উইটি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী

সৈয়দ মুজতবা আলীকোলাজ: মনিরুল ইসলাম
আজ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিন।

জীবনের সবচেয়ে বিষণ্ন, বিপন্ন ও অস্থির সময়ে যখন সবকিছু অর্থহীনতার ভেতর ডুবে যেতে চায়, তখনই আমি বারবার যাঁর হাত ধরে উঠে আসি স্বাভাবিকতার পাশে, সেই মানুষটা হচ্ছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। জানি না অন্য কারও অনুভূতি কেমন, তবে আমার কাছে মুজতবা আলী মানেই ম্যাজিক। গভীর অনুভূতি, পাণ্ডিত্য, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা আর একই সঙ্গে স্বভাবসিদ্ধ তীব্র উইটের যে সংমিশ্রণ রয়েছে তাঁর লেখায়, বাংলা ভাষায় তা একরকম বিরলই।

সেই যে হরহামেশা ইউরোপ-আমেরিকা যাওয়া লোকটা—ঝান্ডুদা—ইটালির ভেনিস বন্দরে জাহাজ থেকে নেমেছেন, যাবেন লন্ডনে। (ঝান্ডুদার বপুটি যারা দেখেছেন, শুধু তারাই জানেন, যেকোনো জাহাজের পক্ষে তাকে ভাসিয়ে রাখা সম্ভব নয়) বিশাল বপুওয়ালা ঝান্ডুদা সঙ্গে করে বন্ধুর মেয়ের জন্য রসগোল্লা নিয়ে যাচ্ছেন লন্ডনে। কিন্তু বেরসিক কাস্টম অফিসার (চুঙ্গিওয়ালা) কিছুতেই টিনের কৌটায় করে প্যাকেট করা রসগোল্লা নিয়ে যেতে দেবেন না। অগত্যা কী আর করা, সবাই মিলে ভাগাভাগি করে শুরু হলো রসগোল্লা খাওয়া। এদিকে কিছুক্ষণ আগেই ঝান্ডুদার আমন্ত্রণে সবাই মিলে ইটালির বিখ্যাত কিয়ান্তির কয়েকটি বোতল খাওয়া হয়ে গেছে। এবার খাওয়া হচ্ছে রসগোল্লা। কিন্তু চুঙ্গিওয়ালা কিছুতেই রসগোল্লা মুখে দেবেন না, আর ঝান্ডুদা খাইয়েই ছাড়বেন। হঠাৎ একসময় বলা নেই কওয়া নেই, তামাম ভুঁড়িখানা নিয়ে ঝান্ডুদা ক্যাঁক করে পাকড়ে ধরলেন টুঙ্গিওয়ালাকে আর একটি রসগোল্লা নিয়ে থেবড়ে দিলেন ওর নাকের ওপর। ‘চুঙ্গিওয়ালা ক্ষীণ কণ্ঠে পুলিসকে ডাকছে। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে আমার মাতৃভূমি সোনার দেশ ভারতবর্ষের ট্র্যাঙ্কলে যেন কথা শুনছি। কিন্তু কোথায় পুলিস? চুঙ্গিঘরের পাইক বরকন্দাজ, ডাণ্ডা-বরদার, আস-সরদার বেবাক চাকর-নফর বিল্কুল বেমালুম গায়েব! এ কি ভানুমতী, এ কি ইন্দ্রজাল!’

শেষ পর্যন্ত পুলিশের বড়কর্তা এসে পৌঁছালেন। তিনি একটি রসগোল্লা মুখে তুলেই চোখ বন্ধ করে রইলেন আড়াই মিনিট। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ফের। আবার।
‘এবারে ঝান্ডুদা বললেন, “এক ফোঁটা কিয়ান্তি?”
কাদম্বরীর ন্যায় গম্ভীর নিনাদে উত্তর এল, “না। রসগোল্লা।”
টিন তো ভোঁ ভোঁ।
চুঙ্গিওয়ালা তার ফরিয়াদ জানাল।
কর্তা বললেন, “টিন খুলেছ তো বেশ করেছ, না হলে খাওয়া যেত কী করে?” চুঙ্গিওয়ালাকে তিনি আরও বললেন, “তুমি তো একটা আস্ত গাড়ল। টিন খুললে আর ঐ সরেস মাল চেখে দেখলে না?”
এ তো গেল রসগোল্লার রস!’

এ ছাড়াও ‘দেশে বিদেশে’ ভ্রমণকাহিনি পড়ে লেখকের অসংখ্য ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে হতে পেশোয়ার আর আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল তো আমরা প্রত্যেকেই—যারা বইটি পড়েছি—সবাই–ই মনে মনে ঘুরে এসেছি। একটি দেশকে এমন চমৎকারভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তুলে ধরে লেখাকে স্বতন্ত্র ও রসমঞ্জরিময় করে তোলা কেবল মুজতবার পক্ষেই সম্ভব।

কাবুল ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি লিখছেন:
‘আমার পাশের বাড়ীর কর্নেলের মায়ের কান্না, ইস্কুলের কর্নেল-বউয়ের কান্না আরো কত কান্না মিশে গিয়ে অহরহ খুদাতালার তখতের দিকে চলেছে। কিন্তু কেন? কবি বলেছেন,
For men must work
And women must weep
অর্থাৎ কোনো তর্ক নেই, যুক্তি নেই, ন্যায়–অন্যায় নেই, মেয়েদের কর্ম হচ্ছে পুরুষের আকাট মূর্খতার জন্য চোখের জল ফেলে খেশারতি দেওয়া। কিন্তু আশ্চর্য, এ-বেদনাটা প্রকাশও করে আসছে পুরুষই, কবিরূপে। শুনেছি পাঁচ হাজার বৎসরের পুরানো বাবিলনের প্রস্তরগাত্রে কবিতা পাওয়া গিয়েছে—কবি মা-জননীদের চোখের জলের উল্লেখ করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’

বুঝুন তাহলে অবস্থাটা। আবারও সেই যুদ্ধ! আর সেটা একজন পুরুষ লেখকের বর্ণনায় এমন কঠিন সত্যকে আশ্চর্য রসবোধের সঙ্গে তুলে ধরা—মুজতবা আলী ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব কি না, কে জানে!

আবার, কাবুল পর্বতের চূড়ায় সমাহিত মোঘল সম্রাট বাবুরের সমাধি দেখে তিনি বর্ণনা করেছেন:
‘ইংরেজি “সার্ভে” কথাটা গুজরাতিতে অনুবাদ করা হয় “সিংহাবলোকন” দিয়ে। “বাবুর” শব্দের অর্থ সিংহ। আমার মনে হলো এই উঁচু পর্বতের উপর বাবুরের গোর দেওয়া সার্থক হয়েছে। এখান থেকে সমস্ত কাবুল উপত্যকা পুরবে ভারতমুখী গিরিশ্রেণী, উত্তরে ফরগনা জাবার পথে হিন্দুকুশ, সব কিছু ডাইনে–বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সিংহাবলোকনে দেখছেন সিংহরাজ বাবুর।’

এমন সব রসাত্মক বাক্যবিন্যাসে ভরপুর লেখা পড়তে পড়তে পাঠক হিসেবে আমরা হারিয়ে যাই অন্য কোনো আনন্দের রাজ্যে। অথচ বাস্তবে মানুষ হিসেবে তখন হয়তো আমি আছি ভিন্ন কোনো পরিবেশে, জীবনযন্ত্রণার ভেতরে। জীবনের এই সব যন্ত্রণা থেকে মুজতবা আমাদের ক্ষণে ক্ষণে উপশম দেন।

একইভাবে তাঁর ‘চতুরঙ্গ’, ‘ভবঘুরে ও অন্যান্য’, ‘পঞ্চতন্ত্র’ কিংবা মনে পড়ে ‘চাচাকাহিনী’র ‘বেঁচে থাকো সর্দিকাশি’র সেই বিখ্যাত প্রবাদটির কথা, ‘ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাতদিনে আর না খেলে এক সপ্তাহে।’ আদতে মুজতবার লেখার কথা মনে হলে কত কিছু মনে পড়ে! ‘দেশে বিদেশে’, ‘হিটলারের প্রেম’, ‘বড়বাবু’ কি ‘জলেডাঙ্গায়’—আকারে ক্ষুদ্র অথচ অনবদ্য এসব গদ্য পড়তে পড়তে কোথায় যে হারিয়ে যেতাম, কে জানে? তাঁর লেখার, তাঁর বর্ণনার ছবিগুলো আজও দেখতে পাই মনের চোখে। কায়রোর টংঘরে গিয়ে এক কোণায় বসে চা খেয়ে খেয়ে এবং আড্ডাবাজ মিসরীয়দের জটলার দিকে বুভুক্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে থেকে একদিন আড্ডার প্রাণবিন্দু হয়ে যাওয়ার সেই গল্পের কথা ভেবে কতবার ভেবেছি, মিসরে গিয়ে ওসব টংঘরে চা খেতে হবে...

আবার ‘তোতা কাহিনী’র সেই বুদ্ধিমান ভারতীয় তোতা, যে কিনা তার ইরানি সদাগর মালিক ভারতে যাচ্ছে শুনে সেখান থেকে একটি সওগাত আনতে বলেন, সেটা হচ্ছে খাঁচা থেকে তার মুক্তির উপায় কি? সদাগর ভারতের বনে এসে একঝাঁক তোতাপাখি দেখে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তোমাদের এক বেরাদর ইরান দেশের খাঁচায় বদ্ধ দিন কাটাচ্ছে। তার মুক্তির উপায় বলে দিতে পার?’ কথাটি শুনে তৎক্ষণাৎ একটি পাখি মরে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ইরানে এসে তোতাকে খবরটি দেওয়া মাত্র তোতাও লুটিয়ে পড়ল একইভাবে। এ ঘটনায় সদাগর তো কেঁদেকেটে একশেষ। কী আর করার? মরা তোতাকে যেই না আঙ্গিনায় ছুঁড়ে ফেললেন, সেই তোতা উড়ে গিয়ে গাছে বসল আর ভারতের তোতার মরার অভিনয়ের কথা খুলে বলল।

এসব তো গেল বুদ্ধি আর রসবোধের গল্প। কিন্তু প্রেম?
প্রেমের আকুতি, অনুভূতি, গভীরতা আর প্রেম পেয়ে হারানোর বেদনার যে ধ্রুপদি বর্ণনা আমরা দেখেছি ‘শবনম’–এ, তার কি কোনো তুলনা আছে? আর টুনিমেম? সাঁওতাল মেয়ে টুনিমেম চা বাগানের ম্যানেজার ইংরেজ সাহেব ও’হারার বাড়ির কাজকর্ম করে দেয়। কিন্তু নিঃসঙ্গ ইংরেজ সাহেব ও’হারা টুনিমেমকে রেখেছিল রানির সম্মান দিয়ে আর টুনি মেম ও’হারাকে ভালোবেসেছিল লাইলি যেভাবে মজনুর প্রতি নিবেদিত ছিল, অনেকটা সেভাবেই। কিন্তু গ্রামের অশিক্ষিত, মূর্খ, সাম্প্রদায়িক মানুষগুলো এমন স্বর্গীয় প্রেম মানবে কেন? নানা ফন্দিফিকির করে ও’হারাকে জেলে ঢুকিয়ে টুনিমেমকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল তারা।

‘শবনম’–এর প্রেমকাহিনি পাঠককে ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যায়।
এবার আসি সেই নিদারুণ প্রেম-ঘৃণা-নৃশংসতার অবিশ্বাস্য গল্পটিতে। সত্যিই, একেবারে অবিশ্বাস্য সেই কাহিনি। আইরিশম্যান ডেভিড ও-রেলি মহাকুমা শহর মধুগঞ্জে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ হিসেবে জয়েন করার পর থেকেই দলে দলে নারী এসে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগল তার ওপর। প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগল নানা বয়সের, নানা জাতির নারীরা। এদিকে ও-রেলি প্রথম দর্শনেই ইংরেজ মেমের প্রেমে পাগল হয়ে তাকে বিয়ে করে মধুগঞ্জে এনে তুলল। কে জানত ও-রেলি ইম্পোটেন্ট? ভীষণ উচ্ছল হুল্লোড়প্রিয় তাগড়া জোয়ান ও-রেলিকে বিয়ের কয়েক দিনের মাথাতেই দেখা গেল সব সময় চিন্তিত, বিষণ্ণ হয়ে চুপচাপ প্রাণহীন অবস্থায় বসে আছে। এদিকে অনন্ত যৌবনা, অপূর্ব সুন্দরী মেমসাহেব, রাতের পর রাত স্বামীর সাথে অভিসারে ব্যর্থ হয়ে, মেমসাহেব ভোরবেলা গিয়ে পড়ল মদখোর মাতাল বাটলার জয়সূর্যের পায়ে।

এভাবে মেম একদিন বাটলারের সন্তানের মা হলেন। কিন্তু ও-রেলি কেন এত বড় অপমান সহ্য করবেন? বহু বছর অপেক্ষা করে, দিনরাত সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে কোনো একদিন তিনি আর অপেক্ষার জ্বালা সহ্য করতে পারলেন না। একদিন ঠান্ডা মাথায় রাতের আঁধারে ও–রেলি জয়সূর্য, তার সন্তান ও মেমকে একসঙ্গে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রাখলেন। আর নিজেই নিজের এপিটাফে লিখে রাখলেন:
‘Here lies the carcass of a cursed sinner,
Doomed to be roasted for the Devil’s dinner’—Devid O-rely
অসাধারণ রসবোধ ও বাকবৈদগ্ধ্যের অধিকারী সৈয়দ মুজতবা আলীর গদ্য, গল্প–উপন্যাস পড়ে ঋদ্ধ হননি পাঠক, অন্তত বাংলা সাহিত্যে হয়তো পাওয়া যাবে না। তাঁর ভাষার কারুকার্যে মুগ্ধ পাঠক হিসেবে আজ তাঁর জন্মদিনে রসরাজের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]