এই তো আমার আম্মা

কয়েক দিন আগে রাত সাড়ে ১১টায় লেখকের কাছে হাসপাতাল থেকে এল একটা ফোন, ‘আমি আইসিউ থেকে বলছি। আপনারা প্রস্তুতি নেন। আপনার আম্মার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। স্যাচুরেশান নেমে যাচ্ছে দ্রুত।’ করোনা সংক্রমণে মারা গেছেন লেখকের মা রোকেয়া বেগম। সেই মাকে নিয়ে লেখেছেন তাঁর মেয়ে শিকোয়া নাজনীন। মর্মস্পর্শী এক রচনা

মা রোকেয়া বেগমের ছবি অবলম্বনে কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

কারও কারও মন আলোকচিত্রের ওয়েট প্লেটের মতো। যে ছবি ওঠে সেটাকে তখনই ফুটিয়ে কাগজে না ছাপিয়ে নিলে নষ্ট হয়ে যায়।
আমারও তেমনি। এই করোনায় মায়ের মৃত্যু, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর আচমকা চলে যাওয়া, করোনার ভয়ে দীর্ঘদিন তাঁর মনুষ্য স্পর্শহীন থাকা, এমনকি মৃত্যুর পর তাঁকে কাপড়ে মুড়িয়ে আইসিইউ থেকে বের করার দৃশ্য দূর থেকে হৃৎপিণ্ড বন্ধ করে দেখা। বড় বিস্ময়কর—যেন এ আমার জীবনে ঘটেইনি। অন্য কারও জীবন। আমার ছোট বোন সদ্য মৃত আম্মাকে মাথা থেকে পা অবধি পুরোপুরি কাপড় দিয়ে ঢাকা দেখে কাঁদছিল খুব। এ আমাদের অপরিচিত মা। কাপড়ের একটু ফাঁক গলে আম্মার কড়ে আঙুল দেখতে পেয়ে বলেছিল, ‘আমি আম্মার আঙুল দেখছি।’ সেটাই তার অনেক পাওয়া। আমি তা–ও না। পরে অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরিপাটি করে সাজানো, মৃতদেহ স্নান করিয়ে কাফনে জড়ানো আম্মার মুখখানা আমাদের দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আমার কাজিন। মাহমুদ ভাইয়ের (ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক তৌহিদুল করিম) উদ্যোগে আম্মার মৃত মুখ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম শেষে। কী যে শান্তি ছিল সেই মুখে! অসচরাচর মুখ। অন্ধকার ছিঁড়ে জ্বলে ওঠা রোশনাই যেন। আম্মার মুখে জড়ানো ছিল বিস্ময়। এমনটি আর কোনোদিন দেখিনি। মনে হয় আচমকা এই আয়োজনের কথা তাঁর জানা ছিল না। হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার বিস্ময় অথবা করোনার জীবাণুতে অনেক দিন মনুষ্য স্পর্শহীন মৃত্যুর বিস্ময়।

পরিণত বয়সে আমার আম্মা রোকেয়া বেগম
ছবি: লেখক

সদ্য স্নানের শেষে তাঁর ঘন খরখরে একরাশ কোঁকড়া চুলের জট ছাড়ানো হয়েছিল কি না, জানতে পারিনি। সাদা কাফনের মধ্যে আমাদের অনেক প্রিয় তাঁর ভেজা চুলের গন্ধ ভেসে আসেনি আর। হাসপাতালে ব্লিচিং পাউডারের কড়া গন্ধ আর কর্পূরের গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সব। আলাদা করা যায়নি। আম্মার তীব্র উজ্জ্বল দপদপে চোখের মণিতে আর্দ্র সবুজ দ্যুতি ছিল, উত্তেজনায় ছটফট করা চোখগুলো চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আর কিছু দেখতে পাইনি। আমরা কেউ কাছে যেতে পারিনি হাসপাতালে।

আইসিইউতে করোনায় আক্রান্ত আম্মা পরিজন থেকে বহু দূরে শ্বাপদসংকুল অরণ্যের মধ্যে যেন পার্থেনিয়ামের আগাছার মতো ১৫ লিটার অক্সিজেন টানতে টানতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তাঁর গায়ের গন্ধটা ছিল পুরোনো কাপড়ের মধ্যে উপকূলের নোনা হাওয়ার ভেষজ উদ্ভিজ্জবিশেষ, যার দৃশ্য–শ্রাব্য কোনো রূপ হয় না। এই গন্ধ আশৈশব জড়িয়ে আছে আমাদের সঙ্গে। কিন্তু আজ এই গন্ধের সঙ্গে হাসপাতালের গন্ধ মিশে অন্য রকম হয়ে গেছে। করোনার জীবাণু আম্মার অক্সিজেন স্যাচুরেশান কমিয়ে দিতে থাকে, হঠাৎ তাঁর ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে রক্তচাপ কমতে শুরু করে।

পঞ্চাশের মন্বন্তরের মহামারির গল্প শুনেছিলাম আম্মার কাছে। তিনি বলতেন, সেবার শীতে নবান্ন হলো না। শস্যগুদামের শালিক পাখিগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল! আর দেখা পাওয়া যায়নি কোনোদিন। মানুষ ছিল চামড়ায় জড়ানো কঙ্কালের মতো, পোড়া কাগজের মতো চামড়ায় ফুঁ দিলে গা থেকে খসে পড়বে এমন।

না, মৃত্যুর খবর আমাদের কেউ দেয়নি। সে রাতে আর কোনো ফোন আসেনি। বরং অনেক দিন পর আশ্চর্য শান্ত আমাদের ঘর। আমরা নির্ঘুম রাতের আকাশে সেদিন অদ্ভুত সুন্দর চাঁদ দেখেছিলাম। পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। এই স্মৃতিও একদিন ঝাপসা হয়ে যাবে আলোকচিত্রের ওয়েট প্লেটের মতো। কী বিস্ময়কর মানবজীবন। রোলা বার্থ লিখেছিলেন, মায়ের মৃত্যু একটি ব্যক্তিগত দুঃখ। এর সঙ্গে যা কিছু জড়িয়ে থাকে, তা মূলত একান্ত নিজের। সেই দুঃখ অন্যকে স্পর্শ করবে, এই আশা তুমি করো না।

হাসপাতালে মাহমুদ ভাইয়ের চেম্বারের হালকা ঘিয়ে রঙের পর্দার স্নিগ্ধতা দেখতাম আমরা। সেখানেই বসে থাকতাম। বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করতাম। মাহমুদ ভাই অপারেশন থিয়েটার থেকে ফিরলে করোনার আইসিইউতে যেতে আলাদা ড্রেস পরেন। বিশেষ প্রতিরক্ষাকারী অ্যাপ্রনের ওপর পিপি, মাস্ক, নতুন ধরনের এক্সট্রা হাইজিন ব্যবহার করে আইসিউতে শেষবার আম্মাকে দেখতে যান। আম্মা সেদিনও নিশ্চয়ই চোখ বিস্ফোরিত করে দেখতে চেয়েছেন মাহমুদ ভাইকে। একটা চেনা গলার স্বর; আহ কত দিন পর...। কী বলেছেন আম্মা? আমরা সারা রাত না ঘুমিয়ে ঘর আর হাসপাতাল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সকালে গোগ্রাসে তোফাজ্জলের বানানো চা খেয়েছিলাম। ওভালটিন দুধ মেশানো আর্লি গ্রে–টির গন্ধ জুড়ে থাকে ঘরে। মাহমুদ ভাই ফিরে এলেন, মুখে একরাশ কালো মেঘ। চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। খুব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল, কী বলেছেন আম্মা? তাঁর কি কষ্ট হচ্ছে খুব? আম্মার তো কোনোদিন অসুখ হতে দেখিনি। নীরোগ শরীরে করোনা ঢুকে সুবিধা করতে পারবে না, এটাই তো জানি। আম্মার মুখটা কি ক্লান্ত দেখাচ্ছিল? রাতে ঘুম হয়েছিল তাঁর? মুখে কি ক্রিম মেখে দিয়েছিল নার্স? বাতাসে এমন টান। কিন্তু মাহমুদ ভাই কিছুই বললেন না। আম্মা যে আর ভালো হয়ে ফিরবেন না, তিনি হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন সেদিন। কেউ আমাদের আর কোনো খবর দেয় না।

ঘরে ফিরে আম্মার ব্যাগটা খুলে দেখি তাঁর ছেলেদের ঠিকানা লেখা। তাঁর মেজো ছেলে খাইরুল কবির—৬ বি-ফিবারভ্যাগেন, স্টকহোম, সুইডেন। অন্য আরেকটি ঠিকানা টরন্টোর, তাঁর ছোট ছেলের। সঙ্গে একটা পুরোনো হাতঘড়ি। সম্ভবত আব্বার। ঘড়িতে রাত ১টা বেজে ১০ মিনিট। অনেক দিন আগের কোনো এক রাতে ঘড়িটা বন্ধ হয়েছিল। রাতের ঠিক ওই ক্ষণ খুঁজি আমি। এটা কি আম্মার মৃত্যুর ক্ষণ? কাকতালীয়। আম্মার মৃত্যুর সঠিক সময় আমরা জানি না। দুপুরে আইসিইউ থেকে ডাক্তার বলেছিলেন, ‘আপনার মায়ের স্যাচুরেশান এখন ৮৪ থেকে ওপরে উঠে ৯০-৯১ হয়ে গেছে। ভালোর দিকে।’

আমরা যেন বুক ভরে বাতাস নিলাম। একঝলক আশার আলো, আমাদের বুক থেকে ভারী পাথর সরে গেল। মেজো ভাই সুইডেন থেকে ফোন করেন। বলেন, করোনার শেষ ছোবল আজ। হিসেবমতো আজকে ১৪ দিন পূর্ণ হবে। করোনা ১৪ দিন পর ছেড়ে যায়। আম্মা শুধু আজকের দিনটা যুদ্ধ করলেই বেঁচে যাবেন।

আম্মা রোকেয়া বেগম ও আব্বা নুরুল ইসলাম
ছবি: লেখক

কিন্তু রাত সাড়ে ১১টায় হাসপাতাল থেকে আবার একটা ফোন আসে। ‘আমি আইসিউ থেকে বলছি। আপনারা প্রস্তুতি নেন। আপনার আম্মার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। স্যাচুরেশান নেমে যাচ্ছে দ্রুত।’

সে রাতে ঠিক কোন সময় আম্মা চলে গেলেন, আমরা আর কেউ জানতে পারিনি। করোনার মৃত্যুযাত্রাও নিঃসঙ্গ। ছোঁয়াচে বলে প্রিয় মানুষ জড়িয়ে ধরে না। হাতে হাত রাখে না চলে যাওয়ার সময়ও।

না, মৃত্যুর খবর আমাদের কেউ দেয়নি। সে রাতে আর কোনো ফোন আসেনি। বরং অনেক দিন পর আশ্চর্য শান্ত আমাদের ঘর। আমরা নির্ঘুম রাতের আকাশে সেদিন অদ্ভুত সুন্দর চাঁদ দেখেছিলাম। পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ।

এই স্মৃতিও একদিন ঝাপসা হয়ে যাবে আলোকচিত্রের ওয়েট প্লেটের মতো। কী বিস্ময়কর মানবজীবন। রোলা বার্থ লিখেছিলেন, মায়ের মৃত্যু একটি ব্যক্তিগত দুঃখ। এর সঙ্গে যা কিছু জড়িয়ে থাকে, তা মূলত একান্ত নিজের। সেই দুঃখ অন্যকে স্পর্শ করবে, এই আশা তুমি করো না।

বাসার পুরোনো অ্যালবামে খসখসে মোটা কালো কাগজের পাতা। প্রতিটি পাতার ওপর একটা সেলোফিনের অস্বচ্ছ আড়াল। চামড়াবাঁধানো মোটা দুটি বর্ডারের ভেতর ভরা আছে আর সব ছবির পাতা। ছবির চার কোনায় একটি করে কর্নার। বেশির ভাগ ছবি অপরিচিত আত্মীয়ের। আম্মার একটি ছবি সাঁটা সেখানে। আমার জন্মের আগের আম্মা। ছবিতে এক তরুণী নরম রোদের মধ্যে আলোবিধৌত মায়াময় মুখে তাকিয়ে আছে। অলীক। কেমন ছিল তাঁর তারুণ্য? কোনোদিন ভাবিনি। ধোঁয়াশা আবছায়ায় সেপিয়া প্রিন্টের ছবির মেয়েটি আমার আম্মা, ভাবতেই বিস্ময় হচ্ছে! আমার জন্মের আগে আম্মার কোনো অস্তিত্ব ছিল নাকি? তাঁর তারুণ্য, তাঁর বয়স ১৬ কি ১৭। সবই আশ্চর্য। একটি গাছগাছালি ঘেরা দিগন্তে বসে আছেন আম্মা। সদ্য স্নান করা, হয়তো টপটপ জল পড়ছে চুল থেকে। পালামৌর মতো নিসর্গ। শান্ত জনপদ। গ্রীষ্মের দাবদাহ ছিল কি? আম্মার চুলের স্টাইল টেরিকাট নিচু থেকে ওপরে একটু বেঁকে ঢেউতোলা রুশ মেয়েদের মতো।

আম্মার মাঝারি কিন্তু টিকালো নাক যেন ছোট একটা শৈলপ্রান্তর। তার ওপর একটা জ্বলজ্বলে কালো তিল মায়াময়। ফরসা লম্বা গড়নের মধ্যে মুখে অভিনব কিছু ছিল, লোকে ভিড় করে দেখত। এই গল্প আমরা আত্মীয়–পরিজনের কাছে অনেকবার শুনেছি। গ্রামের লোক বলে, ডাক পড়া। রূপের কলস। গায়ের রং ছিল দুধেধোয়া হলুদ। তাঁর চোখের মণি ছিল হালকা ঘিয়ে রঙের। আম্মার বয়স তখন ১৩ হবে। বিয়ে হয়ে এসে দ্রুতই শ্বশুরবাড়িতে কৃষিনির্ভর সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল এক কিশোরী—আমার আম্মা। কাকভোরে শুরু হতো সেই ত্রিশ বিঘা জমির কর্মযজ্ঞ। নিজ বাড়ির আদুরে ছোট মেয়ে রুকাইয়া ওরফে রোকেয়া বিরাট সংসারের ভার সামলে উঠতে না পেরে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। এক অঝোর বৃষ্টির রাতে মাথায় গোলমাল শুরু হলো তাঁর।

না, মৃত্যুর খবর আমাদের কেউ দেয়নি। সে রাতে আর কোনো ফোন আসেনি। বরং অনেক দিন পর আশ্চর্য শান্ত আমাদের ঘর। আমরা নির্ঘুম রাতের আকাশে সেদিন অদ্ভুত সুন্দর চাঁদ দেখেছিলাম। পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। এই স্মৃতিও একদিন ঝাপসা হয়ে যাবে আলোকচিত্রের ওয়েট প্লেটের মতো। কী বিস্ময়কর মানবজীবন। রোলা বার্থ লিখেছিলেন, মায়ের মৃত্যু একটি ব্যক্তিগত দুঃখ। এর সঙ্গে যা কিছু জড়িয়ে থাকে, তা মূলত একান্ত নিজের। সেই দুঃখ অন্যকে স্পর্শ করবে, এই আশা তুমি করো না।

ছবিটি দেখতে দেখতে ভাবি, এ ছবির জন্য আমার একাকীত্ব প্রয়োজন। আমি একা না হলে এই ছবি আমার দিকে তাকাবে না কোনোদিন। আরেকটি ছবিতে রঙিন পোলারয়েডের ক্যামেরার মধ্য দিয়ে টারকুইজ লিনেনের পর্দা উড়ছে। আম্মার নিটোল সাদা হাতটা এলিয়ে পড়ে আছে। এ যেন ছবির শরীরের মধ্যে একটা শব্দ। দুগ্ধ ফেননিভ, ঘসা কাচের মধ্য দিয়ে আলো যেমন অধিকতর উজ্জ্বল দেখায়, তেমনি আম্মার মুখের রং। ফিকে জামার আবরণে অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মুখটা। আম্মার এই ছবি ‘দুর্গেশনন্দিনী’ পড়ার আগের ছবি। কারণ, আম্মা বলেছিলেন, বারুইপুর আসার আগে তিনি ‘দুর্গেশনন্দিনী’ পড়েননি। ছবির চেহারাও মিলে যায়। ঋজু কিন্তু দীর্ঘকায় উজ্জ্বল নাসিকায় আম্মা তখন একটা হিরের নাকছাবি পরতেন।

সুজান সন্তাগের ‘অন ফটোগ্রাফি’ বিশিষ্ট হয়ে আছে আলোকচিত্র ও বাস্তবতার মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য। মুসলমান রক্ষণশীল পরিবারের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন না। থাকলে বুঝতেন, কেন আলোচিত্রের চরিত্র এমন পরাবাস্তব হয়ে ওঠে। ছবিতে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আলোর মতো চারপাশটা। সেই অদ্ভুত অচেনা আলোয় বসে আম্মা ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন, সেখানে আম্মার মুখে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ছবির বাতাস আমাকে প্লাবিত করে। যদিও এ বাতাসের প্রস্রবণী ঝরনাধারার অনুভূতি শুধু আলোকচিত্রীরই প্রাপ্য হয়তো। কিন্তু এই বাতাস স্পর্শ করে আমাকে। আমার জন্য এটা অনন্য কিছু। এটা আমার দুঃখ, এই দুঃখ অন্য কারও নয়। আমিও মায়ের ছবি প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকি মনে মনে। হয়তো দর্শকের বিনোদন আমি চাই না। হয়তো ওয়াল্টার বেঞ্জামিন আমাকে প্রভাবিত করেছেন। হয়তো সুজান সন্তাগের একধরনের সম্পর্ক আছে আমার এই কুসংস্কারের সঙ্গে। ছবিটা খুব নিরীহ। কোনো চমক নেই, কোনো চকিত উন্মাদনা আসে না। আম্মা ঘাড় ঘুড়িয়ে কোথাও তাকিয়েও নেই। এই ছবির মধ্যে বয়ে চলা বাতাস আমাকে স্পর্শ করে শুধু। আম্মার নিশ্বাস–প্রশ্বাস বাহিত ছিল বলে এ বাতাসে আমার এত আকুলতা। তাঁর চুলের মধ্যে বয়ে চলা বাতাস বিদ্ধ করে আমাকে। এই হাওয়া বুদ্ধি করে উজিয়ে দেওয়া নয়। যেভাবে সে সিলুয়েট হয়েছে, সেই উপমা এই বাতাসের মধ্যে লীন হতে থাকে। আম্মার মুখের সেই ১৯৫০ সালের বাতাস আমার কাছে অম্লান হয়ে ওঠে, যা আম্মার হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে বেরিয়েছিল, যা নেই বলে আজ আম্মা নেই। আমি অনুভব করি এই বাতাস আসলে ঈশ্বরের কৃপা ছিল। আমাকে এই ছবির বাতাস তাই প্ররোচিত করতে থাকে। আমার কাছে ক্রমে জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে এই বাতাস।

আম্মার সঙ্গে আমি, ১৯৯৮
ছবি: লেখক

আম্মার মাঝারি কিন্তু টিকালো নাক যেন ছোট একটা শৈলপ্রান্তর। তার ওপর একটা জ্বলজ্বলে কালো তিল মায়াময়। ফরসা লম্বা গড়নের মধ্যে মুখে অভিনব কিছু ছিল, লোকে ভিড় করে দেখত। এই গল্প আমরা আত্মীয়–পরিজনের কাছে অনেকবার শুনেছি। গ্রামের লোক বলে, ডাক পড়া। রূপের কলস। গায়ের রং ছিল দুধেধোয়া হলুদ। তাঁর চোখের মণি ছিল হালকা ঘিয়ে রঙের। আম্মার বয়স তখন ১৩ হবে। বিয়ে হয়ে এসে দ্রুতই শ্বশুরবাড়িতে কৃষিনির্ভর সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল এক কিশোরী—আমার আম্মা। কাকভোরে শুরু হতো সেই ত্রিশ বিঘা জমির কর্মযজ্ঞ। নিজ বাড়ির আদুরে ছোট মেয়ে রুকাইয়া ওরফে রোকেয়া বিরাট সংসারের ভার সামলে উঠতে না পেরে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। এক অঝোর বৃষ্টির রাতে মাথায় গোলমাল শুরু হলো তাঁর।

গোটা মাসের ফসল তোলার কাজ পড়ে থাকে সেবার। ধান মাড়াই, বাছাই, খড় শুকানো—সব পড়ে থাকে। কামলারা আসেন ধান কেটে দিয়ে যেতে। তারপর এক অগ্রহায়ণ মাসের বিকেলে বাড়ির উঠান লেপে আম্মা, নিকানো ঘর বারবার ধোন—এই গল্প অনেকবার তিনি করেছেন আমাদের।

সেই কালে একবার দারুণ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন আম্মা। কেন? আব্বা এসেছেন, তাঁকে নিয়ে যেতে। অফিস থেকে কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছে। রেলের গাড়ির টিকিট নিয়েই এসেছেন। পরদিন সকালেই ট্রেন। আমার দাদির মুখ অন্ধকার। ধান ওঠার সময় বউ চলে গেলে এত কাজ করবে কে! আম্মা পড়িমরি করে ট্রাঙ্ক গোছান। উঠানের শুকনো ধান তোলার জন্য আজ কেউ তাঁকে তাগাদা দেয় না। নিজেই একনাগারে রাত অবধি রান্নাঘর পরিপাটি করেন। তাঁর বাবার দেওয়া শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ পড়তে পারেননি কোনোদিন। সকালে দীর্ঘ ট্রেনযাত্রায় এবার পড়বেন বলে মলিন কাঁথার নিচে গুঁজে রাখেন সেই বই। এবার পাহাড়ের সুড়ঙ্গ পার হবেন আম্মা, মনটা রোমাঞ্চে ভরে উঠতে থাকে। মনে হয় পাখা গজিয়েছে। অজানা গন্তব্য। দেশভাগ হয়েছে কেবল। তখনো কলকাতায় পোস্টিং আব্বার। সারভে অব ইন্ডিয়া। সরকারি বাংলো, সুন্দর লেপা–পোছা বাড়ি, গোটা দুই ঘর। বুনো গাছগাছালিতে ঠাসা। একটা পুকুরঘাট, মধুমঞ্জুরি লতার ঝোপ দোল খায়, আম্মার এই প্রথম নিজের সংসার। ‘পথের পাঁচালী’র মতো শান্ত গ্রাম। রাংচিতার ঝোপ, মরা ঘাসফুল। এভাবে যত নতুন শহরে আব্বা বদলি হয়েছেন, আম্মা সঙ্গী হয়েছেন তাঁর।

ঢাকা তখন বনজঙ্গল ঘেরা পাড়াগাঁ। রাস্তাঘাট এমন প্রশস্ত নয়, বন–বাদাড় সাফ করে সরকারি কলোনি হচ্ছে সবেমাত্র। এমন ঢাকার গল্প বুঁদ হয়ে শুনেছি আম্মার কাছে। রেশন দোকানের বন্ধ দরজার সামনে মলিন চটের থলির লম্বা লাইন ঢুকে যেত, গলির ভেতর ওম হয়ে থাকত শস্যদানার গন্ধ। আম্মার মুখে শোনা, আম্মা নতুন নতুন জায়গায় বাসা বানিয়েছেন। আব্বার সঙ্গে বায়োস্কোপ দেখেছেন। হগ মার্কেটের কমলালেবু আর পলসন কোম্পানির টিনের মাখনের স্বাদ তাঁর মুখে লেগেছিল বহু দিন।

আমাদের এই হাসপাতালে ফ্রিজিং লাশবাহী গাড়িগুলোর রং ঝকঝকে সাদা, তার ওপর কমলা রঙের লেখাটা, বড় বড় স্পষ্ট অক্ষরে লেখা ‘লাশ’ শব্দটা। বুক হিম হয়ে যায় দেখলেই। বহু দিন পর কেউ যদি এই মহামারি নিয়ে ছবি আঁকেন, তবে এই গাড়ি তাঁকে আঁকতে হবে। লম্বাটে রেডিয়েটার। গোল গড়নের কেবিনযুক্ত ঘর ভেতরে লাশের জন্য। আর জোরা উইন্ডস্ক্রিন। ড্রাইভারের মুখ ভাবলেশহীন। দূর থেকে আলাদা করা যায় এই গাড়ি।

এক প্রান্তিক গ্রামে বড় হয়েছিলেন আম্মা। মন্বন্তর, দেশভাগ, দাঙ্গার স্মৃতি খুব জ্বলজ্বলে ছিল তাঁর মধ্যে। আব্বার বদলির চাকরির সুবাদে নানা স্থানে গিয়েছেন আম্মা। কোয়েটা, রাওয়ালপিন্ডি, বেনারস থেকে মধুপুর, রিখিয়া, গিরিন্ডি ঘুরে ঘুরে তাঁর মনের ভেতরে একটা অনিশ্চিত উপনিবেশ তৈরি হয়েছিল। সারাক্ষণ ঘর হারানো আর মানুষ হারানোর ভয়। গল্পে, স্মৃতিকথায় আম্মার মনে উঁকি দিত হারিয়ে ফেলা জীবন। তাঁর কাছে শুনেছি, উনিশ শতকের শুরুতে কেমন করে বিহারের গর্ভ হেঁকে জন্ম নিয়েছিল ঝাড়খন্ড। কত অকারণ প্রাণহানি। সেই আরণ্যক পটভূমির জরিপ অধিদপ্তরে আব্বা চাকরি করতেন। আম্মার জীবন বারবার ঠাঁই নাড়া হয়েছিল তাই। দেখেছেন নানা জাতের মানুষ। বিচিত্র জীবন। একটি ভৌগোলিক প্রদেশ যত না, তার চেয়েও বেশি মানুষের জীবন হাতছানি দিয়েছে তাঁকে। কোনোদিন স্থিত হতে পারেননি তিনি। কোথাও যেতে হলে তিনি হয়তো উত্তর ভারতগামী যেকোনো একটি ট্রেনে উঠে বসতে পারতেন অনায়াসে। কোনো অনিশ্চিত গন্তব্য বাঁধা হতো না।

আমি আম্মার আবছা মলিন একটি ছবি দেখি। দর্শকের জন্য এই ছবির সবকিছু হয়তো সিপিয়া ফটোগ্রাফে পুরোনো কলের গানের মতো অ্যান্টিক আর্ট। আমার কাছে প্রতিটি দিনের অভ্ররাশি আম্মার এই ছবি।

আমার কাছে আম্মা মানে বৃহস্পতিবার নখ কাটতে বারণ। শুক্রবার মানে চিরুনিতে জট ছড়ানোর সময় আলগা হয়ে আসা চুল কোথাও অবলীলায় ফেলা বারণ, যা গুঁজে রাখতে হবে ভেলভেটের কাপড়ে মুড়ে। শনিবার মানে আম্মার প্রিয় সুরা আদ–দোখান পড়া। আর এখন আমার কাছে রোবার মানে করোনাক্রান্ত ফুসফুস জখম হওয়া। আর বুধবার মানে অভ্রের গুঁড়ামেশা লাল কাঁকড়ে ভূমি, যা সবচেয়ে রহস্যময় স্থান, সেখানেই আম্মার কবর।

আম্মা এখানেই, এই গ্রামের পথে যেতে যেতে বলেছিলেন, এক মুক্তিযোদ্ধা তরুণ পায়ে গুলির ক্ষত নিয়ে হেঁটে যেত এই পথে। তাঁকে পানি খেতে দিতেন আম্মা।

দূরে পাহাড়ের সানুদেশে একদিন বর্ষার ম্লান সন্ধ্যায় আম্মার কবরে বহুকালের পুরোনো শেওলা জমা হবে। বসন্তের শুষ্কপত্রে চৈতালি ঘূর্ণিতে আম্মার কবরটা গভীর অভয়ারণ্যের ভেতর ক্রমে একদিন হারিয়ে যেতে থাকবে। বেডফোরডের ডেলিভারি ভ্যান এসে পাউরুটি সাপ্লাই দেবে। আমরা সেগুলি কামড়াকামড়ি করে নেব, যেমন হতো বিশ্বযুদ্ধের সময়। এসব গল্পের মধ্যে হস্তী, শৃগাল আর হরিণ থাকত। পক্ষীকুজনের নকশা থাকত। আম্মা হয়তো কোনোদিন গুছিয়ে শামসুর রাহমানের কবিতার মতো বলতেন না, ‘আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়, আবার শিষ দেয়, আমার বইখাতা ঠোকরায় তোমরা তাকে দিও না বাধা।’ বাইরের উঠানে ঝা ঝা করছে রোদ্দুর, রেলগাড়ি যাচ্ছে। তবু আমাদের কবিতা মনে আসে।

বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি এসে আম্মার প্রথম বিস্ময় ছিল এই রেলগাড়ি। তিনি দেখেন কত অজানা মানুষ কত কত দূরে চলে যায় এই রেলগাড়ি দিয়ে। মেরুন রঙের রেলগাড়ি দিয়ে পরে আব্বার সঙ্গে কত কত দূরেই না চলে গিয়েছিলেন তিনিও। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছিল এই রেললাইন। আজকে পৌষের আশ্চর্য নরম রোদের বিকেলে আম্মার কবর খোঁড়া হচ্ছে। কবরে শোয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন আম্মা। মনে পড়ে তাঁর তসবিতে, আল্লাহ্‌র নাম অবিরাম সঞ্চারিত হয়েছিল। এখনো কি তাই?

বহুকাল আম্মা দুমুঠো চাল বেশি দিতেন ভাতের হাঁড়িতে। অতিথি আসবে বলে। পুরোনো অভ্যাসে। জমজমাট সংসার ছিল। অনেক লোকজন আসত। নিত্যদিনের আনাগোনা। রাত্রিবেলা সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে ভাবতেন, দরজায় কেউ এসেছে। কার জন্য অপেক্ষা ছিল আম্মার? দেয়ালে ঘড়ি দেখতেন বারবার। একটা উসখুস উদ্ভ্রান্তি ছিল সারাক্ষণ। মাথার কাছে রাখতেন সারাক্ষণ ব্যাগটা, যেখানে তাঁর ছেলের ঠিকানা লেখা ছিল। যেন তিনি একদিন প্রিয় সন্তানের কাছে পৌঁছাতে পারবেন এই ঠিকানা ধরে। অথচ এমন পৌষের রাত্তিরে ঠিকানা ছাড়াই চলে গেলেন কোথায়।

আম্মার মাঝারি কিন্তু টিকালো নাক যেন ছোট একটা শৈলপ্রান্তর। তার ওপর একটা জ্বলজ্বলে কালো তিল মায়াময়। ফরসা লম্বা গড়নের মধ্যে মুখে অভিনব কিছু ছিল, লোকে ভিড় করে দেখত। এই গল্প আমরা আত্মীয়–পরিজনের কাছে অনেকবার শুনেছি। গ্রামের লোক বলে, ডাক পড়া। রূপের কলস। গায়ের রং ছিল দুধেধোয়া হলুদ। তাঁর চোখের মণি ছিল হালকা ঘিয়ে রঙের। আম্মার বয়স তখন ১৩ হবে। বিয়ে হয়ে এসে দ্রুতই শ্বশুরবাড়িতে কৃষিনির্ভর সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল এক কিশোরী—আমার আম্মা। কাকভোরে শুরু হতো সেই ত্রিশ বিঘা জমির কর্মযজ্ঞ। নিজ বাড়ির আদুরে ছোট মেয়ে রুকাইয়া ওরফে রোকেয়া বিরাট সংসারের ভার সামলে উঠতে না পেরে ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। এক অঝোর বৃষ্টির রাতে মাথায় গোলমাল শুরু হলো তাঁর।

আমাদের এই হাসপাতালে ফ্রিজিং লাশবাহী গাড়িগুলোর রং ঝকঝকে সাদা, তার ওপর কমলা রঙের লেখাটা, বড় বড় স্পষ্ট অক্ষরে লেখা ‘লাশ’ শব্দটা। বুক হিম হয়ে যায় দেখলেই। বহু দিন পর কেউ যদি এই মহামারি নিয়ে ছবি আঁকেন, তবে এই গাড়ি তাঁকে আঁকতে হবে। লম্বাটে রেডিয়েটার। গোল গড়নের কেবিনযুক্ত ঘর ভেতরে লাশের জন্য। আর জোরা উইন্ডস্ক্রিন। ড্রাইভারের মুখ ভাবলেশহীন। দূর থেকে আলাদা করা যায় এই গাড়ি।

আম্মা যে হাসপাতালে ছিলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা বাইরে ফ্রিজিং লাশবাহী গাড়ি দেখতাম সারাক্ষণ। কত মানুষ যে মৃত্যুবরণ করছে। পরিজনরা হাসপাতালের করিডোরে হাত–পা ছুড়ে কাঁদছে। দেখে সিনেমায় দেখা সতেরো শতকের প্লেগ গাড়ির কথা মনে পড়ছিল। তখন সবকটা ছিল বেডফোরড কোম্পানির গাড়ি। আর সেসব গাড়ির কী রং ছিল, ছবিতে কোনোদিন বুঝতে পারিনি। মেরুন বা নীল হতে পারে। তখন তো রঙিন আলোকচিত্র ছিল না। জয়নুল বা চিত্তপ্রসাদের মতো শিল্পীরা পঞ্চাশের মন্বন্তরের ছবি এঁকেছেন সব কাঠখোদাই আর চারকোলে। সাদাকালো ছবি। কলকাতার রাস্তায় তখন মুর্দাসাফ গাড়ি দেখেছেন অনেকেই। কিন্তু তাঁরা কেউ ঠিকঠাক জানেন না, সেই গাড়ির রং কী ছিল। কিন্তু আমাদের এই হাসপাতালে ফ্রিজিং লাশবাহী গাড়িগুলোর রং ঝকঝকে সাদা, তার ওপর কমলা রঙের লেখাটা, বড় বড় স্পষ্ট অক্ষরে লেখা ‘লাশ’ শব্দটা। বুক হিম হয়ে যায় দেখলেই। বহু দিন পর কেউ যদি এই মহামারি নিয়ে ছবি আঁকেন, তবে এই গাড়ি তাঁকে আঁকতে হবে। লম্বাটে রেডিয়েটার। গোল গড়নের কেবিনযুক্ত ঘর ভেতরে লাশের জন্য। আর জোরা উইন্ডস্ক্রিন। ড্রাইভারের মুখ ভাবলেশহীন। দূর থেকে আলাদা করা যায় এই গাড়ি। এই গাড়ি দেখলেই অন্য গাড়ি, ভ্যান বা মানুষ যা–ই থাকুক, তাকে পথ করে দেয়। সামনে থেকে গাড়িটা নিরীহ দেখতে। বেডফর্দের সামনের ডালার গড়নটা কুকুরের মুখের মতো ছিল, এটা তা নয়। বনেটের ওপরে লেজঅলা ইগল পাখির মতো দেখতে। আম্মাকেও শেষে এই গাড়িতে ওঠানো হলো। যদিও মনে হচ্ছিল এক্ষুনি আম্মা গোলাপি ফুল আঁকা শাড়িটা পরে পায়ে স্যান্ডেল পরে নেমে আসবেন। বলবেন, ‘আমারে কই নেও?’

করোনায় মৃত্যুর কিছুক্ষণ পর মানুষের দেহনির্গত বিশিষ্ট অম্লগন্ধের সঙ্গে নানাবিধ জীবাণুনাশক ঔষধের মিশ্রণে একটি অদ্ভুত অচেনা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।

সব মাহমারিরই বুঝি একটা করে নতুন গন্ধের ইতিহাস থাকে। যে গন্ধ অতীতের আর কোনো গন্ধের সঙ্গে মেলে না।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]