিলাম।

বাবাকে নিয়ে কত যে স্মৃতি আমার! যখন গান করেছি, শিখিয়েছেন কীভাবে নীরবে সাধনা করতে হয়। বলেছেন, সাধনাটাই তোমাকে সঠিক পথ চিনতে শেখাবে।

আমার অনেক বড় সৌভাগ্য যে আমি এমন মা-বাবার সন্তান। আমার জীবনে তাঁরাই প্রথম গুরু। বাবা আবুল হাসনাত আমার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন—আমার চিন্তায়, সাধনায়, মননে জড়িয়ে আছেন নিভৃতে। যত দিন নিশ্বাস থাকবে, বাবার জন্য গেয়ে যাব—

‘নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা
ভক্ত সেখায় খোল দ্বার আজ লব তার দেখা।’
আমি তাঁর দেখা পেয়েছি, যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে, লোভ-লালসা মোহ, প্রাতিষ্ঠানিক পদ—সবকিছুর ঊর্ধ্বে। বাবার মতো হতে পারাই এখন আমার জীবনের একমাত্র ব্রত।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]