ঋতুরাগ: ঋতুপর্ণের ছবিতে শব্দ ও সংগীত

আজ ৩১ আগস্ট। চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের ৫৮তম জন্মবার্ষিকী। রোজকার মতো আজও ইউটিউব প্লেলিস্টে ঘুরেফিরে চলে আসবে ‘মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা’। আমরা যারা সত্যিই মন খারাপের দিস্তা মাথায় নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি, আজও তাদের শ্রান্তির সঙ্গী হবেন ঋতুপর্ণ।

গ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম

ঋতুপর্ণ ঘোষ নামটা মনে এলে তাঁরই নির্মিত ‘আবহমান’ সিনেমার দৃশ্য মনে পড়ে। সেখানে নামী পরিচালকের স্ত্রীরূপী মমতা শংকর আর নতুন নায়িকা অনন্যা চ্যাটার্জি কথা বলছেন। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে কোনোরকম নাটকীয়তা ছাড়া বেজে চলেছে ‘গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে…’।

কথোপকথনের মধ্য দিয়ে দর্শক ততক্ষণে বুঝে ফেলেছেন এই দুই নারীতে প্রবল তফাত। একজন ভীষণ সংবেদনশীল, রুচিমান নারী। আরেকজনের চরিত্রে আকর্ষণ আছে, মাদকতা আছে; তবে সংবেদনশীলতার অভাবে রুক্ষতার ছাপ সেখানে সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। গান চলতে থাকে। দর্শকের সামনে আরও স্পষ্ট হয়, এই দুই নারীর গঠনে-গড়নে-কর্তব্যে বৈপরীত্য। এক বিন্দুতে এসে কখনো কখনো মিলেও যাচ্ছেন তাঁরা; যখন নিজ হাতে নায়িকাকে গড়ে দিচ্ছেন পরিচালকের স্ত্রী। গানের শেষাংশে এসে সেই গড়ে দেওয়ার চূড়ান্ত ফলাফলেরও দেখা মেলে। সত্যিই কুঞ্জবন মাঝে নেচে চলেছেন নায়িকা, রাধার মতো, শ্রীমতীর মতো।

কোনোরকম নাটকীয়তা ছাড়াই ‘আবহমান’ সিনেমার কথোপকথনের দৃশ্যের আবহে বাজছে ভানুসিংহের পদাবলি

গানের চিত্রায়ণে গল্প বলার এই ধারা কি ঋতুপর্ণ ঘোষের আগে বাংলা সিনেমায় এমন স্পষ্টভাবে ছিল? থাকলেও বোধ হয় কমই ছিল। বাংলা ছবির দর্শকের কাছে সিনেমায় গান মানেই তো চট করে দৃশ্যপটের পরিবর্তন। বিনা নোটিশে সাগরতীরে বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে ছুটে যাওয়া, হুট করে নায়ক-নায়িকার পোশাক বদলে যাওয়া আর অতিনাটকীয় ভঙ্গিতে নিতান্তই অকারণে নাচতে থাকা। সেখান থেকে উঠে এসে ঋতুপর্ণ যে আমাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গেই সিনেমার গানকে অনায়াসে মিলিয়ে-মিশিয়ে দিলেন, তা যেন আমাদের একরকম নতুন করে বুঝিয়ে দিল, সংগীত তো জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অংশ!

শুরুতে যে সিনেমার দৃশ্যের কথা বলছিলাম, সেখানে ‘ভানুসিংহের পদাবলি’ থেকে দর্শককে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী সুর ও কথার এক গানে। আমরা দেখি, নায়িকাতে মুগ্ধ হচ্ছেন সদ্য শুটিংফেরত পরিচালক, মুগ্ধতার সেই অনুভবকে আরও গাঢ় করে তুলছে দূর থেকে ভেসে আসা গান। অ্যাকুস্টিক গিটারে চটপটে কণ্ঠে কেউ গাইছেন, ‘কৃষ্ণকলির চোখ হরিণের মতো, টানা টানা কালো দুটো তারা। কবি কি জানেন, সে লুকিয়ে কখন লাগিয়েছিল মাশকারা।’ ‘ভানুসিংহের পদাবলি’ আর এই চটকদার গানে আকাশ-পাতাল ফারাক। অথচ গান থেকে গানে, দৃশ্যে থেকে দৃশ্যে অবতরণকে ঋতুপর্ণ ভীষণ সহজ করে তুলেছেন। স্টুডিওর আলোকোজ্জ্বল পরিবেশ থেকে তুলে আনা মুগ্ধতা যে বাড়ির বসার ঘরে অনায়াসে ঢুকে পড়ে; তা এই গান থেকে গানে ছুটে যাওয়াতেই যেন সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে, সবচেয়ে শিল্পসম্মতভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি।

আবার দুই ধরনের এ দুই গানের মেলবন্ধন প্রতীকীভাবে হলেও আমাদের জানিয়ে দেয় এক গভীর সন্ধিক্ষণের কথা, প্রবল বৈপরীত্যের কথা। আবার সেই সন্ধিক্ষণ আর বৈপরীত্যের গল্পই সিনেমাটির মূল উপজীব্য। তাই দর্শক হিসেবে কখনো কখনো মনে হয়, এই দুই গানের মিলেমিশে যাওয়া ও গান দুটোর চিত্রায়ণ যেন দৃশ্যের আড়ালেও এক দৃশ্যের কথা বলে।

‘উনিশে এপ্রিল’ ছবির দৃশ্য, যেখানে বর্ষারাতের কলকাতা আর মা-মেয়ের চরিত্রের টানাপোড়েনকে এক সুতোয় গেঁথেছে আবহ সংগীত

একসময় লোকে ভাবত, গান বোধ হয় স্রেফ বাণিজ্যিক সিনেমার অনুষঙ্গ। আর্টফিল্মে ওসব গানটান থাকে না। সত্যজিৎ রায়ের পর ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা সেই ধারণা সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে বদলে দিয়েছিল। ঋতুর সিনেমায় গান শুরু হতো শিরোনাম থেকেই। একদম প্রথম সিনেমা ‘হীরের আংটি’ থেকে শুরু হয়েছিল এই ধারা। সিনেমার কুশীলবদের নাম ভেসে উঠছে পর্দায়, আবহ সংগীতে তখন মহিষাসুরমর্দিনী, মহালয়ার সেই চিরন্তন কণ্ঠস্বর। দুর্গাপূজার সময়কে কেন্দ্র করে নির্মিত সিনেমায় এর চেয়ে ভালো শাব্দিক অনুষঙ্গ আর কীই–বা হতে পারে!

ঋতু জানতেন, দৃশ্যের পূর্ণতম প্রকাশে শব্দ এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তাই চরিত্রের মানসিক টানাপোড়েন বোঝাতে ‘অন্তরমহলে’ সিনেমায় যখন ঢাকের বাদ্যি বেজে ওঠে, আরও একবার প্রমাণিত হয়, একজন ঋতুপর্ণ ঘোষ দৃশ্য আর শব্দের বন্ধুত্বটা বোঝেন ও জানেন। ঋতুপর্ণের দ্বিতীয় সিনেমার শিরোনামেও শব্দ আর দৃশ্যের সেই সূক্ষ্ম মেলবন্ধন দর্শকের চোখ এড়ায় না। সেখানে মড়া বাড়ির ফিসফাস আছে, চায়ের কাপের টুংটাং আওয়াজ আছে, ঝিঁঝি পোকার আওয়াজে রাতের আগমনের বার্তা আছে; আবার মৃদঙ্গ আশ্রিত তালে কর্ণাটকি নাচের সংগীতও আছে। শোকের সন্তাপ আর মাদ্রাজে অবস্থানরত নৃত্যশিল্পীর স্থান, কাল, পাত্রের এমন বৈপরীত্য দেখাতে শব্দ আর সংগীতই তখন ঋতুর মূল বাহন।

ঋতু জানতেন, দৃশ্যের পূর্ণতম প্রকাশে শব্দ এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তাই চরিত্রের মানসিক টানাপোড়েন বোঝাতে ‘অন্তরমহলে’ সিনেমায় যখন ঢাকের বাদ্যি বেজে ওঠে, আরও একবার প্রমাণিত হয়, একজন ঋতুপর্ণ ঘোষ দৃশ্য আর শব্দের বন্ধুত্বটা বোঝেন ও জানেন। ঋতুপর্ণের দ্বিতীয় সিনেমার শিরোনামেও শব্দ আর দৃশ্যের সেই সূক্ষ্ম মেলবন্ধন দর্শকের চোখ এড়ায় না। সেখানে মড়া বাড়ির ফিসফাস আছে, চায়ের কাপের টুংটাং আওয়াজ আছে, ঝিঁঝি পোকার আওয়াজে রাতের আগমনের বার্তা আছে; আবার মৃদঙ্গ আশ্রিত তালে কর্ণাটকি নাচের সংগীতও আছে। শোকের সন্তাপ আর মাদ্রাজে অবস্থানরত নৃত্যশিল্পীর স্থান, কাল, পাত্রের এমন বৈপরীত্য দেখাতে শব্দ আর সংগীতই তখন ঋতুর মূল বাহন।
দেবজ্যোতি মিশ্র

তবে গানের চিত্রায়ণে মুনশিয়ানা বা গানকে সবচেয়ে মোক্ষমভাবে ব্যবহারের কারণেই যে ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমার গান নিয়ে মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়, তা কিন্তু নয়। দৃশ্যের কথা না হয় খানিকক্ষণের জন্য ভুলেই গেলাম, গান হিসেবে আসলে কেমন ছিল ঋতুপর্ণের গান? ‘তিতলি’র কথা মনে আছে? শ্রীকান্ত আচার্যের কণ্ঠে সেখানে মেঘপিয়নের ব্যাগের যে গল্প আমরা শুনেছিলাম, তা যেন সারা জীবনের জন্য বাঙালির বর্ষাসংক্রান্ত আনন্দ আর বিষণ্নতায় জড়িয়ে গেছে। দেবজ্যোতি মিশ্রের সুর আর ঋতুপর্ণের লেখায় সেবার সৃষ্টি হয়েছিল বর্ষা ও বৃষ্টির এক অনবদ্য সংগীত। ঋতুপর্ণ আর দেবজ্যোতি তত দিনে একে অপরের রাম ও সুগ্রীব। শব্দের পর শব্দ জোড়া দিয়ে ঋতুপর্ণ তখন কবিতার মতো দারুণ সব লিরিক লিখছেন আর দেবজ্যোতি তাতে সুর ও সংগীতের জোগান দিচ্ছেন।

২০০৩–এ মুক্তি পেল ঋতুর নতুন ছবি ‘রেইনকোট’। সে আরেক বৃষ্টিদিনের গল্প। এ সিনেমাতেই বোধ হয় ঋতু-দেবজ্যোতি উপহার দিলেন তাঁদের সুন্দরতম সৃষ্টি। ‘রেইনকোট’ ছবির শীর্ষ সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হলো গানটি, ‘মথুরা নগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও’ অর্থাৎ মথুরার রাজা, তুমি কেন গোকুল যাচ্ছ? গানটি ঋতুপর্ণ লিখেছেন ব্রজবুলি ভাষায়। রবীন্দ্রনাথের ভীষণ অনুরাগী ছিলেন ঋতু। তাই বোধ হয় গুরুর এমন অনুকরণ করেছিলেন তিনি। রবি ঠাকুর যেমন ভানুসিংহ ছদ্মনামে ব্রজবুলিতে অনেক পদাবলি লিখেছেন, তেমনি ঋতুও লিখলেন ‘বহু মনোরথে’, ‘মথুরা নগরপতি’ ও ‘ন যাইয়ো যমুনার পাড়’।

রবি ঠাকুরকে ঋতুপর্ণ ধারণ করেছিলেন মনে ও মননে
ছবি: সংগৃহীত

ঋতুর সিনেমার গানের সঙ্গে রবি ঠাকুরের যোগ অবশ্য আরও গভীর। ‘শুভ মহরৎ’ সিনেমায় কোনোরকম বাদ্যযন্ত্রের সংগত ছাড়াই মনোময় ভট্টাচার্য গাইলেন ‘জীবন–মরণের সীমানা ছাড়িয়ে’। সত্যজিৎ-পরবর্তী যুগে বহুদিন পর বাংলা ছবির দর্শক রুপালি পর্দায় রবীন্দ্রনাথকে পেলেন। এরপর অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস নিয়ে বহু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ঋতুপর্ণ। সেই সব সিনেমায় দৃশ্যের প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়েছে রবীন্দ্রসংগীত। তবে সেই ব্যবহারও আরোপিত নয়, বরং সহজ ও সুন্দর।

‘নৌকাডুবি’র কথাই ধরুন। ভাগ্যের ফেরে গভীরতম প্রেমগুলো যখন দিক হারাচ্ছে, তখন ঋতুর নির্দেশনায় আবহে যুক্ত হয়েছে ‘তোমারও অসীমে প্রাণ মন লয়ে..’। বাঙালিমাত্রই জানেন, গভীরতম প্রেমের প্রকাশে তো এভাবে কবিগুরুর কাছেই ফিরতে হয়! আর ঋতুর অন্তরে সে বোধ ছিল অন্য সবার চেয়ে আরও অনেক বেশি সূক্ষ্ম, অনেক বেশি গভীর।

আজ ৩১ আগস্ট। ঋতুপর্ণ ঘোষের ৫৮তম জন্মবার্ষিকী। রোজকার মতো আজও ইউটিউব প্লেলিস্টে ঘুরেফিরে চলে আসবে ‘মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা’। আমরা যারা সত্যিই মন খারাপের দিস্তা মাথায় নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি, আজও তাদের শ্রান্তির সঙ্গী হবেন ঋতুপর্ণ। স্মৃতি ও অনুভবের অমন সঙ্গী হওয়াই বোধ করি একজন ঋতুপর্ণের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। এমন সঙ্গী হয়েই থাকুন ঋতু। জন্মদিনের শুভেচ্ছা।