উপন্যাসে নজরুল-জীবন

কাজী নজরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

কবি নজরুলের ঝোড়ো ও বর্ণিল জীবন নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। কথাশিল্পী বিশ্বজিৎ চৌধুরী দুটো উপন্যাসের অবয়বে নজরুল-জীবনের দুই অনিবার্য নারী নার্গিস ও ফজিলাতুন্নেসাকে নিয়ে উপন্যাস রচনা করে তাঁদের সূত্রে প্রেমিক নজরুলকেও নতুন করে উপস্থাপন করেছেন পাঠকের দরবারে। প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস নার্গিস (প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ষষ্ঠ মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১৯) এবং কবি ও রহস্যময়ীর  (জানুয়ারি ২০২০) পাতায় পাতায় ধরা আছে দুই ভুবনের দুই বাঙালি নারীর জীবনের সঙ্গে গাঁথা নজরুল-জীবনের সুবাসিত মালা; যে মালার ফুলগুলো কালের ধুলো পেরিয়ে শাশ্বত প্রেমের রূপ-রসে আজও অমলিন।

নার্গিস-এর ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘নজরুলের জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করেছিল এক নারী। এই একটি তথ্যই কৌতূহলী করে তুলেছিল আমাকে। তাঁর প্রথম প্রেম নার্গিস। মিলনের পূর্ণতা পায়নি এই প্রেম। সেই হাহাকার উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর গানে-কবিতায়।’

আজ থেকে ১০০ বছর আগে কুমিল্লার দৌলতপুরের এক পল্লিবালার প্রেমে পড়েছিলেন কবি। প্রেম একসময় পরিণয়ের দিকে গড়ালেও বৈরী বাস্তবতায় নজরুল-নার্গিস ছিটকে পড়েন দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্বে। নার্গিস নজরুল-বিরহের অনলে পুড়ে ছাই হন কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যান না। বেদনার বালুচর তাঁকে জীবনের নতুন অর্থ শেখায়; যার সাক্ষ্য বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাসে বিধৃত। লেখাপড়া শিখে প্রথমে নীতিশিক্ষার বই রচনা করে অগ্রসর হন উপন্যাসের জমিনে। একে একে প্রকাশিত হয় নার্গিসের লেখা উপন্যাস তহমিনা, ধূমকেতু আর পথের হাওয়া। ইতিহাসখ্যাত সোহরাব-রুস্তমের কাহিনির অংশবিশেষ অবলম্বনে বীর যোদ্ধা রুস্তমের জন্য তহমিনার অনন্ত অপেক্ষাকে উপন্যাসের সীমানায় ধরতে চাইলেন নার্গিস। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ভাষায়, ‘সবার অজান্তে একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করে নার্গিস। লিখতে লিখতে নিজেই অবাক হয়ে যায়, কার কথা লিখছে সে? তহমিনা? কেন সেখানে আঁকা হয়ে যাচ্ছে অন্য একটি মুখ, অন্য কোনো বেদনার ভাষা?’

নজরুলের জীবন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বাংলার এক সাধারণ নারী নার্গিসকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন অনেকেই। নার্গিস নিজে হয়তো তাঁর সমকাল এবং অনাগত কালের নিন্দামন্দ নিয়ে সচেতন ছিলেন। তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস তহমিনার ভূমিকাকে বিশ্বজিৎ চৌধুরী নার্গিস উপন্যাসে প্রতিস্থাপন করেন সংগতভাবে, ‘পাঠক, তোমরা যে কেহ তহমিনার দুঃখ জাগানিয়া কাহিনি পড়বে, তার দুঃখে দুফোঁটা অশ্রু ফেলো যেন তাতেও জনম দুঃখিনী তহমিনার সান্ত্বনা হয়। আর তার মতো দুঃখিনী যদি কখনো কাহারো নজরে পড়ে, তাকে মানুষের চোখ দিয়ে দেখো যেন।’

নার্গিস নজরুলের দেওয়া নাম। ফুলের নামে নাম যে নারীর, নজরুলের জীবনে তিনি কতটা প্রভাবক ছিলেন, তা নজরুলের পত্রভাষাতেই তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে, ‘তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি “অগ্নিবীণা” বাজাতে পারতাম না—আমি “ধূমকেতু”র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।’

গোমতীর তীরে, পাতার কুটিরে সাঁঝের বেলা নজরুলের জন্য পথ চেয়ে থাকা নার্গিসের ব্যাকুলতাকে ঠিক এভাবে অক্ষরবন্দী করেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ‘বহুকালের ওপার থেকে ভেসে আসা একটা অদ্ভুত করুণ বাঁশির সুর যেন লাগে কানে। রাতের গভীর নির্জনতা ভেঙে সেই সুর এসে ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এক নওল কিশোরীর।’ কবির ঘুমঘোরে আসা মনোহর-নার্গিস এভাবে পাঠকহৃদয় জয় করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী-বিস্ময়, প্রথম বাঙালি মুসলিম গ্র্যাজুয়েট, গণিতবিদ ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক-আখ্যান কবি ও রহস্যময়ী। নজরুল ও ফজিলতের সূত্রে সেকালের বাঙালি মুসলিম সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি—সবই ছবির মতো উদ্ভাসিত এখানে। আর এ দুজনের সম্পর্কসূত্র হিসেবে এক বিশেষ চরিত্র বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা কাজী মোতাহার হোসেনও। বন্ধু মোতাহারকে লেখা চিঠিতেই যেন স্পষ্ট ফজিলতের প্রতি কবির হৃদয়ের দোলাচল, ‘আমার কেবলি সেই হতভাগিনীর কথা মনে পড়ছে—যার ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে “ডিউটিফুল” আর পায়ের তলায় প্রস্ফুটিত শতদলের মতো “বিউটিফুল”।’

ফজিলতের প্রতি নজরুলের রাগ-অনুরাগের সাক্ষ্য হয়ে উপন্যাসে ভাস্বর হয়ে রইল ঢাকা ও কলকাতা, বুদ্ধির অগম্য হৃদয়ের ভাষা যেন অনূদিত হতে লাগল নজরুলের কবিতা ও গানের খাতায়। অন্যদিকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ফজিলতের বিলেত যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল ধর্মীয়-সামাজিক রক্ষণশীলতা। অবশেষে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের আন্তরিক প্রয়াসে তাঁর বিলেত যাওয়ার বন্দোবস্ত হলো। বিলেত যাওয়ার আগে এক বিকেলে কলকাতার সওগাত অফিসে এক সংবর্ধনা সভার অনন্য বিবরণ দেওয়া হয়েছে কবি ও রহস্যময়ী উপন্যাসে। সওগাত-এর বড় হলঘরে আমন্ত্রিত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রত্যাশা ছিল, বিলেত থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে ফজিলত তুরস্কের খালেদা এদিব খানুমের মতো দেশ ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করবেন। অন্য বিশিষ্টদেরও বহু প্রত্যাশা ও প্রশংসা। আর নজরুল? উপন্যাসের পাতায় যেন আঁকা সেই বিকেলের এমন ছবি, ‘প্রশংসায় ভেসে যাচ্ছিল ফজিলত, বড় দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে তার ক্ষীণ কাঁধটিকে ভারী করে তুলেছিলেন বক্তারা। এ সময় হঠাৎ বড় এক চমকের মতো নজরুলের নাম ঘোষণা করলেন নাসিরউদ্দীন সাহেব। কবি গুরুগম্ভীর বক্তব্যের দিকে না গিয়ে গেয়ে উঠলেন গান, ফজিলতকে উদ্দেশ করে সদ্যরচিত একটি গান, “জাগিলে পারুল কি গো সাত ভাই চম্পা ডাকে।/ উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে”।’

কবি ও রহস্যময়ী উপন্যাস এমন বহু কালো মেঘের বিদ্যুৎ চিরে নজরুল-জীবনে জাগা প্রেম-চাঁদের ইশারাবাহক যেন।

নজরুলের বাঁধনহারা জীবন ঘিরে কুহেলিকার শেষ নেই যেন, তবে দুই ভুবনের দুই নারী নার্গিস ও ফজিলাতুন্নেসা তাঁর জীবনকে ভেতর থেকে যে রূপে রূপে দীপান্বিত করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ বা সংশয় নেই কোনো। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাসদ্বয়ে সেই প্রেমিক নজরুলের অসামান্য প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে, কালের প্রহারেও যার মৃত্যু নেই কোনো।