আয় করলে কর

‘বাজেট’ বড়ই খটমটে ব্যাপার। তবে আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তিন অক্ষরের এই শব্দ। সাহিত্যও এর বাইরে নয়। লিখেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন

বাজেটকে খুব কঠিন বিষয় বলে মনে করে অনেকেই, অথচ এটা এমন হাতি-ঘোড়া কিছুই নয়, রাষ্ট্রের আয় ও ব্যয়ের সাংবাৎসরিক হিসাব। সত্যিকার অর্থে কঠিন হচ্ছে সরকারের আয় মেটাতে মানুষের ব্যয়কে আয়ত্তে আনার কাজটা। একজন পাকা গৃহিণীও কাজটা করতে পারেন। সরলা গৃহিণীটি সসীম আয়ের বিপরীতে অসীম ব্যয়কে সামাল দিয়ে কাজটি করেন হাজারের হিসাবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের কাজটিতে থাকে ঢাউস একটা বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে আয়ের উৎস বাড়ানোর অছিলায় গুঁজে দেওয়া শুভংকরের ফাঁকির মতো লক্ষকোটি টাকার অঙ্কের হিসাব। সংখ্যাবহুল এই দলিলের সংখ্যার হুল যেন শূলে চড়ানোর জন্য ভাঁড়িয়ে নিয়ে চলে দেশের তাবৎ মানুষকে। কারণ, এগুলোই ‘নিঃশব্দ চরণে’ এসে মানুষের ট্যাঁক পুরো ফাঁকা করে না নিলেও ঝাঁকাভর্তি বাজার করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তখন যে টাকারা ‘যায় ফিরাইব তায় কেমনে’ বলে ‘নয়নের জল’ ‘বিফল নয়নে’ ঝরানো ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। আমাদের গেছে যে টাকা ‘একেবারেই কি গেছে/ কিছুই কি নেই বাকি?’ শুধালে জবাব পাওয়া যাবে, তোমার সব টাকাই আছে সরকারি খরচের গভীরে। অর্থাৎ বাজেটের নামে সরকারের আয় বাড়ানোর ফিকিরে আয়করে যা গেছে, তাকে ‘আয় আয়’ করে ডাকলেও আর নগদে ফেরত আসবে না। তাই প্রতিবছর যখন গাদা গাদা কাগজপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর জন্য কেনা হচ্ছে নতুন পোর্টফোলিও ব্যাগ কিংবা নতুন জুতা, তখন বিরোধী দল লেখাচ্ছে ‘গরিব মারার’ বাজেটের নিন্দা করা ব্যানার, আর সরকারি দল ছাপাচ্ছে ‘জনমুখী’ বাজেটের অভিনন্দনসূচক ডিজিটাল সাইন। এ বছরও আমাদের একজন বিরোধীদলীয় নেতা প্রকাশ্যেই বলেছেন যে বাজেটটি তিনি পড়েননি বটে, তবু বলতে পারেন যে এটি গণবান্ধব নয়। তিনি এটা বলতেই পারেন, কারণ, ধারণাটা তাঁর মনবান্ধব। তাঁর হাত-পা যা-ই বাঁধা হোক না কেন, ‘মন বান্ধিবি কেমনে?’ তিনি তো বলেই খালাস। এই যে উৎপাদন পর্যায়ে মুড়ির ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হলো, কিন্তু আমাদের গ্রামের মুড়ি ভেজে চলা বুড়ি সরলা কি জানে ভ্যাট কী বস্তু? দুবেলা কুমড়োর ঘ্যাঁট জুটলেই তার চলে যায়।

কেউ ভাবছেন, বাজেটের সময় মন্ত্রীর জন্য জুতা কেনার ছুতো কী? বাজেট পেশের বহু কায়দা আছে দেশে দেশে। কানাডার অর্থমন্ত্রীকে বাজেট উপলক্ষে কিনতে হয় নতুন জুতা। তিনি কোন ব্র্যান্ডের জুতা কিনেছেন, সেখান থেকে কোনো খবর তৈরি করা যায় কি না—এসবের খোঁজে তাই মিডিয়ার চোখ থাকে তাঁর পায়ের দিকে। এবার দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো নারী অর্থমন্ত্রী (ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড) এ বছরের বাজেট পেশ করলেন। তাই বোধগম্য কারণেই তাঁর পায়ের দিকেই সবার নজর আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি, কিন্তু রিপোর্ট লেখার সময় ‘দেহি পদপল্লবমুদারম’ লিখতে গিয়ে দ্বিধায় পড়তে হবে সাংবাদিকদের, পাদুকার কথা তো জয়দেব লেখেননি।

আমাদের এককালের রানিমার দেশে টানা এক শ বছর ধরে লাল চামড়ায় মোড়া একই কাঠের ব্রিফকেস নিয়ে চ্যান্সেলররা (অর্থমন্ত্রী) হাউস অব কমন্সে এসেছেন ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। তার পরের বছর প্রথমবারের মতো নতুন একটা কেনা হয়েছিল। কী একটা জাতি! একটা বাক্স দিয়ে এক শ বছর পার্লামেন্ট পার করা, ভাবা যায়! বাচ্চাদের স্কুলে দেওয়া দুধের খরচ কেটে দেওয়ার জন্য সাধে কি ওদের প্রধানমন্ত্রী থ্যাচারের নাম হয়েছিল ‘মিল্ক স্ন্যাচার’! পার্লামেন্টে আসার আগে সেই লাল বাক্স তুলে ধরে ফটোসেশন করার যে ঐতিহ্যটা রয়েছে, সেটাও বুল ফাইটিংয়ে লাল কাপড় দেখানোর মতো করদাতা জনগণকে খেপানোর মহড়া। আমাদের পড়শি ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় নারী অর্থমন্ত্রী (প্রথম ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৯-৭০) নির্মলা সীতারমণ ২০১৯ সাল থেকে বাজেট পেশ করছেন। কিন্তু ‘বাজেট’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত ফরাসি অর্থ ‘ছোট বাক্স’ বা ‘থলে’র প্রতি লেশমাত্র সমীহ না করে কোনো থলথলে ব্যাগ নিয়ে বাজেট পেশ করতে আসেন না তিনি, আগের দুই বছর লোকসভায় হিসাবপত্র আনতেন লাল কাপড়ে মোড়া বালাম বইতে। এ বছর (২০২১) সেটাও ছেড়েছেন, সঙ্গে এনেছেন একটা ট্যাব, ওটা থেকেই পড়েছেন বাজেট ভাষণ। সাংসদদের কাছেও কোনো কাগজপত্র না দিয়ে কাগজ ছিঁড়ে কিংবা ছুড়ে বিরোধী দলের প্রতিবাদে বাদ সেধেছেন নির্মলাজি।

সব দেশেই বাজেটে সরকারি আয় বাড়ানোর ফিকিরে ফকির না হওয়ার জন্য জনগণকে বানাতে হয় নানান বাহানা। মধ্যযুগের ইউরোপে সাবানের ওপর যে ট্যাক্স বসানো হয়েছিল, সেটা ব্রিটেনে চালু ছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তাই গোসল করার প্রবণতা কমে যাওয়ায় সেখানকার বাড়ি যত বড়ই হোক না কেন, গোসলখানা রাখা হতো একখানা মাত্র। লবণের ওপর করকে তুচ্ছ ভাবলেও এটাই যে সরকারকে কড়কে দিতে পারে, ফরাসিরা বিপ্লব করে দেখিয়ে দিয়েছে সেটা। ভারতবর্ষে নুন নিয়ে খুনোখুনি কোম্পানি আমল থেকে শুরু হয়ে রাজ আমলেও ছিল বলে গান্ধীজিকে সত্যাগ্রহে নামতে হয়েছিল। এ ছাড়া মিসরের ফেরাউন রাজত্বে ভোজ্যতেলের ওপর, রাশিয়ায় পিটার রাজত্বে দাড়ির ওপর, ইংল্যান্ডে জানালার ওপর—এ রকম হাজারো জিনিসের ওপর আরোপ করা কর নিয়ে কড়াকড়ির দৃষ্টান্ত দেশে দেশে কম নেই।

যা-ই হোক, এভাবে বিদেশে ঘোরাঘুরি করলে আমাদের বাজেট ফেল করবে, করোনা মহামারিতে জারি করা নিষেধাজ্ঞায় সেটা কঠিনও বটে। তার চেয়ে ঘরে বসে বাজেট নিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা গেল, সংখ্যা ও হিসাবনির্ভর বলেই বিষয়টা সাহিত্যের পাতে ওঠেনি, তাই সরস্বতীর পা-তেও নেই নৈবেদ্য। বুঝতে পারি, লেখকদের সংখ্যাভীতি থাকে বলে এটার মধ্যে ঢুকতে চান না কেউ। যেমন অ্যাকাউন্ট্যান্টদের থাকে সংখ্যাপ্রীতি, তাঁরা গল্প-উপন্যাস পড়ে মজা পান না, কারণ, এসব বইতে সংখ্যা বলতে থাকে কেবল পৃষ্ঠা নম্বর। তবে ছড়া সাহিত্যে বাজেট ঢুকে পড়ে জেট গতিতে, কারণ, এটির নীরব দংশনের ছড়িয়ে পড়া প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদ ছড়া দিয়েই ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যেমন ব্রত রায় লেখেন, ‘বাজেট হবে অনেক বড়,/ বাজেট হবে ফ্যাট/ কেমন করে? দাও ঢুকিয়ে/ নানান রকম ভ্যাট!’ নাম জানা নেই এ রকম একজন লিখেছেন ‘মির্জা নুরুল গনি/ বিরাট বিশাল ধনী/ বাজেট এলেই নতুন করে/ পায় সে হীরার খনি।/ কেটেছে সব ধাঁধা/ নেই কোনো আর বাধা/ নতুন করে চোরাই টাকা/ করবে আবার শাদা।/ সদানন্দ শীল/ নিবাস চলনবিল/ নামের সাথে তার জীবনের একটুও নাই মিল।/ সারাটা দিন খেটে/ ভাত জোটে না পেটে/ বোঝেই না সে কী আছে এই/ জমকালো বাজেটে।’ ছড়ার ছররা গুলি যেন।

শাঁসালো লেখকদের ব্যাপারে অনেকেই ভাবে, বাজেট নিয়ে না হলেও লিখে তো ভালোই আয় করেন। কিন্তু তাঁদেরও যে আয়করে বড় অঙ্কের আয় চলে যায়, সেটা কেউ বিবেচনা করে না। বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো (যারা নিয়মিত লেখক সম্মানী দেয়) সব শ্রেণির লেখকদের লেখক সম্মানী থেকে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে আয়কর কেটে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক শিষ্টাচার পালন করে। লেখকেরাও এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না, হয়তো ভাবেন, লেখক সম্মানী যে দিচ্ছে, তা-ই তো যথেষ্ট। অথচ তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি আয়কারীদের কর ফাঁকির বিষয়টা রাজস্ব বিভাগ ধরতে না পারলেও এই দরিদ্র লেখকেরাই সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আনতে পারেন। যেমন মার্ক টোয়েন তাঁর ‘দ্য ট্যাক্সম্যান’ গল্পে আয়করওয়ালাদের খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়ার কায়দা শিখতে গিয়ে কর ফাঁকি দেনেওয়ালাদের গোমর ফাঁক করে থাপ্পড় কষিয়েছেন বিদ্যমান রাজস্ব ব্যবস্থার ওপর।

আবার কেউ ভাবে, লেখকেরা মনের গলিঘুঁজি থেকে ভাব খুঁজে নিয়ে পুঁজি ছাড়াই আয় করেন, তাই আয়কর তাদের ওপর ন্যায্য। তারা বোঝে না, লেখকের সৃষ্টির যে কাঁচামাল, তার মূল্যের কিছুটা অদৃশ্য ও অনির্ণেয়, আর কিছুটা বস্তুগত। তা না হলে বেচারা কার্ল মার্ক্স জামাতা পলকে দুঃখ করে বলতেন না, ‘ক্যাপিটাল লেখার সময়ে আমি যে পরিমাণ সিগার খেয়েছি, বইটা থেকে সে টাকাও উঠে আসবে না।’ অনেকেরই জানা আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য জনগণের ওপর মার্কিন সরকারের আরোপিত করহার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। তখন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো বড় লেখকেরা ঠেকে শিখেছিলেন যে লেখার আয় থেকে বাজেয়াপ্ত করার কায়দায় ৮০ পার্সেন্ট কর নিয়ে যায় সরকার। ফর হুম দ্য বেল টোলস-এর রয়্যালটি বাবদ যা পেয়েছিলেন, তার বেশির ভাগই দিয়ে দিতে হয়েছিল, একইভাবে দিতে হয়েছে বইটা নিয়ে সিনেমা বানানোর জন্য প্যারামাউন্ট পিকচার্সের দেওয়া এক লাখ ডলার থেকেও।

হেমিংওয়েরা বোকা বলে যা আয় করেন, তার প্রায় সবটাই দিয়ে ফেলেন। আয় না করাই যে বুদ্ধিমানের কাজ, সেটা বোঝা যায় আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামায় তাঁদের আয়ের পরিমাণ দেখে। তাহলে বাজেটে যা-ই করা হোক না কেন, অনেককেই পাওয়া যাবে যাঁরা দৃশ্যমান আয় করবেন না, তাঁরা ভাবেন:

উন্নয়নের ব্যয় মেটাতে যা পাওয়া যায় ঘরে

সবটা যদি আয়করে যায় কী হবে আয় করে।