এক নিস্পৃহ মৃত্যুর দিনে…

মুশতাক আহমেদের মরদেহ নিয়ে বাসায় ঢোকা লাশবাহী গাড়ি
ছবি: প্রথম আলো

মৃত্যু নাকি হত্যা? কেউ বলছেন প্রথমটা, কেউ জোর দিচ্ছেন দ্বিতীয় শব্দে। আসল কথা হলো, একটা মানুষ মারা গেছেন এবং সেই মৃত্যুর দিকে অভিযাত্রায় আশপাশের সব পক্ষের নিস্পৃহভাব ছিল কমবেশি। শুধু মৃত্যুর পরই হয়তো তাতে আবেগ ও শঙ্কার উত্তুঙ্গ জোয়ার এসেছে। তবে কি আমরা সবাই চমকিত হতে মৃত্যুর অপেক্ষায়ই থাকব?

যদি সেটিই প্রচলিত নিয়মে পরিণত হয়, তবে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসা প্রয়োজন। একটু জানা থাকা আর কি! তাতে আবেগ প্রকাশে পরিমিত থাকার সুযোগ মেলে। ঝোপ বুঝে কোপ মারা যায়। যদি ঝোপের দুনিয়ায়ই বাঁচতে হয়, তবে কোপের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে বৈকি। অনেক আইনি বিধিনিষেধ আছে তো, তাই একটু সাবধান থাকা। নির্বিবাদী জীবন কে না চায়? শুধু মুখ খুলে কি আর মাথা খোয়ানোর ঝুঁকি নেওয়া পোষায়?

ঝঞ্ঝাটের প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন না হয় একটু সবিস্তারে যাওয়া যাক। আচ্ছা, রাস্তায় কীভাবে হাঁটেন? গর্ত দেখলেও কি পা বাড়ান? আনমনে হয়তো পা পড়ে কখনো কখনো। পরক্ষণে হোঁচট খেলেই মনে হয়, ‘কী করলাম!’ একটু দেখেশুনে চলার পরামর্শ আসে মনের গহীন থেকে। তাতে ভুল করার আফসোস থাকতে পারে, তবে তীব্র অপরাধবোধের সৃষ্টি হওয়া কিছুটা অস্বাভাবিক। এখন অবশ্য সেটিই বেশি হয় এবং অতি অবশ্যই বেঁচে থাকার স্বার্থে। ভুল করার ভয়, বাধ্য হয়ে ঠিককেও ভুল ভাবার অনাকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছা, ঠোঁটে ব্যথা পাব বুঝেও স্ট্র্যাপলার মেশিনে ওই জোড়ায় ধাতব বন্ধন তৈরি করা, আশপাশের নানা ঘটনায় চোখ দুটোতে ঠুলি পরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি এখন আমাদের রোজকারের অভ্যস্ততা। এতেই খুঁজতে হচ্ছে জীবনের সূত্র।

সমীকরণের হিসাবে বৈজ্ঞানিকভাবে ‘প্রমাণিত’ তকমা না জুটলেও তাতে ক্ষতি নেই। পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরলে কি আর এসে গেল?

ওহ হ্যাঁ, একজন মানুষ মারা গেছেন। ফের মনে পড়ল। তিনি লেখক ছিলেন। নাম মুশতাক আহমেদ। না, আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় ছিল না। তা-ও তাঁর মৃত্যুর খবরটা শোনার পর থেকে কেমন যেন ভয়ংকর অস্বস্তি হচ্ছে। স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে বন্দীর মৃত্যু। না কি…? অবাধ্য ঠোঁট মুক্ত হতে চাইছে। কিন্তু ওই যে, ভয়! আমি তো ‘ছাপোষা’, ‘আইন মানা’, ‘সচেতন’ নাগরিক। মুখের কুলুপ খুলে অকপট হওয়া কি আর সহজ কাজ? তাই বারবার এড়িয়ে যাওয়ার অব্যর্থ চেষ্টা চলছিল, নিজের সঙ্গে নিজের। কিন্তু কেন জানি আর লড়াই চালানো গেল না। কখনো কখনো হার মানাই বোধ হয় ভবিতব্য, অন্তত নিজের অসহায়ত্বকে আয়নায় দেখা যায়।

বছর ছয়েক আগে আরেক লেখক ব্যক্তির মৃত্যুতে এতটা অসহায় বোধ হয়েছিল। তাঁর নাম ছিল অভিজিৎ রায়। ঢাকায় বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় চাপাতির কোপ তাঁকে কেড়ে নিয়েছিল। সেদিনও খুব রাগ হয়েছিল, জানেন! তবে এবারের পার্থক্য হলো, হাই সিকিউরিটি জেল। সেভাবে হিসাব মাথায় নিলে বলা যায়, আগের মৃত্যুতে নিরাপত্তা ছিল না, অরক্ষিত ছিল। আর এবার মৃত্যু নিরাপদে এসেছে।

ওহ হ্যাঁ, একজন মানুষ মারা গেছেন। ফের মনে পড়ল। তিনি লেখক ছিলেন। নাম মুশতাক আহমেদ। না, আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় ছিল না। তা-ও তাঁর মৃত্যুর খবরটা শোনার পর থেকে কেমন যেন ভয়ংকর অস্বস্তি হচ্ছে। স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে বন্দীর মৃত্যু। না কি…? অবাধ্য ঠোঁট মুক্ত হতে চাইছে। কিন্তু ওই যে, ভয়! আমি তো ‘ছাপোষা’, ‘আইন মানা’, ‘সচেতন’ নাগরিক। মুখের কুলুপ খুলে অকপট হওয়া কি আর সহজ কাজ?

একটু ভেবে বলুন তো, লিখে আসলে কী হয়? হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়? নাকি কারও প্রাণ যায় সরাসরি? কারও প্রত্যক্ষ ক্ষতি হয় কি? নাকি লেখকেরা খুনি আসামির চেয়েও ভয়ংকর?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকুন। খোঁজা জরুরি, আবার সময়ও কাটে। একটা বিষয়ের ভালো-মন্দ বোঝার প্রয়োজন আছে। ভুল যদি হয়েই থাকে, জানতে তো হবে! উত্তর ইতিবাচক হলে নাহয় সব কলম পুড়িয়ে ফেলা যাবে এক লহমায়! ভাবমূর্তির উজ্জ্বলতা রক্ষায় এতটুকু করা নিশ্চয়ই নৈতিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে।

মুশতাক আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

আচ্ছা, কোন কোন শব্দ লিখতে গেলে কোট–আনেকাট চিহ্ন বসালে নিরাপদে থাকা যায়? এর কোনো সঠিক অভিধান থাকলে দোকানের ঠিকানাটা দেবেন দয়া করে।

আমাদের সবারই এখন তা প্রয়োজন বটে। ওই অভিধানের হাজার হাজার, লাখ লাখ কপি দরকার। নির্ঝঞ্ঝাটে বেঁচে থাকার এমন টোটকা এ যুগে সবচাইতে কাঙ্ক্ষিত কিনা!
খবরে জানা গেছে, মৃত লেখকের দেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। খুব ভালো খবর। আমরা সত্যিই খুশি। যা চোট গেছে, মনের ওপর দিয়েই গেছে। আঘাতের চিহ্ন আর বাইরে আসেনি। এতদ অঞ্চলের লেখকদের জীবনে এ–ও অনেক বড় পাওয়া।

শেষটায় কবির কাছে যাই। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন,
‘ফুলের পোশাকে ঢাকা শরীর, দারুণ মাংশভুক পাখি,
ওই শকুন, ওই হিংস্র গোপন নোখজুড়ে থাকা শত্রু-স্বভাব,
আমাদের দিন থেকে খেয়ে যাবে প্রিয়তম রোদের মাংশ। …’
খেয়ে নিক। প্রিয়তম রোদ হাড্ডিসার হোক। দধীচির শ্বেতশুভ্র হাড়েই একদিন হয়তো মিলবে ঝলসানো রোদ।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]