ইন্টারোগেশন

বিজয়ের এই দিনে পড়ুন মুক্তিযুদ্ধের এক অন্য রকম গল্প। গা ছম ছম করা রহস্য গল্প।

নভেম্বরের শুরুতে বেশির ভাগ ফ্রন্টে যুদ্ধ তখন আর চোরাগোপ্তা নেই। ক্লান্ত গেরিলাদের সরিয়ে আমরা রেগুলার সৈন্যদের সামনে আনতে শুরু করেছি। ব্যাটল ফরমেশন ধীরে ধীরে কেতাবি হয়ে উঠছে। ক্যাম্প কমান্ডারের তাঁবুর ভেতর তেপায়া স্ট্যান্ডে খাড়া করা ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে আমরা যেসব যুদ্ধ-ছক আঁকছি, সেগুলো ক্রমাগত ভরে উঠছে দুর্বোধ্য সামরিক জারগনে।

এ রকম দিনে কদমতলী সীমান্তে একটা ইন্টারোগেশনের জন্য আমার ডাক পড়ল। ওখানকার ক্যাম্প কমান্ডারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। দুদিন আগে একটা অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। বাজে ক্যাজুয়ালটি। তার জবাবদিহি। রুটিন কাজ।

আমি বিরক্ত হয়ে জিপে উঠে রওনা দিলাম কদমতলী ক্যাম্পে।

শীত পড়ে গেছে। দুপুর গড়াতেই রোদের তেজ কমে যেতে শুরু করেছে। প্রান্তরজুড়ে মাষকলাইয়ের ধূসর-খয়েরি খেত। তার ভেতর দিয়ে ধুলা উড়িয়ে যেতে যেতে আমি বুঝে গেলাম, এটা কোনো রুটিন ইন্টারোগেশন নয়। যে কাগজপত্র আমাকে দেওয়া হয়েছে, তাতে জটিলতার গন্ধ পাচ্ছি। কোথাও একটা কিছুতে বিদঘুটে জট বেঁধে বসে আছে, যেটা কেউ ছাড়াতে পারছে না।

খরস্রোতা কামট নদের পুব ধারে একটা শালবনের ভেতর কদমতলী ক্যাম্পে পা রেখে ঘাবড়ে গেলাম। পুরো ক্যাম্প যেন অস্থায়ী হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা চলছে। ছোটাছুটি আর ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠার আওয়াজের মধ্যে নিরাবেগ হলুদ টিনের মগে আমাকে চা খেতে দিলেন ফোর্থ ইনফ্যান্ট্রির কর্নেল জোবায়ের। উজানপুর ফিল্ড অফিস থেকে তাঁকে পাঠানো হয়েছে এক দিন আগে। আমার আগে উনি দুদফা জিজ্ঞাবাদ করেছেন ক্যাম্প কমান্ডার আবদুল জব্বারকে। পথে সেটারই নথি পড়েছি। একটা উঁচু শিমুলগাছের নিচে চেয়ার পেতে বসে চা খেতে খেতে আমাকে ব্রিফ করলেন জোবায়ের।

ব্রিফ শেষে নদীর দিক থেকে উঠে আসা নীলচে-কালো কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম, ‘কোথায় লোকটা?’

ইশারায় আমাকে পশ্চিমমুখী একটা তাঁবু দেখিয়ে দিলেন কর্নেল।

সেটায় ঢুকে দেখি, চল্লিশোর্ধ একটা লোক চেয়ারে বসে আছে। আমার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। আমাকে ঢুকতে দেখে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করল।

শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলাম।
মোটা উলের সোয়েটার পরা লোকটাকে এ মুহূর্তে যা দেখাচ্ছে, যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে লোকটা ঠিক তা-ই ছিল: একটা থানা শহরের হাইস্কুল টিচার। তাঁর নিরীহ চোখের দিকে তাকালে উঁচু উঁচু শিরিষগাছের তলায় লাল ইটের স্কুল বিল্ডিংয়ের ছবি ভেসে ওঠে। কোনোভাবে তাঁকে একটা রক্তক্ষয়ী সামরিক যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজিস্ট বলে মনে হয় না।
অথচ কর্নেল জোবায়েরের ভাষ্যমতে, ব্যাটল ফরমেশনের কলাকৌশল নিখুঁতভাবে রপ্ত করেছেন জব্বার মাস্টার। তাঁর সঙ্গে কথা বললে যে কারও মনে হবে, সিক্সটি-ফাইভে পাঞ্জাব ফ্রন্টে কোনো ওয়ার স্ট্র্যাটেজিস্টের সঙ্গে কথা বলছি। জোবায়ের বাড়িয়ে বলে থাকতে পারে পরিস্থিতিকে নাটকীয় করার জন্য।

আমি দু-চারটা কথার পরেই আসল প্রসঙ্গে চলে গেলাম।

‘কমান্ডার জব্বার, কামট নদের অপর পারে শিমুলিয়ায় যে পাক আউটপোস্ট আছে, সেটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার ওপর আমরা এত জোর কেন দিচ্ছি, আপনার কোনো ধারণা আছে’?

‘আছে’, বলল লোকটা।
‘কেন?’
‘কারণ, আর সাত দিনের মধ্যে আবদুল্লাহপুর গ্যারিসনে অভিযান চালাবে মুক্তিবাহিনী। বড় অ্যাসল্ট।’

‘পুব ফ্রন্টিয়ারে সবচেয়ে বড়। আমরা একটা মিনি ক্যান্টনমেন্ট দখলের প্ল্যান করেছি। কিন্তু সেটার সঙ্গে শিমুলিয়া আউটপোস্টের সম্পর্ক কী?’

আমার প্রশ্নের ধরন দেখে হাসলেন জব্বার। আমি যেন পড়া ধরছি। বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা মাটিনগরের দিক থেকে আগাবে। শিমুলিয়া ঠিক তার উল্টা দিকে। পাক বাহিনীর সব মনোযোগ যাতে শিমুলিয়ার দিকে নিবদ্ধ হয়। এটাকে সামরিক ভাষায় বলে কাউপেন্স ডিসেপশন।’

‘আবদুল্লাহপুর অভিযানের কথা আপনার জানার কথা নয়। জানলেন কী করে?’
‘আমি জানতাম না। কর্নেল জোবায়ের বলেছেন, গতকাল।’

বলতে বলতে আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছনে তাকালেন জব্বার, তখন বুঝতে পারলাম, অলক্ষ্যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন কর্নেল জোবায়ের।

‘তাহলে বুঝতে পারছেন, শিমুলিয়া আউটপোস্ট দখল অভিযান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই না?’

এবার কর্নেল জোবায়ের কথা বললেন, ‘হ্যাঁ, নাহলে সত্তর মাইল দূরে ওয়াহিদপুর থেকে কমান্ডার জব্বারকে কেন এখানে আনা হবে।’

আমি বললাম, ‘সোমবারের অভিযান ব্যর্থ হওয়ার কথা ছিল না। অদ্ভুতভাবে সেটা ব্যর্থ হয়েছে। সেই অভিযানে আপনার টিমের একজন বিশেষ যোদ্ধার থাকার কথা ছিল না। আপনি তাকে রেখেছেন। সহযোদ্ধাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে রেখেছেন। সেই কারণেই কি অভিযান ব্যর্থ হয়েছে কমান্ডার জব্বার?’

আমার প্রশ্নটি এতই আকস্মিক আর বিদঘুটে যে শিক্ষক কিছু বুঝতে না পেরে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। একটা আহত যোদ্ধার দূরবর্তী চাপা গোঙানি তাঁবুর নীরবতাকে আরও গাঢ় করে তুলেছিল।

দীর্ঘক্ষণ জবাবের অপেক্ষা করে আমি বললাম, ‘এ অভিযানের সতেরো দিন আগে শিমুলিয়া ক্যাম্পে আরেকটা অভিযান চালিয়েছিলেন আপনারা।’

‘হ্যাঁ। চালিয়েছিলাম’, কিছুটা ক্লান্ত স্বরে বললেন জব্বার। বোঝা যায়, একই প্রসঙ্গে বারবার কথা বলতে বলতে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসেছে তাঁকে।

‘আমি ওই অভিযানের ডিটেইলে যাব না। বেশির ভাগই আমি জেনে নিয়েছি। আমি শুধু অভিযানের একটা অদ্ভুত আউটকামের ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করব।’
‘কী সেটা?’
‘আপনিই বলুন।’
‘আমি বুঝতে পারছি না।’

‘সোজা করে বলি। আমার সময় কম। আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে নিজের ক্যাম্পে। সতেরো দিন আগের প্রথম অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল রেডিও সিগন্যাল ইন্টারসেপ্টরের কারণে। ওরা টের পেয়ে গিয়েছিল গেরিলাদের অবস্থান। ফলে গুলি খেয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল ২২ জনের দলটিকে। সতেরোজন নদী সাঁতরে ফেরত আসতে পেরেছিল। দুজনের গুলিবিদ্ধ লাশ পরদিন ভোরে ভেসে থাকতে দেখা যায় কামট নদের পানিতে। বাকি তিনজন?’

‘তিনজন ধরা পড়ে।’
‘তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল?’
‘যা হওয়া স্বাভাবিক, তা-ই হয়েছে। তাদের শিমুলিয়া ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন নির্যাতন করা হয়েছে, আমরা নদের এপার থেকে চিৎকার শুনতে পেয়েছি।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি আমি। তারপর আসল কথাটা বলি, ‘তাদের তো প্রাণে বাঁচার কথা না। কিন্তু তিন দিন পর ওই তিনজনের একজন ফিরে এল। তাই না?’
কমান্ডার জব্বার আমার দিকে তাকান। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন, ‘হ্যাঁ। রুস্তম ফিরে এসেছিল।’
‘কীভাবে?’

‘ও পালিয়ে এসেছে। ক্যাম্পে যে ঘরে ওদের আটকে রাখা হয়, সেটার বাথরুমের জানালার শিক ভেঙে ও পালিয়ে আসে।’

‘লাকি বয়। তো, এই রুস্তমই আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু কমান্ডার জব্বার। আমরা তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলব। আমি সে জন্যই এসেছি।’

‘বলুন’, বললেন কমান্ডার জব্বার। তাঁর কণ্ঠে এমন ছেড়ে দেওয়া একটা ভঙ্গি, যেন পরাস্ত হয়ে গেছেন তিনি।

‘রুস্তম ফিরে আসার পর কী হলো, বলুন আমাদের।’

‘ভোররাতে ফিরে এসেছিল রুস্তম। আমিন আলী ফজরের নামাজ পড়ার জন্য উঠেছিল। ক্যাম্পে ঢোকার মুখে যে কলের পাড় দেখছেন, সেইখানে একটা ডালিমগাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রুস্তম। টলছিল। সারা গায়ে কালশিটে। কয়েক জায়গায় চামড়া ছিলে গেছে। আমিন আলী ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। পরের তিন দিন একটানা ঘুমিয়েছে রুস্তম। ঘুমের পর্ব শেষ হওয়ার পর দুদিন কারও সঙ্গে কথা বলেনি। তারপর একটা পর্ব গেছে, কাউকেই ঠিকমতো চিনতে পারছিল না। কারও নাম ঠিকমতো বলতে পারছিল না। নির্যাতনের চোটে ও অনেক স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে। তবে শারিরীকভাবে দ্রুতই সেরে ওঠে রুস্তম। আমরা তখন দ্বিতীয় অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার তাঁবুতে ব্যাটল ফরমেশনের নকশা আঁকার কাজ চলছে। রুস্তম মাঝে মাঝে সেখানে এসে বসে থাকত। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত বোর্ডের দিকে। তারপর একদিন ও বলে, দ্বিতীয় অভিযানেও ও থাকতে চায়। আমরা কেউ রাজি ছিলাম না প্রথমটায়। প্রথমত ও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, একটা মেন্টাল ট্রমায় দ্বিতীয়বার ওকে ঠেলে দেওয়ার কোনো যুক্তি পাইনি।’
‘তাহলে? ওকে নিলেন কেন?’

‘কারণ, ও শিমুলিয়া ক্যাম্পের ভেতরের জিওগ্রাফিটা জানে। দেখে এসেছে। বুদ্ধিটা ওই দিয়েছিল।’

‘বেশ। এবার একটা কথা বলি। ফিরে আসার পর রুস্তমের মধ্যে কোনো পরিবর্তন কি আপনারা লক্ষ করেছেন?’

‘কিছু পরিবর্তনের কথা তো বললামই। ও একটা ঘোরের মধ্যে চলছিল। স্মৃতি হারিয়েছে।’
‘এ-ই সব? আর কিছু না?’
কমান্ডার জব্বার আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

আমার প্রশ্নের ধরন দেখে হাসলেন জব্বার। আমি যেন পড়া ধরছি। বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা মাটিনগরের দিক থেকে আগাবে। শিমুলিয়া ঠিক তার উল্টা দিকে। পাক বাহিনীর সব মনোযোগ যাতে শিমুলিয়ার দিকে নিবদ্ধ হয়। এটাকে সামরিক ভাষায় বলে কাউপেন্স ডিসেপশন।’

‘আমি শুনেছি, সহযোদ্ধারা আরও কিছু পরিবর্তনের কথা বলাবলি করত। কোনো কোনোটা এত বেসিক পর্যায়ের যে মনে হতে পারে, লোকটার ব্যক্তিত্ব বদল হয়ে গেছে। যেমন...যেমন কেউ কেউ বলেছে, অভিযানে যাওয়ার আগে রুস্তম ছিল বাঁহাতি। ফিরে এসে সে ডান হাত দিয়ে সব কাজ করতে শুরু করে।’

কমান্ডার জব্বারের মুখে একটা হাসি ছড়িয়ে যায়। বলেন, ‘ওটা আমিও শুনেছি। গুজব। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। ও বাঁহাতিই থেকে গেছে।’
‘আচ্ছা। তার আর কোনো পরিবর্তন?’

‘রুস্তম ভালো গান গাইত। সিনেমার গান। কিন্তু ফিরে আসার পর তাকে দিয়ে সহযোদ্ধারা গান গাওয়াতে পারেনি। অনেক সাধাসাধির পর সে যে গান ধরেছিল, তাতে সুরের কিছুই ছিল না।’

‘কিন্তু তবু আপনি তাকে দ্বিতীয় অভিযানে রাখলেন।’

‘না রাখার মতো কোনো কারণ আমি পাইনি। যা কিছু আমার কানে এসেছে, সবই কানাঘুষা। গুজব।’

‘ঠিক আছে। দ্বিতীয় অভিযানের দুদিন আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা কী বলবেন কমান্ডার জব্বার?’

শিক্ষক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বলেন, ‘ঠিক আছে। ব্যাপারটা এই, দ্বিতীয় আরেকজন ফিরে আসে।’
‘ওই তিনজনের?’
‘হ্যাঁ।’
‘মানে শিমুলিয়া ক্যাম্পে ধরা পড়েছিল যে তিনজন, তাদের আরেকজন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী নাম তার?’
‘রব্বানি।’
‘রব্বানি কীভাবে ফিরল?’
‘সে–ও পালিয়ে এসেছে।’
‘একইভাবে? জানালার শিক গলে?’
‘না। আমার ধারণা, রাব্বানিকে ওরা ছেড়ে দিয়েছিল।’
‘কেন? ছেড়ে কেন দেবে?’

‘কারণ, ও পুরোপুরি পাগল হয়ে গিয়েছিল। বদ্ধ উন্মাদ যাকে বলে।’
‘তাকে আপনারা ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনলেন।’
‘হ্যাঁ। ফিরিয়ে আনলাম। শুশ্রূষা করার চেষ্টা করলাম।’
‘কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি।’
‘হ্যাঁ।’
‘কীভাবে মারা গেল রাব্বানি?’

‘ক্যাম্পের পেছন দিকে একটা ইঁদারা আছে। সেখানে পড়ে মারা গেছে রব্বানি।’
‘মারা গেছে নাকি কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল?’
কমান্ডার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘আপনি একটানা শুধু অনুমানের কথা বলে যাচ্ছেন। এগুলো কোনো কিছুরই নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই।’
‘ঠিক আছে। আমি এবার আরেকটা গুজবের কথা বলব। এটা এই ক্যাম্পের যোদ্ধাদের মুখ থেকে শোনা। ফিরে এসে অদ্ভুত একটা কথা বলছিল রব্বানি। কথাটা শিমুলিয়া ক্যাম্প নিয়ে। আর রুস্তমকে নিয়ে। শুনেছেন সেটা?’
‘শুনেছি।’
‘কী বলছিল রব্বানি?’

‘বলছিল, শিমুলিয়া ক্যাম্পে নির্যাতনে মারা গেছে রুস্তম ও কিবরিয়া। দুজনের কবরই রব্বানিকে দিয়ে খোঁড়ানো হয়েছিল। দুজনকে নিজ হাতে কবর দিয়েছে রব্বানি।’
কর্নেল জোবায়ের এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। বসে ছিলেন তাঁবুর এক কোনায় একটা ফোল্ডিং চেয়ারে। উঠে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

‘এতটা নির্বোধ কী করে হলেন কমান্ডার জব্বার। আপনার চোখের সামনে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ছিল সবকিছু। আপনি কি অন্ধ ছিলেন?’
কমান্ডার জব্বার মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

আমি বলি, ‘এবার আমাদের নিজস্ব কিছু খোঁজখবরের কথা বলি। গত দুদিনে আমাদের লোক দিয়ে আমরা কিছু খোঁজখবর করিয়েছি। মুরাদনগরে। রুস্তমের ব্যাপারে। রুস্তমরা দুই ভাই। রুস্তম আর কাশেম। যমজ দুই ভাই। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় কাশেম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রাগ করে। আর ফিরে আসে নাই। বাবা-মা ভেবেছিল, রাগ পড়লে ফিরে আসবে। কিন্তু আসে নাই। অনেক খোঁজখবর করা হয়েছিল। এ রকম হয় কিন্তু। মিসিং চাইল্ড। কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায় না। তো, রুস্তম আর কাশেমের ব্যাপারটা ছিল, তারা দেখতে হুবহু একই রকম। আইডেন্টিক্যাল টুইন। ডপলগ্যাংগার বলতে পারেন। এটুকু আমরা শুনেছি। আর আরেকটা ব্যাপার শুনেছি। শিমুলিয়া ক্যাম্পে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি রাজাকারদের একটা ছোট স্বেচ্ছাসেবী দল ছিল। সেই দলের কমান্ডারের নাম আমরা পেয়েছি। তার নাম কাশেম। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থ অভিযানের পর থেকে কাশেমের আর কোনো খোঁজ কেউ দিতে পারেনি।’
এটুকু বলে আমি থামি।

কর্নেল জোবায়ের কমান্ডার জব্বারের উদ্দেশে একটা গালি দেন। আমি তাকে থামাই। তাঁকে বেরিয়ে যেতে বলি।

কর্নেল জোবায়ের বেরিয়ে গেলে আমি মুখোমুখি বসলাম কমান্ডার জব্বারের। তাকালাম তাঁর চোখের দিকে। পড়ার চেষ্টা করলাম কিছু।

তারপর বললাম, ‘যা বললাম, সবই অনুমান। সবই কানকথা। কিন্তু কমান্ডার জব্বার, আপনার কি একবারও মনে হয়েছে, আপনার বিবেচনায় কোনো ভুল হয়েছে?’
শিক্ষক চুপ করে থাকেন।

‘এটা এ কারণে বলছি কমান্ডার, এবার যারা আহত হয়ে ফিরে এসেছে, তাদের অন্তত চারজনের শরীরে বুলেট পাওয়া গেছে খুব কাছ থেকে ছোড়া। আর বুলেটগুলো রাশান।’
এটুকু বলে আমি উঠে বেরিয়ে যাই।

আমার জিপ দাঁড়িয়ে আছে স্টার্ট দেওয়া।

রাতের বেলা মাইল দশেক পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে ফিরতে হবে ক্যাম্পে।

যখন রওনা দিয়েছিলাম, তখন যে জটের মধ্যে ছিলাম, এখন জট তার চেয়ে কমেছে বলে মনে হলো না।

আমার জিপ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]