আহমদ ছফা কেন পড়বেন?

আজ কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক আহমদ ছফার মৃত্যুদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এ লেখায় আলাপ করা হয়েছে এই লেখকের লেখাপত্র পড়ার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে।

নাসির আলী মামুনের তোলা আহমদ ছফার ছবি অবলম্বনে গ্রাফিকস মনিরুল ইসলাম

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে লেখাটা শুরু করা ভালো।
প্রিয় পাঠক, এইমাত্র ক্লিক করে বর্তমান যে লেখাটিতে আপনি ঢুকে পড়লেন, সেটির আখাস্তা বস্তু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কারণ কী?
কিছুটা বিস্তারিয়া বলি।  

আমাকে বলা হয়েছে, ‘আহমদ ছফা কেন পড়বেন?’ বিষয়ে একটি লেখা লিখতে। তত্ত্বের কচকচানি ও গাম্ভীর্যমুক্ত, সহজ ভাষার ছোট্ট একটি লেখা। লেখাটি এমন হতে পারে, যা পড়ে ছফা পাঠে বিশেষত তরুণদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়।

সমস্যা হলো, বিখ্যাতদের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীর ইস্যুভিত্তিক যেকোনো লেখায় চর্বিতচর্বণ এড়িয়ে নতুন কিছু বলা কঠিন। অধিকন্তু সময়ও অত্যন্ত কম। তা ছাড়া জ্ঞানীগুণী মহাত্মা-মহাজনেরা আহমদ ছফাকে নিয়ে অলরেডি প্রচুর লিখেছেন, লিখছেন এবং ভবিষ্যতে আরও লিখবেন। অর্থাৎ আহমদ ছফা দেশে এখন ছোটখাটো একটি ‘ইন্ডাস্ট্রি’।

জ্ঞানীগুণীদের মতো জ্ঞান যেহেতু নেই, তাই আহমদ ছফা বিষয়ে আমার বিশেষ মৌলিক কোনো ইনসাইটও নেই, তো এখন আমি কী করব?

প্রথমত, প্রিয় পাঠক, আপনাকে আমি সতর্ক করব। আপনাকে সতর্ক করব এই বলে যে লেখাটিতে আমার তরফে ফাঁকিবাজি আছে এবং ইহা কিঞ্চিৎ ক্লিকবেইট।

দ্বিতীয়ত, তরুণদের ছফা পাঠে আগ্রহ তৈরি করার শর্টকাট একটা রাস্তা আমি জানি। আহমদ ছফার ব্যাপারে তরুণদের মধ্যে আগ্রহ তৈরির সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে আহমদ ছফার রচনাবলি নিষিদ্ধ করা। নিষিদ্ধ হলে আমার ধারণা, তরুণেরা হুমড়ি খেয়ে ছফা পাঠ করবে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তারুণ্যের আগ্রহ দুর্দমনীয়। তবে এই পদ্ধতি সম্ভবত বাস্তবায়ন করা যাবে বলে মনে হয় না।
তৃতীয়ত, আহমদ ছফাকে কেন পাঠ করা উচিত? এই মর্মে কিছু খুচরো ‘কারণ’ পাঞ্চ করে লেখা শেষ করব।

আহমদ ছফা।
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

দুই

আহমদ ছফা ছিলেন অদ্ভুত এক চরিত্র। ছফা শব্দটা শুনলেই দাঁত-মুখ খিঁচানো, কপাল ও ভুরু কুঁচকানো, হঠাৎ হঠাৎ মেয়েলি সুরেলা কণ্ঠ এবং কখনো আঞ্চলিকতামিশ্রিত বিশেষ কথ্যভঙ্গির এক লেখকের ছবি মনে আসে।

‘ঘর করলাম না রে আমি, সংসার করলাম না।—ছফাই এই গান লিখেছেন। গৃহী না হলেও ছফা অন্যদিকে দেশ ও জাতির প্রতি ছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বশীল, হইচইভরা টগবগে মানুষ, দারুণ বন্ধুবৎসল, রাগে-অনুরাগে উষ্ণ, বেজায় দরদি ও আবেগপ্রবণ; আবার কখনো ক্ষিপ্ত, কখনো মেজাজি দুর্মুখ এবং তীব্র প্রতিবাদী৷

হুমায়ূন আহমেদ থেকে তুলে দিচ্ছি:

‘আমি আমার যৌবনে হন্টন পীরের মতো একজনকে পেয়েছিলাম। আমরা দল বেঁধে তাঁর পেছনে হাঁটতাম। তিনি যদি কিছু বলতেন মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গভীর রাতে নীলক্ষেত এলাকায় তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবেগে অধীর হয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করতেন “আমার বাংলাদেশ। আমার বাংলাদেশ।” আমরা গভীর মুগ্ধতায় তাঁর আবেগ এবং উচ্ছ্বাস দেখতাম। তাঁর নাম আহমদ ছফা। আমাদের সবার ছফা ভাই।’

পীরসুলভ ছফা যেমন পাবেন, তেমন রাখঢাকহীন ঠোঁটকাটা ছফার চেহারাও অন্যদের স্মৃতিচারণায় পাবেন। রাখঢাকবিহীন এই ছফার দেখা মিলবে আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারগুলোতে। কেমন মেজাজে কথা বলতেন, নমুনা হিসেবে সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

‘ছফা: এগজাক্টলি, এই যে বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে, তালি দেওয়ার যে ক্ষমতা এটাই মানুষকে বড় করে।

রাইসু: এইটা তো দামি কথা বললেন, ছফা ভাই।

ছফা: দামি কথা তো বলি, কিন্তু কারও মাথায় তো সান্ধায় না।’

ব্যক্তি ছফার বহুবর্ণিল চরিত্রের দেখা মেলে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রচিত স্মৃতিচারণামূলক ও তাঁকে মূল্যায়ন করে রচিত লেখাগুলোতে। যার মধ্যে অনেকগুলো পাওয়া যাবে ‘আহমদ ছফা স্মারকগ্রন্থ’-এ।

তিন

আহমদ ছফা এত বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন, এত বিচিত্র তাঁর পরিচয় যে ছোট একটা লেখায় সেসবের দিকে প্রলুব্ধ করা কঠিন। তাই অনেক কিছু বাদ দিয়ে অল্প কিছুতে দিকে হাইলাইট করে লেখা শেষ করব।

তত্ত্বের গুরুগম্ভীর কচকচানি যদি আপনাকে নিরুৎসাহিত করে, আপনি আহমদ ছফা পড়তে পারেন। ফিকশন ও নন-ফিকশন দুটোই ভালো লিখতেন ছফা। ফলে চারুতার সঙ্গে প্রজ্ঞার চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে ছফার লেখায়। তাঁর লেখা সরল ও সুখপাঠ্য। কিন্তু যেসব জ্ঞানকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত অনুমান করে তিনি লিখতেন, সেগুলো বেশির ভাগ সময়ই মৌলিক।

কিছুদিন পরপরই বাঙালি, বাংলাদেশি, বাঙালি মুসলমান ইত্যাদি নিয়ে চক্রাকারে যে বিতর্ক ঘনিয়ে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেই বিতর্কের প্রথম লেখা আহমদ ছফার ‘বাঙালির মুসলমানের মন’। লেখাটির সঙ্গে আপনি দ্বিমত হতে পারেন, বেশ কিছু পদ্ধতিগত ভুলও প্রমাণ করতে পারবেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সামষ্টিক মন বুঝতে ছফার দৃষ্টিভঙ্গিকে মোকাবিলা না করে পারবেন না। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার চেহারা-সুরত বুঝতে ‘বুদ্ধবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এর মতো বই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভয়াবহ সংকীর্ণ ও একমাত্রিক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ছফা এমন কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন, যেগুলো প্রচলিত বস্তাপচা চিন্তাকাঠামোকে অস্বস্তি দিয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির একটা শক্তিশালী প্রবণতার ধারক ও বাহক ছফা।
এই সব সিরিয়াস বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপে আপনি অনাগ্রহী হলে ছফার ফিকশনগুলো পড়েন।

বিশেষত শেষের দিকে রচিত উপন্যাসগুলোতে তাঁর রসবোধ অসামান্য।

আহমদ ছফার বিখ্যাত দুটি বই ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ও ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’
কিছুদিন পরপরই বাঙালি, বাংলাদেশি, বাঙালি মুসলমান ইত্যাদি নিয়ে চক্রাকারে যে বিতর্ক ঘনিয়ে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সেই বিতর্কের প্রথম লেখা আহমদ ছফার ‘বাঙালির মুসলমানের মন’। লেখাটির সঙ্গে আপনি দ্বিমত হতে পারেন, বেশ কিছু পদ্ধতিগত ভুলও প্রমাণ করতে পারবেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সামষ্টিক মন বুঝতে ছফার দৃষ্টিভঙ্গিকে মোকাবিলা না করে পারবেন না। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার চেহারা-সুরত বুঝতে ‘বুদ্ধবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এর মতো বই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভয়াবহ সংকীর্ণ ও একমাত্রিক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ছফা এমন কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন, যেগুলো প্রচলিত বস্তাপচা চিন্তাকাঠামোকে অস্বস্তি দিয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির একটা শক্তিশালী প্রবণতার ধারক ও বাহক ছফা।

রসবোধ আর রাজনৈতিক সচেতনতা—এই দুটি জিনিস একসঙ্গে না থাকলে ভালো স্যাটায়ার লেখা সম্ভব নয়। আহমদ ছফার দুটোই ছিল। একটি ভালো রচনার সার্থকতার একটি প্রমাণ হলো রচনাটি প্রকাশের অনেক দিন পরও প্রাসঙ্গিক থাকতে পারা। ‘গাভীবৃত্তান্ত’ উপন্যাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নকশা ও চেহারা-সুরত ছফা এঁকেছেন, এখনকার চা-চপ-সমুচাময়তায় তার আশ্চর্য প্রতিফলন দেখে চমকে উঠতে পারেন।

‘আহমদ ছফা কেন পড়বেন?’—এ রকম শিরোনামের লেখা দেখলে আহমদ ছফা নিশ্চিত আপত্তি জানাতেন। বিরক্ত হতেন তো বটেই, মেজাজ-মর্জি খারাপ থাকলে আমাকে ফোন করে গালিগালাজও করতেন হয়তো।

আহমদ ছফা এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতেন, আমার এই অনুমানের কারণ কী?
জানতে হলে আপনাকে আহমদ ছফা পড়তে হবে।

না, ছফা ইন্ডাস্ট্রির দোকান থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড পাঠ নয়। ছফা বিষয়ে বিভিন্ন মহাত্মা মহাজনদের তাফসির নয়, ছফার লেখা আপনাকে পড়তে হবে।

এই যে দেখেন! আহমদ ছফা পড়ার আরও একটা কারণ পাওয়া গেল!