আলাদিনের চেরাগ কিনবেন?

অলংকরণ: আরাফাত করিম
আলাদিনের চেরাগ নাকি আছে আমাদের এখানেই! কীভাবে? জানতে হলে লেখাটি পড়তে হবে।

সে প্রায় বছর বিশেক আগের কথা। আরব্য রজনীর গল্পের বই পড়ে জেনেছিলাম, আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের কাহিনি। ওই বয়সে বেশ রোমাঞ্চকর লেগেছিল বিষয়টা। এমন চেরাগ পেলে কী ভালোই না হতো—ভাবতাম মাঝেমধ্যে। কী চাইব দৈত্যের কাছে, তা নিয়েও মনে মনে ভাবতাম।

এরপর টিভিতে দেখা হলো আরব্য রজনীর কাহিনি। আলাদিনের কার্টুনও তৈরি হলো। দেখার পরও রেশ থেকে যেত বেশ। ধীরে ধীরে ঘা খেতে খেতে মনে হয়েছিল, চেরাগ আসলে নেই। তবে বিশ্বাস করুন, সেই অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল কিছুদিনের জন্যই। বুদ্ধিসুদ্ধি পাকতে পাকতে বুঝে ফেললাম, আছে, আলাদিনের চেরাগ আদতেই আছে। তবে এখন আর আলাদিনের হাতেই নেই, এই যা!

খবর হয়েছে, ভারতের এক অধিবাসী নাকি আলাদিনের চেরাগ কিনছেন ভেবে কাদের যেন লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। এ নিয়ে অনেক হাসি-তামাশা হচ্ছে। অবশ্য আমি তাঁর দোষ খুঁজে পাই না। একবার ভেবে দেখুন তো, আপনার চারপাশে এমন চেরাগওয়ালা মানুষ কি কম? আঙুল ফুলে কলাগাছ কেন, পুরোপুরি সুবিশাল বটগাছ বনে যাওয়া লোক কি চেনেন না?

এই যে, ভুরু কোঁচকাচ্ছেন। যতই বিরক্ত হোন, উত্তরে কি ‘না’ বলতে পারবেন? পারবেন না। পত্রিকার পাতায় আর কয়জন পি কে হালদারের খবর আসে? এমন যে ঢের আছে। শেষে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে যে!

অন্য কোনো দেশে থাকুক না থাকুক, আমাদের দেশে তাই আলাদিনের চেরাগ সত্যিই আছে। সমস্যা হলো, চেরাগের সংখ্যা অনেক বেশি। অবশ্য আরব্য রজনীর আলাদিন এই বঙ্গে কোনো কালে এসেছিলেন কি না, সে ব্যাপারে ঠিক নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ আলাদিনের তো একটাই চেরাগ ছিল জানতাম। তবে কি এখানে ডুপ্লিকেট তৈরি হচ্ছে?

খবর হয়েছে, ভারতের এক অধিবাসী নাকি আলাদিনের চেরাগ কিনছেন ভেবে কাদের যেন লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। এ নিয়ে অনেক হাসি-তামাশা হচ্ছে। অবশ্য আমি তাঁর দোষ খুঁজে পাই না। একবার ভেবে দেখুন তো, আপনার চারপাশে এমন চেরাগওয়ালা মানুষ কি কম? আঙুল ফুলে কলাগাছ কেন, পুরোপুরি সুবিশাল বটগাছ বনে যাওয়া লোক কি চেনেন না?

ডুপ্লিকেটের প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন বলি। এই খাতে কিন্তু চীনের পরই আমাদের বৈশ্বিক অবস্থান। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো চীনও আমাদের কর্মকুশলতায় ভড়কে যেতে পারে। প্রায়ই আমাদের এমন শিল্পকর্মের কিছুটা আইনের হাতে ধরা পড়ে যায়। তখন আমাদের চর্মচক্ষু সার্থক হয়। অনেক সমালোচক সেগুলোকে ভেজাল বলে অভিহিত করেন বটে, তবে শিল্পের সমালোচনা তো থাকবেই! নইলে শিল্প কালোত্তীর্ণ হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে কেমন করে!

তবে আমার মতে, আলাদিনের চেরাগের ডুপ্লিকেট তৈরিতে আমরা কোনো খাদ মেশাইনি। অবিকৃত রাখতে একটু ফরমালিন মেশানো হতে পারে, তবে তা এত বেশি নয় যে গুণ নষ্ট হবে। মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সিল দেওয়া চেরাগ একেবারে। সেই চেরাগে হাত ঘষলেই দৈত্য বেরিয়ে আসে, আর ইচ্ছেপূরণ করে। আর প্রাসাদ-পয়সা চাইলে তো কথাই নেই। চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পূরণ হয়ে যায়। এখানকার ডুপ্লিকেট দৈত্যের ক্ষেত্রে আমরা আবার কিছু বিশেষত্ব যোগ করেছি কিনা!

বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য চেরাগের দৈত্যের মাস্ক ও গ্লাভস সরবরাহ করাটা অতীব প্রয়োজন। করোনাভাইরাস বলে কথা! একটু তো সাবধান থাকতেই হবে। আশা করি, এ দেশের চেরাগ বানানেওয়ালারা তাঁদের পণ্যে এই সুবিধা সংযোজন করে দেবেন। এতে দৈত্যদানোরও সুবিধা, আবার নতুন আলাদিনেরাও একটু স্বস্তি পেতে পারেন।

প্রশ্ন হলো, আলাদিনের আসল চেরাগটা এখানে কীভাবে এল? এ নিয়ে কিন্তু একটা গবেষণা চালু করা যেতেই পারে। আমাদের ঐতিহ্য উত্তরপুরুষদের জানানোর জন্য এটা প্রয়োজন। অপসংস্কৃতির জোয়ারে তো সব ভেসেই যাচ্ছে। কিছু খড়কুটো তো বাঁচাতে হবে, নাকি?

আমার প্রস্তাব, এই গবেষণার জন্য অন্তত একটা নতুন মন্ত্রণালয় খোলা হোক। তাতে সব পদে একাধিক ব্যক্তি নিয়োগ দিতে হবে। সবার মত নিয়েই যে আমরা কাজ করি, এটা বোঝানো খুব জরুরি। মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক কাজ হবে গবেষণা করা, খড়ের গাদা থেকে সুই খুঁজে বের করার মতো করে ইতিহাসকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনা। আর যদি চেরাগ বানানোর একটা উন্নত ফর্মুলা বানিয়ে ফেলা যায়, তবে তো কেল্লা ফতে! এরপর তার বাণিজ্যিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আরেকটি প্রকল্প নাহয় নেওয়া যাবে।

প্রাথমিকভাবে নতুন মন্ত্রণালয়ের হাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা কিন্তু দিতেই হবে। এই বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। সবার উন্নয়ন চাইলে এটুকু সহ্য করতেই হবে। আর বুঝতে পারছেন না কেন, গবেষণায় তো ব্যবহারিক অংশও থাকে, নাকি? উন্নত ফর্মুলার চেরাগ কতটা উন্নত হলো, তা বোঝার একটা ব্যবস্থা তো রাখতে হবে।
এভাবেই একদিন হয়তো আমার বাড়ির পাশের রাস্তায় চেরাগ বিক্রি হবে, আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ। বোধ হয় সেদিন আর বেশি দূরে নেই। ফেরিওয়ালা তখন উচ্চস্বরে ডাক দেবেন, ‘চেরাগ নেবেন, চেরাগ? আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ?’

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]