এ পাহাড়ে আমরা উঠব

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ছেন ২২ বছর বয়সী অ্যামান্ডা গোরম্যান। ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে
ছবি: রয়টার্স

এই একটি কবিতাই ২২ বছর বয়সী অ্যামান্ডা গোরম্যানকে নিয়ে এসেছে আলোর ঝরনাধারার নিচে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হু হু করে বাড়ছে তাঁর অনুসারী। কবিতাটি তিনি পড়েছিলেন ২০ জানুয়ারি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে। নিজের শহর লস অ্যাঞ্জেলেসে অ্যামান্ডা গোরম্যান যখন যুব সভাকবি হন, তাঁর বয়স তখন ১৬। এর তিন বছর পর, ২০১৭ সালে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম জাতীয় যুব সভাকবি হন তিনি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ একটি, দ্য ওয়ান ফর হুম ফুড ইজ নট এনাফ, বেরিয়েছে ২০১৫ সালে।

আফ্রিকান–আমেরিকান অ্যামান্ডা গোরম্যানের জন্ম লস অ্যাঞ্জেলেসে, ১৯৯৮ সালে। এক যমজসহ তাঁর দুই বোন। তাঁদের বড় করেছেন তাঁর একাকী শিক্ষক মা জোন উইকস। অ্যামান্ডার শ্রুতি ও বাগ্‌যন্ত্রের রোগ আছে। কথা বলার সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য অল্প বয়সেই চিকিৎসা নিতে শুরু করেন। পুরো আর সেরে ওঠেননি। অ্যামান্ডার উপলব্ধি, এটি তাঁর প্রতি প্রকৃতির উপহার ও শক্তি। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এখন যে পারফরমার আমি হয়েছি আর যেমন গল্প–বলিয়ে হওয়ার স্বপ্ন আমি দেখি, তা এই অসুস্থতার অবদান।’

জাতীয় যুব সভাকবি হিসেবে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের একটি সাহিত্য অধিবেশন উদ্বোধন করেছিলেন অ্যামান্ডা। তখনই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ফার্স্ট লেডি ড. জিল বাইডেনের নজরে পড়েন। জো বাইডেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনিই তাঁকে একটি নতুন কবিতা পড়ে শোনাতে অনুরোধ করেন।

অ্যামান্ডা গোরম্যান বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমি অন্তর থেকে চেয়েছি আমার শব্দ ঐক্য, সহযোগিতা আর সম্মিলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠুক।’

অ্যামান্ডা গোরম্যানের কবিতা—এ পাহাড়ে আমরা উঠব অনুবাদ করেছেন সাজ্জাদ শরিফ

যখন দিন আসে আমরা প্রশ্ন করি নিজেদের,

অনিঃশেষ এই ছায়ায় কোথায় পাব আলো?

যে ক্ষতি আমরা বয়ে চলি,

এই সাগর আমরা পাড়ি দেব

পশুর উদর আমরা পার হয়ে এসেছি

আমরা জেনেছি, নীরবতা মানেই সব সময় শান্তি নয়

যা মানানসই

নিয়ম আর সংজ্ঞা সাফসাফ মানলেই

তা ইনসাফ নয়

আর ভোর তবু আমাদের

এমনকি তা কী, সেটা জানার আগেই

কোনোভাবে আমরা তা করেছি

কোনোভাবে আমরা পোড় খেয়ে দেখেছি

জাতি তো ধ্বস্ত নয়

অসম্পূর্ণ বড়জোর

একটি দেশ আর সময়ের ওয়ারিশ এই আমরা

যেখানে দাসের সন্ততি আর একাকী মায়ের পালিতা

এক রোগা কৃষ্ণ নারীর স্বপ্ন

প্রেসিডেন্ট হওয়ার

আর দ্যাখে এ নিয়ে সে কবিতা পড়ছে

হ্যাঁ মার্জিত থেকে আমরা বহু দূরে

খুঁতহীনতা থেকে বহু দূরে

তার মানে এই নয় যে আমরা

নিখুঁতদের সংঘ গড়ার জন্য উদ্‌গ্রীব

আমরা সংঘ গড়তে ব্যাকুল একটি লক্ষ্যের

আমরা রচনা করব যত সংস্কৃতি, রং, বৈশিষ্ট্য আর অবস্থার মানুষে অন্তঃপ্রাণ এক দেশ

আমাদের মধ্যে যা আছে তার দিকে সে জন্য আমরা তাকাইনি

আমরা দেখছি যা আছে আমাদের সামনে

বিভেদ গুটিয়ে নিয়েছি, কারণ আমরা জানি ভবিষ্যৎকে শীর্ষে রাখতে হলে

প্রথমেই সরিয়ে রাখতে হবে পার্থক্য

আমরা নামিয়ে রেখেছি হাত

কারণ হাত আমাদের বাড়িয়ে দিতে হবে

একে অন্যের দিকে

ক্ষতি কারোরই নয়, সবারই ঐকতান

পৃথিবী বলুক, আর কিছু নয়, এটাই সত্য:

আমরা আহাজারি করেছি, তবু বড় হয়েছি

আমরা আহত হয়েছি, তবু আশা রেখেছি

আমরা শ্রান্ত হয়েছি, তবু প্রয়াস ছিল

হয়তো চিরকাল বাঁধা থাকব, তবু আমরা জয়ী

এমন তো নয়, পরাজয় কখনো আর দেখব না

বরং বিভাজন আর রোপণ করব না

ঐশীগ্রন্থ আমাদের বলে,

সবাই বসবে যার যার আঙুর আর ডুমুর গাছের তলায়

কেউ ভয় দেখাবে না তাদের

আমাদের সময়ের মাপে যদি আমরা বাঁচতে চাই

জয় তো ছুরির ভেতরে নয়

বরং আমাদের গড়া সেতুর মধ্যে

প্রতিজ্ঞার সেটাই তো ডাঙা

এ পাহাড়ে আমরা উঠব

যদি শুধু সাহস করি

আমেরিকান হওয়া গর্বের চেয়ে আরও বড় উত্তরাধিকার

এটা সেই অতীত, যার ভেতরে আমরা ঢুকব

যেভাবে তাকে আমরা শোধরাব

আমরা দেখেছি এক শক্তি, ভাগ করে নেওয়ার বদলে

জাতিকে তা তছনছ করে ফেলত

জাতিকে তা ধ্বংস করত যদি গণতন্ত্র হতো বিলম্বিত

আর সেটাই হতে যাচ্ছিল জয়ী

তবে গণতন্ত্রকে খানিক বিলম্বিত করা গেলেও

চিরকাল পরাস্ত রাখা অসম্ভব

এই সত্যে

এই বিশ্বাসে আমাদের আস্থা

কিছুক্ষণের জন্য আমাদের দৃষ্টি ভবিষ্যতে স্থির

ইতিহাস চোখ রেখেছে আমাদের ওপরে

এই যুগ কেবলই মুক্তির

এর সূচনায় ছিল আমাদের ভয়

এমন আতঙ্কিত প্রহরের ভার নিতে

নিজেদের আমরা প্রস্তুত ভাবিনি

তবু এরই ভেতরে আমরা পেয়েছি শক্তি

এক নতুন অধ্যায় রচনার

নিজেদের প্রতি আশা আর হাসি নিবেদনের

একবার আমাদের প্রশ্ন করা হলো,

আমাদের পক্ষে কীভাবে বিপর্যয় সামলানো সম্ভব?

এখন আমরা বলি,

বিপর্যয়ের পক্ষে কীভাবে আমাদের সামলানো সম্ভব?

যা ছিল, তার দিকে কখনোই আমরা মিছিল করে যাব না

যা হবে, তার দিকে আমরা এগোব

এই দেশ বিক্ষত কিন্তু অখণ্ড

বিনম্র কিন্তু দৃঢ়

প্রবল ও স্বাধীন

আমরা ঘুরে দাঁড়াব না

কিংবা ভয়ে থমকাব না

কারণ আমরা জানি আমাদের আলস্য আর জড়তা

হয়ে উঠবে উত্তর–প্রজন্মের দায়

আমাদের ভুল হবে তাদের বোঝা

তবে এ তো নিশ্চিত:

যদি আমরা শক্তিকে ভরিয়ে দিই দয়ায়

শক্তিকে ভরিয়ে দিই সুনীতিতে

ভালোবাসা হবে আমাদের উত্তরাধিকার

তা বদলে দেবে আমাদের সন্তানভাগ্য

তাই সেই দেশ আমরা পেছনে রেখে যাই

যা আমাদের কাছে রেখে যাওয়া দেশটির চেয়ে ভালো

আমার এই ব্রোঞ্জ–ব্যাহত বুকের প্রতিটি নিশ্বাসে

এই বিক্ষত বিশ্বকে আমরা জাগিয়ে তুলব বিস্ময়ে

আমরা জেগে উঠব পশ্চিমের সুবর্ণ–অঙ্গ পাহাড়শ্রেণি থেকে,

আমরা জেগে উঠব বায়ুতাড়িত উত্তরপূর্ব থেকে

আমাদের পূর্বপুরুষের প্রথম বিপ্লবের মাটিতে

আমরা জেগে উঠব মধ্য–পশ্চিম রাজ্যের হ্রদঘেরা নগরী থেকে

আমরা জেগে উঠব সূর্যতাপিত দক্ষিণ থেকে

আমরা আবার গড়ব, মিলব, সারিয়ে তুলব

আর আমাদের জানা জাতির প্রতিটি প্রান্ত

আর প্রতিটি কোণ যাকে আমরা বলি দেশ,

বিচিত্র আর সুন্দর জেগে উঠবে আমাদের মানুষ

আহত আর সুন্দর,

যখন দিন আসবে আমরা ছায়া থেকে বেরোব,

অগ্নিশিখাময় আর নিঃশঙ্ক,

আমরা মুক্ত করব তাই জাগবে নতুন ভোর

চিরন্তন আলোয় উজ্জ্বল,

যদি শুধু আমাদের সাহস থাকে তা দেখার

যদি শুধু আমাদের সাহস থাকে তা হওয়ার


ঢাকা, ২১ জানুয়ারি ২০২১