ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা: নারী–কথন, রবীন্দ্রবোধ ও মৃত্যুর প্রস্তুতি

আজ চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষের জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা।

বাবা চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন বলেই ঋতুপর্ণ ঘোষ চলচ্চিত্রে এসেছেন, এমন সাধারণীকরণ বোধ করি সঠিক নয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তো অর্থনীতি বিষয়ে পড়ছেন, কিন্তু অর্থনীতি পাঠনির্ভর কোনো পেশায় নিয়োজিত হননি। যেমন একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে উঠেও হননি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বাহক। উপরন্তু খোদ পুরুষ হিসেবে জন্মেও শরীরে-মনে যেভাবে নারীসত্তাকে বরণ করে ছিলেন, তা কোনো সামান্য ব্যাপার নয়। এটা তাঁর স্বাতন্ত্র্য। তাঁর সংগ্রাম আর স্বপ্নের সম্মিলন। করুণা নয়, ভালোবাসা। সিনেমায় বারবার ফিরিয়ে এনেছেন মুক্তিমুখীন নারী চরিত্র। নারীসত্তাকে আলিঙ্গনের তীব্র অভিলাষের মাধ্যমে তিনি নিজেও সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর নারী চিত্রায়ণ এমন হয়েছে, মনে করা যেতে পারে। তথ্যের খাতিরে জানিয়ে রাখা যায়, তাঁর মা ছিলেন একজন শিল্পী এবং ভাই শিল্প নির্দেশক।
ঋতুপর্ণ ঘোষের আবির্ভাব টালিগঞ্জের একটা বিশেষ সময়ে, যখন বাঙালি দর্শক আর গড়পড়তা হলমুখী নন, বরং বিশেষ কোনো পরিচালকের সিনেমা এলে বিবেচনা করেন। বাংলা সিনেমার সমৃদ্ধি উপচে আসছে তারকানির্ভর চটকদারিতে ভরা বলিউড সিনেমার শাসন। একঘেয়ে গল্প আর অতিশয় বাজারমুখীন ধারার পৌনঃপুনিকতায় টালিগঞ্জের সিনেমা তখন আচ্ছন্ন। ফলে সিনেমার আলো–ঝলকানিতে দর্শকের মুখ ঝলসে যায়, কিন্তু মগজে আর মনে কোনো ক্রিয়া জাগে না। এর বিপরীতে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল সিনেমার ধারাবাহিকতা ছিল। এই ধারাবাহিকতা ঠিক সিনেমাক্রম নয়, বরং কিছু শক্তিমান চলচ্চিত্রকারের কারণেই চলে আসছিল। তাঁরা ধারাবাহিক ভালো সিনেমা উপহার দিয়েছেন বলেই তা সম্ভব হয়েছে। এ ধারা অবশ্যই সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক কুমার ঘটকের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল; পরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন ও গৌতম ঘোষ নিজেদের মতো করে সেটা এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু নব্বই দশকের শুরুতে পরিবর্তিত নগর কলকাতায় তা খানিকটা স্তিমিত হয়ে আসে। সেই ধারায় গতি ও শক্তি সঞ্চারণের জন্য প্রয়োজন ছিল কষে এক ধাক্কা। ঋতুপর্ণ অবশ্যম্ভাবীভাবে সেই কাজটা করেছেন—প্রয়োজনকে অতিক্রম করে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, দোলাচল দূর করে দৃঢ়তার ভিত্তিতে। যেসব ভাবনা মানুষের মনে ছিল, সৃষ্টিশীল চিন্তায় ছিল, কিংবা যা ভেবেছেন কিন্তু প্রকাশের ভাষা পাচ্ছিলেন না, তিনি তা-ই প্রকাশ করে দেখালেন। সেই প্রকাশে সৃজনশীল ভাষাও যে কতটা সাবলীল হতে পারে, তা–ও দেখালেন, যে কারণে তাঁর সিনেমায় চরিত্রের বক্তব্য যেন কথা প্রসঙ্গে কথা, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত ও তীক্ষ্ণ।

১৯৯২ সালে মুক্তি পায় ঋতুপর্ণের প্রথম চলচ্চিত্র ‘হীরের আংটি’, তাঁর একমাত্র শিশুতোষ চলচ্চিত্র। সম্প্রতি আবিষ্কৃত হলো তিনি আরও শিশুতোষ চলচ্চিত্র করতে চেয়েছিলেন। এর ঠিক দুই বছর পর প্রকাশ পায় ‘উনিশে এপ্রিল’। অনেকে এটাকে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করতে আগ্রহী। ২০১২ সালে মুক্তি পায় মৃত্যুপূর্ব তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘চিত্রাঙ্গদা’। মাঝে দুই দশক তাঁর সৃষ্টিকাল। এর মধ্যেই সম্পন্ন করেছেন ১৯টি চলচ্চিত্র। সমাজের দ্বন্দ্ব, গৃহ–সম্পর্কের অলিগলিকে ক্যামেরায় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। তাতেই কলকাতার তরুণেরা নতুন করে চলচ্চিত্র ভাবনার উৎসাহ পেয়েছেন। তবে আক্ষেপ এই, এখন পর্যন্ত তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী দেখা যাচ্ছে না। সেটাই শূন্যতা। যাবে হয়তো। কিন্তু ঋতুপর্ণরা আসলে অনেক কাল পরপর জন্মান। সেখানে ১৯টি চলচ্চিত্র থেকেই ১২টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।

‘রেইনকোট’ ছবির দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

দুই.
চলচ্চিত্রায়ণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নৃত্যের প্রতি ঋতুপর্ণ ঘোষের বিশেষ দুর্বলতা চোখে পড়ে। রবীন্দ্রসাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণের চেষ্টা তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় শুরু হয়। সত্যজিৎ রায়ের হাতে তা সার্থকতা পায়। শেষে যুক্ত হয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। মাঝে কিছু চেষ্টা হলেও তা উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেনি। অবশ্য সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গানের বহুল ব্যবহার বরাবরই ছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অগাধ প্রীতিবোধ থেকে তৈরি করেন ‘জীবনস্মৃতি’ (এ নামে বরীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীও আছে) নামে তথ্যচিত্র। রবীন্দ্রনাথের নিঃসঙ্গতার মাঝেও যে রঙের বৈচিত্র্য, তা তাঁকে টানত। ঋতুপর্ণের ব্যক্তিজীবনও ফুটে ওঠে সিনেমার চরিত্রের মধ্যে।

তিনি মূলত রবীন্দ্রসাহিত্যকেই চলচ্চিত্রের রসদ হিসেবে বেছে নেন। এ ক্ষেত্রে ঋতুপর্ণের সৃজনশীল সংযোজন কোথায়? এটা বোধ হয় নারী চরিত্র চিত্রায়ণে। রবীন্দ্রনাথের নারী চিত্রায়ণ তাঁর ভালো লাগত। এর সঙ্গে ঋতুপর্ণ যোগ করেছিলেন নারীর প্রতি আস্থা। তাই রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্র তাঁর উপস্থাপনায় আরও দীপ্তি ও তেজ নিয়ে হাজির হয়েছে। আর এখানেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষের পার্থক্য। সত্যজিতের সিনেমায় রবীন্দ্রের নারীরা অনেকটা ম্লান ও বিবর্ণভাবেই থেকেছে। ঋতুর নারীরা এ ক্ষেত্রে প্রাণবন্ত ও মুক্তিমুখীন। রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো কবিতা বা গান ঋতুপর্ণের সিনেমায় এতটা সঞ্জীবনী হয়ে এসেছে, তা আর কোনো চলচ্চিত্রকারের কাছেই আসেনি।

নৃত্যের প্রতি ঋতুপর্ণের বিশেষ দখল ও ঝোঁক ছিল। ‘উনিশে এপ্রিল’ ও ‘চিত্রঙ্গদা’য় নৃত্যপটীয়সী নারীর চরিত্র দেখা যায়। সিনেমার আবহ সংগীতে নৃত্যপ্রধান বাজনা ও ঘুঙুরের প্রাধান্য হয়তো তারই প্রতিফলন। ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্রের আরেকটি বিশেষ দিক হলো গানের ব্যবহার। প্রায়ই দেখা যায়, পুরো সিনেমায় একটি গানই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাত্রায় বাজছে। বিশেষ একটি গানের হৃদয়স্পর্শী উপস্থাপন। এই বিশেষত্ব হচ্ছে দৃশ্য ও প্রসঙ্গে আন্তসংযোগ, যা চরিত্রের মনোভাব ও কাহিনির গতিকে নির্দেশ করে। ফলে পুরো চিত্রায়ণ হয়ে ওঠে একটি গান, কিংবা একটি গানের সুলেল চিত্রায়ণই তাঁর চলচ্চিত্র। তাঁর চলচ্চিত্রায়ণ ও কাহিনি বিন্যাস এতটাই সমৃদ্ধ ধারায় এগিয়ে যায় যে তিনি গানের সংযোজন না ঘটালেও সচেতন দর্শক মন থেকে ঠিক সেই সময়ে ওই গান গেয়ে উঠতেন। অন্য কথায়, তিনি মনের অবগাহন থেকেই গানটি উঠিয়ে আনেন। অনেকটা দক্ষ শিল্পীর মতো ক্যানভাসে তুলি চালান কিন্তু ছবি মূর্ত হয়ে ওঠে দর্শকের চোখে, কিংবা বৈঠকি কথকের মতো তিনি কেবল কাহিনিবিন্যাস করেন, কিন্তু গল্প লতিয়ে ওঠে পাঠকের মনে।

চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ
ফাইল ছবি

তিন.

ভারতবর্ষ কিংবা এর সাবেক ঔপনিবেশিকদের কাছে কলকাতা ও বাঙালির পরিচয় রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে। ফলে নগর কলকাতার চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক স্লোগানের প্রতিফলন নানা সময় দেখা যায়। ঋতুপর্ণের ছবিতে রাজনীতির চিত্র—মাঠের বা রাজপথের সরব রাজনীতি—তেমন আসেনি। তবে গৃহের অভ্যন্তরে রাজনীতি যে কাজ করে, সেসব নারীকে কীভাবে সাহসী করে বা নিয়ন্ত্রণ করে, তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। সমাজে রাজনীতির ক্রিয়া কী, কোন রাজনীতি বিদ্যমান থাকার ফলে সমাজ-পরিবার-ব্যক্তি পচে ভুসভুসে হয়ে যায়, তার ইশারা সমঝদার দর্শকের চোখ এড়িয়ে যায় না। সেখান থেকে তার আদর্শিক তথা মুক্তির রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা ও আবশ্যিকতা মূর্ত হয়ে ওঠে। রাজনীতির দল বা দখল বদলালে নীতিবদল না হওয়ার ফলে নারীর যে মুক্তি হয়নি, তা তিনি তুলে ধরেছেন। যেমন ব্রিটিশ উপনিবেশ (‘অন্তর মহল’), ব্রিটিশ উত্তর সময় (‘চোখের বালি’), আজকের দিনে নারীর (‘দহন’) জীবনের অপরিবর্তনীয়তা চিত্রণ দেখা যায়। আর এই আটকে থাকা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভাঙার প্রয়াসে নারী জীবনের কথক হয়ে উঠেছেন ঋতুপর্ণ। তা ছাড়া তিনি ভুলে যান না, ধর্মও কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে নারীকে। কিন্তু তা থেকে উত্তরণে তথাকথিত ‘নারীবাদী’ আচরণও দেখা যায় না তাঁর মধ্যে, বরং তিনি হন সমাজমুখী। তিনি আস্থা ও শক্তির উৎসাহ পান বয়স্কা নারীদের কাছ থেকে। ভুল করতে করতে ভুলের পালা ফুরাবে, এবং সঠিকটা হবেই। এতেই তাঁর আস্থা।

সব কটি সিনেমায় নারী চরিত্র বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে হাজির হয়েছে। তবে নারীর প্রতি পক্ষপাতি না হয়ে বরং সমাজমুখীভাবে তাকে বিশ্লেষণের প্রয়াসই বেশি দেখা যায়। আর নারীর বর্তমান অবস্থা পেছনের সমাজে চলমান অবস্থার যে অনুঘটকের কাজ করে, তা–ও তুলে ধরেছেন ঋতুপর্ণ। একটি বিশেষ মুহূর্তের অঙ্গভঙ্গি বা কথা দিয়েই মনের সামগ্রিক অবস্থাকে তুলে ধরার পারদর্শিতা তাঁর সিনেমার আরেকটি দিক। যেমন ‘দহন’ সিনেমায় আক্রান্ত নারীকে বাঁচাতে স্কুটার থেকে শিক্ষিকা নেমে যাওয়ার আগে তাকে বাধা দিয়ে পুরুষদের কথাবার্তা। অথবা ‘অন্দরমহল’ সিনেমায় জমিদারের নায়েবের বলা যে ‘ব্রাক্ষ্মণদের শোয়ার ঘরে ঢোকানোই ভুল হয়েছে’—এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রে ধর্মের ব্যবহার সম্পর্কেও হুঁশিয়ারি পাওয়া যায়। আরও স্পষ্টভাবে বললে তাঁর সিনেমায় রাষ্ট্রে নারীলৈঙ্গিক রাজনীতির চিত্রায়ণ দেখা যায়। ঋতুপর্ণ স্মরণ করিয়ে দেন ‘চিত্রাঙ্গদা’য় শেষের দিকে সমুদ্রতীরের ভোরের আলোয় একটি সংলাপে, ‘কোনো রূপান্তরই সম্পূর্ণ নয়, পদ্ধতিটা চলতেই থাকে।’

বিস্ময়জাগানিয়া দিক হলো একটি সিনেমায় একাধিক নারীর সমান্তরাল চারিত্রিক উপস্থিতি। বিশেষত ‘উৎসব’ সিনেমায় প্রত্যেকের চরিত্র-ভাষা-চিন্তা-ব্যক্তিত্ব নির্মাণে ঋতুপর্ণের কোনো ঘাটতি ছিল না। তাঁর সিনেমাগুলো দিয়ে একটি শিকল তৈরি করা যায়। প্রতিটি চরিত্র পূর্ণাঙ্গ ও দ্বিতীয়জনের সঙ্গে যুক্ত। আবার তৃতীয়জনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও গাঁথুনিতে তারা সমান্তরাল। বিশেষত তাঁর সব চলচ্চিত্রের একটা অন্তর্নিহিত যোগাযোগ আছে। আবার জোড় বেঁধেও এগিয়ে গেছে। যেন একের মধ্যে নয়, বহুর মধ্যে এক আছে।

‘চোখের বালি’ ছবির দৃশ্য
ফাইল ছবি
ঋতুপর্ণ অবশ্যম্ভাবীভাবে সেই কাজটা করেছেন—প্রয়োজনকে অতিক্রম করে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, দোলাচল দূর করে দৃঢ়তার ভিত্তিতে। যেসব ভাবনা মানুষের মনে ছিল, সৃষ্টিশীল চিন্তায় ছিল, কিংবা যা ভেবেছেন কিন্তু প্রকাশের ভাষা পাচ্ছিলেন না, তিনি তা-ই প্রকাশ করে দেখালেন। সেই প্রকাশে সৃজনশীল ভাষাও যে কতটা সাবলীল হতে পারে, তা–ও দেখালেন, যে কারণে তাঁর সিনেমায় চরিত্রের বক্তব্য যেন কথা প্রসঙ্গে কথা, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত ও তীক্ষ্ণ।

চার.

ঋতুপর্ণের সিনেমার পাত্রপাত্রীদের নির্বাচন লক্ষণীয়। একজন অভিনেতাকে ঘিরে পুরো স্ক্রিপ্ট তৈরির ঘটনা অনেক আছে। ঋতুপর্ণের পাত্রপাত্রী চয়ন হয়েছে চরিত্রঘনিষ্টভাবে, যে কারণে তাঁর সিনেমায় যেমন শক্তিমান অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি অধিক, তেমনি যীশু সেনগুপ্তের শক্তিশালী ব্যবহারও দেখা যায়। বলতে গেলে প্রসেনজিতের যে শিল্পীর অভিধা, তা ঋতুপর্ণই পোক্ত করেছেন। আর যীশু সেনের অভিনয়ের যে সামর্থ্য, ঋতুপর্ণই তা আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন। অনেকে একে সত্যজিৎ রায়ের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আবিষ্কারের মতো মনে করেন।

বলিউড তারকা দিয়ে অভিনয় করানো চরিত্রগুলো কি টালিউডি অভিনেতারা করতে পারতেন না? এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বিশেষ করে তাঁদের দিয়ে অভিনয় করানোর পরও ডাবিং করে কণ্ঠ বদলে দেওয়ার মধ্যে ওই তর্ক সামনে চলে আসে। এর একটা কারণ হতে পারে তাঁর চলচ্চিত্র পুরস্কারগুলো। তাঁর প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলো সিনেমা পাড়ার মহার্ঘ্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারকে প্রায় অনায়াসসাধ্য করে ফেলেছিল। ঋতুপর্ণের সিনেমা মানেই কোনো না কোনো জাতীয় পুরস্কার। ফলে বলিউডি অভিনেতারা নানাভাবেই চেষ্টা করেছেন তাঁর সিনেমায় অভিনয় করার জন্য। যেমন প্রচারিত আছে, অমিতাভ বচ্চনকে সিনেমায় নেওয়ার জন্য সত্যজিৎ রায়কে স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী নিজে ফোন করে অনুরোধ করেছিলেন। অমিতাভ তখন বলিউড সুপারস্টার। সত্যজিৎ তবু বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, আমি যে সিনেমা করি, তাতে অমিতাভ বচ্চনের মতো তারকার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ তা পারেননি।
অভিনেতাও চান তারকাখ্যাতির সঙ্গে অভিনেতা বা শিল্পীর মর্যাদা পেতে; একজন পরিচালক যেন তাঁকে আবিষ্কার ও উপস্থাপন করতে পারেন। সেদিক দিয়ে ঋতুপর্ণের সিনেমায় বলিউডের তারকাদেরও অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, যে কারণে মুম্বাই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাঁকে ঘিরে বলিউডিদের আগ্রহ কম ছিল না। সেদিক দিয়ে ঋতুপর্ণের প্রথম দশকের চলচ্চিত্রের বিবেচনায় শাবানা আজমি, নাসির উদ্দিন শাহ, দীপ্তি নাভালের (যাঁর সঙ্গে পরে অভিনয় করেছেন) নাম প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘হীরের আংটি’ নিয়ে চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটির তৎকালীন চেয়ারপারসন জয়া বচ্চনের সঙ্গে পরিচয়সূত্রে তিনি বচ্চন পরিবারের খানিকটা ঘানি টেনেছেন বললেও অত্যুক্তি হবে না বোধ হয়। বরং তারকাবহুল সিনেমা করা তাঁর চশমার ফ্রেম বদল, বিস্তর সিডি সংগ্রহ, পাগড়ি-গহনা বেসাতি কিংবা অভিনব পোশাকে মানুষকে চমকে দেওয়া, এফিমিক শরীরে লাইপোসাকশন করে লিঙ্গবদলের মতো খেয়ালিপনা সঙ্গে যুক্ত কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। শেষের দিকে তাঁর বিতর্কপ্রিয় হয়ে ওঠার কথা শোনা যায়।

শুটিংয়ে অর্জুন রামপালের সঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষ
ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ.

অনেকে মনে করেন, সত্যজিৎ রায় ও বার্গম্যানের ছায়া আছে ঋতুপর্ণের সিনেমায়। কেউ কেউ আকিরা কুরাসাওয়ার প্রসঙ্গও তোলেন। তিনি নিজেও তা কবুল করেছেন কোনো কোনো আলাপে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে প্রথম পার্থক্য হলো, ঋতুপর্ণ তাঁদের মতো মহাকাব্যিক নন, সামাজিক সমস্যার দার্শনিক সংকট অন্বেষণ ও সমাধানের দার্শনিকতায় তিনি পৌঁছতে চান না। বরং তিনি অনেক বেশি নাগরিক। নাগরিক সমস্যার নান্দনিক সমাধানে তাঁর নায়িকারা তৃপ্ত হয়। দ্বিতীয় পার্থক্য হলো, সত্যজিৎ বা বার্গম্যান চরিত্রের প্রয়োজনে অভিনেতাকে গড়েপিঠে নিয়েছেন। এক ঋতুপর্ণকে বাদ দিলে, ঋতুপর্ণ চরিত্রের প্রয়োজনে অভিনেতাকেই নির্বাচন করেছেন। অনেক সময় তারকা দিয়ে চরিত্রের ঘাটতি পূরণের চেষ্টাও চোখ এড়ায় না। তবে দৃশ্যমান দূরত্ব হলো, তাঁরা কেউই চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আগ্রহী হননি, ঋতুপর্ণ কিন্তু তা নন। এসব যেমন তাঁর সিনেমাকে আলাদা করে, তেমন সিনেমাটোগ্রাফিরও বিন্যাস করে। সেদিক দিয়ে ঋতুপর্ণের সিনেমাকে বুদ্ধিবৃত্তিকের চেয়ে বেশি নান্দনিকই মনে হয়।

মোটাদাগে সিনেমা সমালোচকেরা ঋতুপর্ণের দুই দশকের সিনেমাকে তিন ভাগে বিন্যাস করেন। ১. প্রথম দশকের দর্শকনন্দিত সিনেমা, যা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তোলে। ২. দ্বিতীয় দশকের শুরুতে বলিউড স্টারভর্তি সিনেমা তৈরি এবং ৩. শেষে নিজেকে অভিনয়ে নিবেদন করা। ১৯৯২-২০০২, এই সময়ে ‘হীরের আংটি’ থেকে ‘শুভ মহরৎ’—মোট নয়টি সিনেমার পাঁচটিই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। শুরুতে চমৎকার গল্প, ডিটেইল ও নির্মেদ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এই পুরস্কার প্রায় নিজের একক অধিকারে এনেছিলেন। কিন্তু সেই বলিউড স্টারভর্তি সিনেমা তৈরি করেও তেমন উন্নতি করতে পারেননি। শেষে নিজেকে অভিনয়ে নিবেদন করেছিলেন তিনি। এটাই হলো ঋতুপর্ণের জীবনচক্র।

ফেরা যাক ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্রসঙ্গে। এটা তাঁর অভিনয় ও পরিচালনার ছবি। জেন্ডার ক্রাইসিস নিয়ে গল্প। আজকের আইনসিদ্ধ সমকামী বিবাহের ভারতে দাঁড়িয়ে ঋতুপর্ণের লড়াই অনুভব করা যাবে না। তখন গোড়াপন্থী সমাজের বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে এটা ছিল অধিকার হিসেবে পাওয়া সংগ্রাম। ভারত সেখানে উন্নীত হয়েছে, সেই সংকটের উত্তরণ ঘটেছে। সেই উত্তরণের পথে ‘চিত্রাঙ্গদা’ আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। চিত্রাঙ্গদা আসলে এক জন্মে বহু জন্মান্তরের কথা বলে, যেখানে গীতিনাট্যে চিত্রাঙ্গদা নারী হয়ে পুরুষ বেশ ধরে ছিল, কিংবা ঋতুপর্ণ যেভাবে পুরুষজন্মে নারী হতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রসাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণের একটা প্রচলিত দিক হচ্ছে, সাহিত্যে যা আছে, হুবহু তা–ই চিত্রায়ণ। ঋতুপর্ণের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নিয়ে বিশেষভাবে বলার অবকাশ নিয়েই বলা যায়, তিনি রবীন্দ্রনাথ শুধু পাঠ আর উপস্থাপনের স্থবিরতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি; বইয়ের চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে বাস্তবতার দ্বন্দ্ব এবং বাস্তবতার কোন কোন দিকে চিত্রাঙ্গদা বিকশিত হতে পারে, তা দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি আত্মস্থ করে সৃজনশীল প্রয়োগ করেছেন। এটা রাবীন্দ্রিকতার সৃজনশীল বিকাশ।

ঋতুপর্ণের সব সিনেমার মধ্যে ‘চিত্রাঙ্গদা’ বিশেষ কারণে আলাদা। শুধু নারী জীবনের কথা হয়ে ওঠা নয়, হরমোন বদলালেও সমাজে যে আইডিনটিটি বদলায় না, এটা তার গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপন। সমকামী জীবনের সংকট তুলে ধরা, তার বৈচিত্র্য ও ভবিষ্যতের রূপান্তর খুঁজেছেন তিনি। মনের মতো করে নির্মাণ করেছেন। সমকামিতার সংকট নিয়ে এই সিনেমা ঋতুপর্ণের স্বপ্ন ও সাধের সম্মিলন। একইভাবে সিনেমায় সামাজিকভাবে নারী চরিত্রকে বেছে নিয়েছিলেন। সিনেমাটি কেন আলাদা? কোনো প্রকার ভূমিকাহীনভাবে বলা যায়, এটা ছিল তাঁর মৃত্যুর প্রস্তুতি। সিনেমা দেখার পর আমার তা-ই মনে হয়েছে, বিশেষ করে তাঁর জীবনযাত্রা ও চিন্তার কথা মনে রেখে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড কথিত সৃষ্টিশীল কাজে সময় শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর এক জৈবিক-মানসিক সংগম ঘটে, কিংবা ধ্যানীরা যেভাবে আরাধনার মধ্যে নিজেকে উৎসর্গ করেন, ব্যাপারটা অনেকটা তেমন। তিনি আসলে এর মধ্যে দিয়ে প্রয়াণের জন্য তৈরি হয়েছেন। আর নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’কে এভাবে আর কেউ ভেবে উঠবেন কি না, ঘোর সন্দেহ আছে তা নিয়ে।
অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]