‘আমি বল দিয়েই মানুষকে আনন্দিত করতে পারি, এটাই আমার গর্বের সর্বোচ্চ চূড়া’

কিংবদন্তি ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনা গতকাল ২৫ নভেম্বর আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য দুনিয়ায়। ওই দিনই ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম গেট ফুটবল নিউজ প্রকাশ করেছে তাঁর এই সাক্ষাৎকার। এখানে ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে ফুটবলজীবনের বিভিন্ন ঘটনা এবং ফুটবলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। গত ৩০ অক্টোবর ছিল এই কিংবদন্তি ফুটবলারের জন্মদিন। ওই জন্মদিনের আগমুহূর্তে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয় এবং এটিকে ম্যারাডোনার সর্বশেষ বড় সাক্ষাৎকার বলে দাবি করেছে সংবাদমাধ্যমটি। সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন হুমায়ূন শফিক

প্রশ্ন:

আত্মজীবনী, ‌‌‘অ্যাই অ্যাম ডিয়েগো অব দ্য পিপল’ বইয়ে আপনি বলেছেন, ‘তারা আমাকে ভিয়া ফিওরিতো (আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসের একটি মহল্লা) থেকে বের করে দিয়েছে এবং তারা আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে...আমি যা করতে পেরেছি, তা–ই করেছি, আসলে তেমন খারাপভাবেও করিনি বোধ হয়।’

ম্যারাডোনা: পুরো ক্যারিয়ারেই এই ব্যথা আমি বহন করেছি। ক্যারিয়ারে আমি কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছি। যখন আমি সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিলাম, তখনো কিছু ঝামেলায় পড়েছিলাম। কিছু লোক আমার পরিবারের পেছনে লেগেছিল। তারা আমার ভাইবোন, এমনকি বেনজার (ম্যারাডোনার দ্বিতীয় মেয়ের সন্তান হলো বেনজা) পেছনেও লেগেছিল। আমাকে কোনো উপহার দেওয়া হয়নি...তবে সর্বোপরি, যখন আমি সব যুদ্ধ এবং এই পৃথিবীতে খুব কম বয়সে মারা যাওয়া সব শিশু সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন নিজেকে বলি, আমি ভাগ্যবান।

প্রশ্ন:

আর্জেন্টিনায় আবার ফিরে আসা আপনার জন্য কি কোনো নতুন অর্থ বহন করে, ব্যাপারটা কি এমন যে নিজের শিকড়কে নতুন করে আবিষ্কার করা? মানে বহুদিনই তো আপনি নিজ দেশের বাইরে ছিলেন, সে জন্যই এ প্রশ্ন?

ম্যারাডোনা: ২০১০ সালের বিশ্বকাপে টিমটিকে পরিচালনা করার পর (আর্জেন্টিনা তখন কোয়ার্টার ফাইনালে ৪–০ গোলে জার্মানির কাছে পরাজিত হয়েছিল) আমার নিজের পেশাকে ধরে রাখার জন্য চলে যেতে হয়েছিল অন্য দেশে, কারণ, হুলিও গ্রন্দোনা (আর্জেন্টিনা এফএ এর প্রেসিডেন্ট) চাননি আমি সেখানে থাকি। বেশ কয়েক বছরই বাইরে থেকে এলাম আমি (মূলত মেক্সিকো ও ইউনাইটেড আরব আমিরাতে ছিলেন)। অবশ্য মহামারির জন্য মেক্সিকোর পরিবেশ সুবিধার ছিল না। এটা সব লাতিন আমেরিকানদের জন্য বাস্তব সত্য।

প্রশ্ন:

ষাট বছর উদযাপন করতে যাচ্ছেন আপনি। এই সময়ে কি ১৯৭৬-৮১ সালের কথা—যখন আর্জেন্টিনার জুনিয়র দলে প্রথম পদক্ষেপ দেন এবং ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালের বোকা জুনিয়রসে খেলেন—সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে?

ম্যারাডোনা: যখন আমি খেলা শুরু করেছি এবং খেলার মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত যা অর্জন করতে পেরেছি, তা নিয়ে নিজেকে আমি খুবই সন্তুষ্ট মনে করি। আমার মনে হয়, মানুষকে আমি আনন্দ দিয়েছি। বিস্ময়ে অভিভূত করেছি। তারা যখন আমাকে দেখতে স্টেডিয়ামে আসে বা টেলিভিশনের পর্দায় আমাকে দেখে আনন্দিত হয়, তখন খুবই ভালো লাগে। বল দিয়ে মানুষকে আনন্দিত করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। এটাই আমার গর্বের সর্বোচ্চ চূড়া।

প্রশ্ন:

এরপর ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালে যখন বার্সেলোনার সঙ্গে; এরপর ১৯৮৪ ও ১৯৯১ সালে নাপোলির সঙ্গে ছিলেন, আপনার সেই সব অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল ভালো কিছু স্মৃতি। তবে সবচেয়ে জঘন্য স্মৃতি হলো আহত হওয়া এবং আপনার বাড়াবাড়ি...

ম্যারাডোনা: ফুটবল খেলার সেরা আইডিয়া নিয়ে আমি ইউরোপে গিয়েছিলাম নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য। সেই সময়ে একজন দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলারের জন্য সেখানে খেলাটা খুব একটা সহজ ছিল না। আমি একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম। তারপর বহুদূরে চলে গেলাম এবং সেখানেই সবকিছু গড়তে চেষ্টা করলাম। যেমনটা আমি করতে চাই আরকি।

প্রশ্ন:

১৯৮৯ সালে আপনি মার্শেইয়ে প্রায় চলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গেলেন না। সেই গল্পটা বলুন…

ম্যারাডোনা: হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবকিছুই বেশ ভালোমতোই মনে আছে। মার্শেইয়ের বোর্ড থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছিল, আমার বেতন দ্বিগুণ করে দেবে। আমি তখন নাপোলিতে খেলতাম। সেখানকার প্রেসিডেন্ট আমাকে বলল, আমরা যদি ইউরোপিয়ান কাপ জিততে পারি, তাহলে সে আমাকে ছাড়বে। তারপর মার্শেইয়ের প্রেসিডেন্ট ও মাইকেল হিদালগো ইতালিতে এলে আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং বলেন, যদি আমি নাপোলিতে ফিরে যাই...(মিটিং হয়েছিল মিলানে), আমি তখন বললাম, ‘ধন্যবাদ, প্রেসিডেন্ট। সুন্দর একটা বছর উপহার দেওয়ার জন্য। আমি চললাম।’ সেই সময়ে তারা খুবই বাজে খেলছিল, এমন যে তারা কিছুই বুঝতে পারছিল না। আপনি কি সেখানে যেতে চাইতেন। গল্প শেষ।

যখন আমি খেলা শুরু করেছি এবং খেলার মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত যা অর্জন করতে পেরেছি, তা নিয়ে নিজেকে আমি খুবই সন্তুষ্ট মনে করি। আমার মনে হয়, মানুষকে আমি আনন্দ দিয়েছি। বিস্ময়ে অভিভূত করেছি। তারা যখন আমাকে দেখতে স্টেডিয়ামে আসে বা টেলিভিশনের পর্দায় আমাকে দেখে আনন্দিত হয়, তখন খুবই ভালো লাগে। বল দিয়ে মানুষকে আনন্দিত করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। এটাই আমার গর্বের সর্বোচ্চ চূড়া।
বিশ্বকাপ হাতে ম্যারাডোনা,১৯৮৬
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

ষাট বছর উপলক্ষে আপনার কোনো আকাঙ্ক্ষা আছে?

ম্যারাডোনা: অবশ্যই। আমি বিট্রিশদের বিরুদ্ধে আরেকটা গোল করতে চাই; আর সেটা অবশ্যই আমার ডান হাত দিয়ে (বলেই হাসিতে ফেটে পড়েন)।

প্রশ্ন:

১৯৯৫ সালের আগে কোনো নন-ইউরোপিয়ান ফুটবলার ব্যালন ডি’অরের জন্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স আপনাকে ব্যালন ডি’অর এনে দেওয়ার সুযোগ দেয়। এটা কি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ?

ম্যারাডোনা: অবশ্যই! অবশ্যই! আমাদের আগে দক্ষিণ আমেরিকান অন্য কেউ তো এটা পাওয়ার সুযোগই পায়নি। অন্যথায় এটা আমি পেয়েছি। এটা অবশ্যই সম্মানের। আমাকে আরও জিততে হবে—তখন এই চিন্তাটা ছিল। ফ্রান্স ফুটবল আমাকে বিভিন্নভাবেই অনেক কিছু দিয়েছে, যা আদতেই অসাধারণ।

প্রশ্ন:

কোন কোন ফুটবলার এখন আপনাকে স্বপ্ন দেখায়?

ম্যারাডোনা: মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো (রোনালদো), ক্রিস্টিয়ানো ও মেসি...এই দুজন অন্য সবার চেয়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের মতো আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আর কোনো প্লেয়ার এখনো তাঁদের অর্ধেকও করতে পারেননি।

প্রশ্ন:

কিলিয়ান এমবাপ্পে, আপনি তাঁকে কোথায় রাখবেন?

ম্যারাডোনা: তিনি একজন দুর্দান্ত খেলোয়াড়, তবে তিনি এখনো অপরিপক্ব! তাঁকে আরও বেশি ম্যাচ খেলতে হবে। তাঁকে প্রচুর প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে এবং ধীরে ধীরে বাড়তে হবে। তাঁর রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের (ডিফেন্ডার) দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যাঁরা তাঁর গোড়ালিতে আঘাত করতে পারে। আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি…(এমবাপ্পে বার্সেলোনার হয়ে খেলছেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পায়ের গোড়ালি ভেঙে তিনি আহত হয়েছিলেন) তবে আমাকে স্বীকার করতে হবে যে তিনি সত্যিই অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে বল স্পর্শ করার এক অনন্য উপায় জানেন।

তারুণ্যে ফুটবল অনুশীলনে ম্যারাডোনা
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

আপনার যদি ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় বাছাই করতে হয়, তবে কাকে নির্বাচন করবেন?

ম্যারাডোনা: প্রথমত, অনেক দর্শনীয় খেলোয়াড় আছেন, যাঁদের আমি দেখার সুযোগ পাইনি। আর্জেন্টিনায় এক অবিশ্বাস্য গোলরক্ষক ছিলেন, যাঁর কথা সবার আগে বলতে চাই, আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের ক্যারিজো (১৯৪৫–৬৮ সালের মধ্যে রিভার প্লেটের গোলরক্ষক, যিনি ১৯৫৮ সালের সুইডেনে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক ছিলেন)। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর খেলা দেখতে সক্ষম হইনি, তবে প্রত্যেকেই তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

আরও ছিলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওর, যিনি আমার ক্যারিয়ার শুরুর ঠিক আগে খেলেছিলেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমি মাঠ ভাগাভাগি করতে পারিনি। এরপর যখন আমি আর্জেন্টিনা লিগ শুরু করি, আমি প্যাটো (উবালদো) ফিলল (১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার সঙ্গে বিশ্বকাপজয়ী) এবং ‘এল মার্সিকাল’ রবার্তো পারফিমো (১৯৭৫–৭৮ সালের মধ্যে রিভার প্লেট ডিফেন্ডার), আলবার্তো তারান্টিনি (১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের বিজয়ী, যিনি বাস্টিয়া ও টলুউজের হয়ে খেলেছিলেন)।

এ খেলোয়াড়দের আজ পুরো বিশ্ব ভুলে গেছে। যদি আমাকে মিডফিল্ডার বাছাই করতে হয়, তবে আমি জাভি ও লুকা মাদারিচকে বেছে নেব। তারপর মেসি আর ক্রিস্টিয়ানোকে নেব কোনো সন্দেহ ছাড়াই।

প্রশ্ন:

জিনেদিন জিদান, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, ডেভিড ট্রেজেগুয়েট, কিলিয়ান এমবাপ্পে—প্রত্যেকে আপনার সম্পর্কে কিংবদন্তি হিসেবে কথা বলেছেন ও মেনেছেন। তাঁদের চোখের তারা হয়ে রয়েছেন আপনি। এই প্রতিক্রিয়াগুলো কি এখনো আপনাকে স্পর্শ করে?

ম্যারাডোনা: আমি এমন দুর্দান্ত খেলোয়াড়দের দ্বারা খুব সম্মানিত, যাঁরা আমার সম্পর্কে এমনভাবে প্রেম নিয়ে কথা বলে। আমার ক্যারিয়ার সম্পর্কে যাঁরা কথা বলেছেন, এসব খেলোয়াড়ের সঙ্গে আমার দুর্দান্ত সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের মধ্যে একটি বিশাল পারস্পরিক শ্রদ্ধা বিদ্যমান এবং আমার ৬০তম জন্মদিনের প্রাক্কালে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরে আমার সত্যিকারের আনন্দ হচ্ছে।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]