আর বাজিবে না শঙ্খধ্বনি

৮ বোশেখের (১৪২৮) গগন গনগনে হয়ে ওঠার আগে এ সংবাদ রটে গিয়েছিল দিকে দিকে—শঙ্খ ঘোষ আর নেই। অজস্র কথা বলার মানুষ ছিলেন না তিনি, কখনো তাঁর কণ্ঠ নিনাদিত ছিল না। মৃত্যু নিয়ে রামমোহনের সেই অবিনাশী উচ্চারণ মনে পড়ে। সবাই আজ শঙ্খকে নিয়ে কত কথা বলাবলি করছি, চালাচালি করছি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা-দিল্লি–লন্ডন–নিউইয়র্ক-টরন্টো-মেলবোন—আজ সব এক সূত্রে বাঁধা হয়ে গেছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সৌজন্যে। আর তিনি নীরব। ফেসবুকের পর্দায় তাঁর সঙ্গে তোলা ছবি কত মানুষের, তাঁর হস্তাক্ষর–স্বাক্ষর—এত সব অমূল্য সংগ্রহ রয়েছে কতজনের কাছে। তাই সুনির্দিষ্টভাবে বলাই যায়, শঙ্খ ঘোষ ছিলেন আমাদেরই লোক। এত কথা, এত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় যে এই মৃদুবাক মানুষটি আমাদের ‘হে বন্ধু হে প্রিয়’ হয়ে উঠেছিলেন।

শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে এপার বাংলার লোকজনের আলাদা রকমের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং প্রকৃতপক্ষে অধিকারবোধ ক্রিয়াশীল। তাঁর বাবা পাকশীর এক উচ্চবিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক ছিলেন। আমার বিচারে শঙ্খ ঘোষই অদ্যাবধি শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। হঠাৎ এ কথা বলছি এ কারণেই যে রবীন্দ্রসাহিত্যের মতো শঙ্খ ঘোষের কাব্যশরীরের ধমনিতে সর্বদাই প্রবাহিত ছিল বাংলাদেশের রক্তস্রোত। এ কথা তিনি নিজেই বলেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রচর্চা নিয়ে শঙ্খ ঘোষের আমৃত্যু অনুরাগ তাঁকে এ দেশের পরম প্রিয় নিকটজন করে তুলেছে।

২১ এপ্রিল মারা গেলেন সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও লেখক শঙ্খ ঘোষ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

বাংলা একাডেমির ডাকে তিনি সাড়া দিয়েছেন, ছায়ানটের শিক্ষার্থীদের সমাপনী সনদ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। ২০১১ সালে সুরের ধারার রবীন্দ্র সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর বিপুলায়তন অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন পুরো চার দিন ধরে। সবচেয়ে কাছাকাছি, সবচেয়ে বেশি সময় তাঁর সান্নিধ্যের সংবেদী উত্তাপ উপভোগ করেছি তখন। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল গেল শতকের ষাটের দশকের শেষভাগে কলকাতার একাডেমির থিয়েটার হলে। তেমন কথা হয়নি। কবি হিসেবে তাঁর আলাদা সৌরভ কলকাতার মানুষ তখন শনাক্ত করতে শুরু করেছেন।

১৯৮৬ সালের কথা। তখন আমি ‘শেক্​সপিয়ার ও বাংলাদেশ’ নিয়ে একটা গবেষণায় মগ্ন। রবীন্দ্রনাথ কোথায় কোথায় শেক্​সপিয়ারের উল্লেখ করেছেন, সে বিষয়ে যেসব তথ্য পেয়েছি, তা উল্লেখ করে আর কী পেতে পারি, সেই স্বার্থান্বেষায় শঙ্খদাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। প্রায় মাস দেড়েক পর দীর্ঘ চার পৃষ্ঠার উত্তর এসেছিল। পেয়েছিলাম নতুন রসদ। এ আমির আবরণ বইটা দিয়েছিলেন, সে কত বছর আগে মনে নেই, তার চেয়ে ষোল বছরের অনুজকে ‘প্রীতিভাজন’ সম্বোধনে। তাঁর বিধাননগরের আবাসে প্রতি রোববার সাহিত্যিক-সামাজিক আড্ডা বসত। সেখানে আমি প্রথম যাই সহপাঠী-বন্ধু স্বপন মজুমদারের সঙ্গে। আহা! স্বপনদাও হারিয়ে গেছেন কয়েক মাস আগে।

শঙ্খ ঘোষের কবিতা আমাদের টানে। তাঁর কবিতার স্বাদ একেবারে ভিন্নধর্মী। দুর্বোধ্যতা বা রূপক প্রতীকের চমকরহিত। ইশারার চেয়ে সহজিয়া বার্তা শোনা যায় বেশি। জানু পেতে বসেছিলেন কিংবদন্তি সম্রাট। প্রার্থনা জানাচ্ছেন, ‘যদি চাও ধ্বংস করে দাও আমাকে, আমার সন্তান যেন বেঁচে থাকে তার বিনিময়ে।’ নিজের অতীতের কোনো দুঃস্মৃতি তাড়িত করেছিল তাঁকে, কিন্তু সযৌবন তেজোময় ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি ছিল ‘বাবরের প্রার্থনা’য়। এটাই মনে হয়, শঙ্খ ঘোষের সবচেয়ে পঠিত কবিতা, যেটি লিখেছিলেন সত্তর দশকের মধ্যভাগে। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’—অজটিল, কিন্তু তীক্ষ্মবাক এই কবিতা হয়ে উঠেছে কবি শঙ্খ ঘোষের অনন্যতার অমর বিজ্ঞাপন। গভীর ও অনলসভাবে সমাজসচেতন ছিলেন তিনি। কিন্তু উত্তেজনা বা প্রত্যাখ্যানে তীব্রভাষী ছিলেন না। শিল্পের সীমানা আর কেই-বা বেশি বোঝেন তাঁর চেয়ে? ‘এখন আর আমাদের কোনো অশান্তি নেই/ কেননা আমরা দল বদল করেছি...আমরা এখন হয়ে গেছি ওরা/ আর কোনো অশান্তি রইল না আমাদের/ দেখো কেমন চমৎকার কেটে যাচ্ছে/ আমাদের কৃমিকীট জীবন।’ দুই বাংলার সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক চালচিত্রে এর চেয়ে প্রামাণ্য, কষ্টকর শোণিত ক্ষরণের নথি অন্য কোথাও কি পাওয়া যাবে?

কবি শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে ফেসবুকে স্মৃতির মাতম দেখেছি। কিন্তু যে শঙ্খ ঘোষের কাছে আমি আজীবন নতজানু, তিনি রবীন্দ্রমগ্ন, রবীন্দ্র–অন্বেষায় এক অক্লান্ত পরিব্রাজক। রবীন্দ্রগানের জন্য ভালোবাসা তৈরি হয়েছে অনেক বড় শিল্পীর হৃদয়ছোঁয়া পরিবেশনায়, কিন্তু সেসবের অন্দরমহলে প্রবেশদ্বারের চাবিটা পেয়েছি শঙ্খ ঘোষের লেখা থেকে। আরও কয়েকজনের নামও উল্লেখ করা যায়। দুঃখের পাঠ নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ যে ‘তারে’ ভয় না করার কথা বলছেন, আবার দুই পঙ্​ক্তির পর চন্দ্রবিন্দুসহযোগে ‘তাঁরে’ লিখে যে ভিন্ন দ্যোতনা আনছেন, গানটা শুনে তা ঠিক বুঝিনি, শঙ্খ ঘোষ পড়ে তা অনুধ্যান করেছি। শঙ্খদার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আলাপন হয়েছে রবীন্দ্রের নাটক নিয়ে, ১৯৭৫ সালের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক, যেখানে রবীন্দ্রনাথের নাটকের দৃশ্যসজ্জার প্রকৃতি ও ‘পথ’-এর অর্থবহতা নিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। ছাত্রাবস্থা থেকে অদ্যাবধি নাটক আমার প্রেমাস্পদ, আমার ভাবনার সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের সুপঠিত চিন্তার মিল থেকে মনে হয়েছিল, ঠিক ‘পথেই’ আছি।

খুবই কুণ্ঠিতভাবে তাঁর এই বিদায়বেলায় একটু স্মৃতিচারণা করতে চাই, যদিও এর মধ্যে অহং নিরাবরণ থাকবে না ভেবে কষ্ট পাচ্ছি। ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সংবাদপত্রে অনেক লেখা ছাপা হয়েছিল। আমিও লিখেছিলাম। সেই বেদনার্ত দিনে আমি শামসুর রাহমানের এক হিন্দু যুবক চরিত্র সুধাংশুকে কেন্দ্রে রেখে গল্পের আবহে একটা কলাম লিখেছিলাম। কোনোভাবে শঙ্খদা এটা পেয়েছিলেন, পড়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ওই লেখা নাকি তাঁর চোখে জোয়ার নামিয়েছিল। সে লেখা কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না, শিরোনামটাও মনে নেই। আরও বলেছিলেন, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক গদ্যের এমন যুগলবন্দীতে আমি যেন আরও লিখি। তা আর হয়নি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, শঙ্খ ঘোষ আর তাঁর মতো অনেকেই সামনে দণ্ডায়মান। আমি কাক না কোকিল, সেই দ্বন্দ্বের নিরসন হয় না।

কবি, সাহিত্য সমালোচক, রবীন্দ্রপণ্ডিত—এমন সব অভিধায় অলংকৃত হয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। এসবই তাঁর একান্ত প্রাপ্য। কিন্তু কলকাতায় কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম না হয়েও তিনি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তাঁর উপস্থিতি ছিল এক সর্বজনীন ও প্রতিবাদী পোস্টার যেকোনো সভায়, সমাবেশে। ২০১৪ সালে প্রদত্ত ‘সমর সেন স্মারক বক্তৃতা’য় তিনি আধুনিক কালের সমাজব্যাধিকে চিহ্নিত করেছিলেন—প্রতিযোগিতায় যেকোনো মূল্যে এগিয়ে যেতে অন্যদের পিছিয়ে ফেলা। ‘হওয়ার দুঃখ’ শীর্ষক সেই অভিভাষণে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, ‘হয়ে ওঠা বলতে কী বোঝায়, ঠিক ঠিক কী হতে চাই আমরা, কীভাবে হতে চাই...এ প্রশ্নের খুব বাস্তবমুখী প্রয়োজনভিত্তিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে নিশ্চয়। অনেকেই চাইবে বড় হতে, প্রতিষ্ঠাবান হতে, আর সেই প্রতিষ্ঠার বা বড়ত্বের ধারণা গচ্ছিত থাকবে অর্থসম্পদের সম্ভাবনার মধ্যে।...আমাদের চাওয়ার মধ্যে যদি ব্যক্তিগণ্ডিকে পেরিয়ে যাবার কোনো স্বপ্ন বা প্রত্যয় না থাকে, তাহলে আমাদের পাওয়া বা হওয়া এক খণ্ডিত খর্বীকৃত, এমনকি বিকৃত পাওয়া বা হওয়া।’ শঙ্খ ঘোষের এই সাবধানবাণী যেন আমাদের ভাবায়, চেতনা জোগায় সমাজের বৈষম্য দূর করতে। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।