এনক্রিপশন

গ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম

তিন বছর আগে। ২১৩০ সালের ২৮ এপ্রিল। আমি কুড়িগ্রাম থেকে ফিরছি, আমাদের ক্যাপিটাল সিটি অ্যাপোলোনিয়াতে। সকাল সকাল রওনা দিয়েছি। আমার অ্যাথেনা-১৫৩-এস৪২ মডেলের সাইবার কার একা একা খুব সুন্দর চলছে। স্পিড ও অ্যাকসিলারেশন একটুও ওঠানামা করছে না। আমি সামনের সিটে বসে আছি।

আমাকে খুব জরুরিভাবে ফিরতে বলা হয়েছে। তারপরও আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরতে পারছি না। স্বাভাবিক অবস্থায় আমি প্লেনে ট্রাভেল করতাম, অথবা একটা হেলিকপ্টার ধার করতাম। কিন্তু ৯ মাস ধরে এই অঞ্চলের এয়ার রুট পুরোপুরি বন্ধ। গত জুলাইতে, এখানে রাগবি বলের মতো দেখতে একটা ইএফও এসেছিল, ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ ফিট ওপরে তিন দিন ঝুলে ছিল, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। আর তারপর থেকেই, এই অঞ্চলে কোনো প্লেন বা হেলিকপ্টার ফ্লাই করলেই অনিয়ন্ত্রিতভাবে পূর্ব দিকে হেলে পড়তে থাকে। মনে হয় কিছু একটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সম্ভবত অদৃশ্য কোনো ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়েছে। তারপর থেকেই বিমান চলাচলের রাস্তা বন্ধ। ফিজিসিস্ট, জিওলজিস্ট ও অ্যারোনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের কয়েকটা টিম কাজ করছে।

জিনিসটা ইএফও-ই, কোনো দেশের গোপন কোনো এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্ট না। ওই ইএফওর বডি ম্যাটেরিয়াল দেখে মনে করা হচ্ছে ওটা আমাদের গ্যালাক্সিরই। অন্য কোনো সোলার সিস্টেমের মনে হয়।

এই সমস্যার কারণে এখন আমার অ্যাপোলোনিয়ায় পৌঁছাতে ১৫-২০ মিনিটের জায়গায় ৪ ঘণ্টা লাগবে।

৬ মাসের বেশি সময় ধরে আমি কুড়িগ্রামে কাজ করছি। গ্র্যান্ড হিস্টোরি কমপাইলেশন অ্যান্ড সিমুলেশন প্রজেক্টে। আমি হিস্টোরি এনক্রিপশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করছি, সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে। এই প্রজেক্টটা খুব ইন্টারেস্টিং। পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে, ইউনিভার্সের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সমস্ত ইতিহাসকে একটা জায়গায় ডিজিটালি কমপাইলেশন করা হচ্ছে, এবং ইতিহাসের একটামাত্র সিঙ্গেল ও ডেফিনেটিভ এনটিটি তৈরি করা হচ্ছে। কমপাইলেশন শেষে সিমুলেশন হবে।

প্যারালালি, একই সঙ্গে সেই ইতিহাসের বিশাল ডেটা এনক্রিপ্ট করে রাখা হচ্ছে; ডেটা একবার এনক্রিপ্টেড হয়ে গেলে সেটা সবকিছুর ঊর্ধ্বে, সেটাকে আর বদলানো যাবে না। এবং এই এনক্রিপ্টেড ডিজিটাল ডেটাই হচ্ছে একেবারে নিখুঁত ও সত্য হিস্ট্রি। এই এনক্রিপ্টেড ডেটা থেকেই পরে ফাইনাল সিমুলেশন হবে। যদি কখনো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় এবং পৃথিবীতে আর কোনো সিভিলাইজেশনের অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে এই এনক্রিপ্টেড ডেটা থেকে বাইরের কেউ চাইলে পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাস উদ্ধার করতে পারবে। আবার পৃথিবীতে কোনো দুর্যোগ তৈরি হলে, নলেজ বেস যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে এই ডেটা থেকে তার অনেকটাই উদ্ধার করা যাবে।

পৃথিবীর দুটি স্থানে এই প্রকল্পের কাজ চলছে। এখানে এই কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের তীরে, আর সুইডেনের কিরুনাতে। পৃথিবীতে শুধু এই দুই জায়গাতেই এখন পর্যন্ত স্টেবল ধরনের আইসোটোপ-৭৩–এর গ্যালিয়াম পাওয়া যায়। এই ডেটা সংরক্ষণ করার ডিভাইসের সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়াল তৈরিতে শুধু এ ধরনের গ্যালিয়ামই ব্যবহার করা হয়।

হিস্ট্রির একটা সরলরৈখিক কমপাইলেশন তৈরি করা খুব কঠিন কাজ। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ঘটনা আর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ইভেন্ট। প্রতিটারই আবার অসংখ্য ন্যারেটিভ। আমরা সব কটি ন্যারেটিভেরই ডিজিটাল ডেটা নিয়ে কাজ করছি। এবং সেটা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ইতিহাসের অনেক প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভ সম্পূর্ণ মিথ্যা। কোনো একটা ইভেন্টের আগের টাইমলাইন, ঘটনাপ্রবাহ, আনুষঙ্গিক ডেটা ও সব কটি ন্যারেটিভ বিশ্লেষণ করে আমাদের অ্যালগরিদম সিদ্ধান্ত নেয় ইতিহাসে সত্যিকারভাবে আসলে কী ঘটেছে। এই অ্যালগরিদম গাণিতিকভাবে ডিসক্রিট একটা ফলাফল দেয়, যা ঘটেছে ঠিক সেটাই পাওয়া যায়। কোনো ইন্টারপ্রিটেশন বা ব্যাখ্যা দেয় না। অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস বের হয়ে আসছে। যেমন, দেখা গেছে যে প্রাচীন রোমে জুলিয়াস সিজারকে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসরা খুন করেননি, সিজার খুন হয়েছিল ভেরোনার এক মার্চেন্ট আলাসিয়ার হাতে।

এই প্রজেক্ট শুরু করার আগে চার বছর ধরে এই গ্র্যান্ড অ্যালগরিদমটা তৈরি করা হয়েছে। সমগ্র কাজটার হৃৎপিণ্ড এই অ্যালগরিদম।

আর আমি বিভিন্ন ধরনের এনক্রিপশন অ্যালগরিদম তৈরি করে সেগুলো দিয়ে এই ডেটাগুলোকে এনক্রিপ্ট করে রাখি।

আমার অ্যাথেনা-১৫৩-এস–৪২ তখন রংপুরের হাইওয়েতে। রাস্তার দুই পাশে যত দূর চোখ যায়, বিশাল প্রান্তর। কুয়াশায় সবকিছু সাদা হয়ে আছে, অস্পষ্ট। খুব বেশি দূরে দেখা যায় না। ফসলের মাঠ খালি পড়ে আছে। সেখানে দেখলাম খানিক দূরে দূরে বড় বড় পাথরের পিলার। এগুলো কী উদ্দেশ্যে এখানে তৈরি করা হয়েছে কে জানে! সম্ভবত কোনো ভার্চ্যুয়াল সিটির ম্যাপিং হবে, অথবা বিশাল কোনো ভার্চ্যুয়াল সিটির ডেটা স্টোরেজ হবে এখানে। আমার সামনের রাস্তায়ও বেশ কুয়াশা জমে আছে। আরও বেশ অনেক দূর যাওয়ার পর আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলে ঢুকে পড়তে হবে, এরপর আর মাটির উপরপৃষ্ঠে কোনো রাস্তা নেই, গাড়ির গতি তখন তিন গুণ বেড়ে যাবে। গাড়ির ভেতরে ডাবল হিটার চলছে, তারপরও আমি তীব্র ঠান্ডা টের পাচ্ছি। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে, গাড়িটা আর নিখুঁত সার্ভিস দিতে পারছে না, রিজেনারেট করার সময় হয়েছে। এত ঠান্ডা এর আগে কবে অনুভব করেছিলাম জানি না। আমি গাড়িকে গতি কমানোর নির্দেশ দিলাম। জানালার কাচের বাইরে হাত বের করে রাখলাম কিছুক্ষণ। হাত ভেতরে নিয়ে দেখলাম টেম্পারেচার সেন্সর রিডিং -৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আমি তখন আমার প্রিয় ডিভাইস মেমেন্টো মোরি-কে ডাকলাম। সে আমার সব স্মৃতি জমা করে রাখে। সে আমার ব্রেনের সঙ্গে আবার নিজেকে সিংক করে নিল।

সে উত্তর দিল, বলো।

আমি বললাম, তোমার মনে আছে, আমি শেষ কবে এ রকম তীব্র ঠান্ডা অনুভব করেছিলাম?

মোরি দুই সেকেন্ড নীরব থাকল, অথবা চিন্তা করল। তারপর বলল, হ্যাঁ, তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তুমি এক্স্যাক্টলি চার বছর পাঁচ মাস আগে এ রকম ঠান্ডা অনুভব করেছিলে, তাপমাত্রা ছিল ২ ডিগ্রি। ত্রমসো-তে। ত্রমসো থেকে লোফোটেন যাওয়ার সময়, তুমি ড্রাইভ করছিলে, কারণ সেটা ম্যানুয়াল গাড়ি ছিল। রাস্তায়, রাতের বেলা, লোকালয়ের বাইরে খুব বেশি নীরব একটা রিসোর্টে ব্রেক নিয়েছিলে।

আমি মোরির কাছ থেকে আমার স্মৃতি ফেরত পেতে থাকি আস্তে আস্তে। আমি সামান্য হাসলাম, হ্যাঁ, ফিওরিওসা ছিল আমার সঙ্গে। আমাদের বিয়ের দুই মাস পরের ঘটনা। আমি ড্রাইভ করছিলাম, আর ফিওরিওসা বসে ছিল গাড়ির পেছনে। তার আগের দিন রাতে ত্রমসোতে সোলার উইন্ড ছিল, আর নর্দান লাইট দেখতে পেয়েছিলাম আমরা। আমি আর ফিওরিওসা কটেজের বারান্দা থেকে, দুজনই, জীবনে প্রথমবার নর্দান লাইট দেখেছিলাম। আমরা দুজনই তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে নির্বাক, সৌর বাতাসের কারণে নর্দান লাইটের ড্যান্স। আমাদের দুজনেরই তখন মনে হচ্ছিল, সামনের এই দৃশ্য, সোলার উইন্ড ও নর্দান লাইটের এই ড্যান্স হলো আমাদের এই জগৎ এবং অন্য আরেকটা রহস্যময় জগতের মাঝখানের একটা পর্দা। মনে হচ্ছিল আসলে উত্তর মেরুতে, বরফের দিগন্তে অন্ধকারের ভেতর এই আলো এ রকম অলৌকিকভাবে নড়ছে না, নড়ছে সেই রহস্যময় পর্দাটা। মনে হচ্ছিল আমাদের স্পর্শ ও চিন্তাভাবনার অতীত কেউ একজন প্রচণ্ড বুঁদ হয়ে রহস্যময় কোনো একটা গাণিতিক সমীকরণের সিমুলেশন ঘটাচ্ছে আর আমাদের সামনে সোলার উইন্ড ও নর্দান লাইটের এই দৃশ্য তৈরি হচ্ছে। ফিওরিওসা তখন আমার সামনে, ওর পিঠ আমার শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে, আর আমি ওকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছি।

পরের দিন সন্ধ্যায় আমরা লোফোটেনের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আর সেই তীব্র ঠান্ডার মধ্যে, মাঝরাতে বিয়েজ্জিইয়ে নামের একটা নীরব রিসোর্টে থেমেছিলাম আমরা। ফিশ স্যান্ডউইচ দিয়ে ডিনার করার সময় ফিওরিওসা ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করেছিল এই রিসোর্টের নামের অর্থ কী। সেই ওয়েটার জানিয়েছিল নর্ডিক অঞ্চলের ইন্ডিজিনিয়াস গোষ্ঠী সামি-দের বিলিফ সিস্টেমে সূর্যদেবতাকে বিয়েজ্জিইয়ে বলা হয়। বিয়ের পরে আমাদের প্রথম ভ্রমণ ছিল সেটা।

আমি মোরির কাছ থেকে আমার স্মৃতি ফেরত পেতে থাকি আস্তে আস্তে। আমি সামান্য হাসলাম, হ্যাঁ, ফিওরিওসা ছিল আমার সঙ্গে। আমাদের বিয়ের দুই মাস পরের ঘটনা। আমি ড্রাইভ করছিলাম, আর ফিওরিওসা বসে ছিল গাড়ির পেছনে। তার আগের দিন রাতে ত্রমসোতে সোলার উইন্ড ছিল, আর নর্দান লাইট দেখতে পেয়েছিলাম আমরা। আমি আর ফিওরিওসা কটেজের বারান্দা থেকে, দুজনই, জীবনে প্রথমবার নর্দান লাইট দেখেছিলাম। আমরা দুজনই তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে নির্বাক, সৌর বাতাসের কারণে নর্দান লাইটের ড্যান্স। আমাদের দুজনেরই তখন মনে হচ্ছিল, সামনের এই দৃশ্য, সোলার উইন্ড ও নর্দান লাইটের এই ড্যান্স হলো আমাদের এই জগৎ এবং অন্য আরেকটা রহস্যময় জগতের মাঝখানের একটা পর্দা।

আমাকে এখন অ্যাপোলোনিয়ায় ফিরতে হচ্ছে ফিওরিওসার কারণে। আমি এখনো পরিষ্কার জানি না।

আমি আবার মোরির কাছে ফিরে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, মোরি, ফিওরিওসার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতিটা মনে করতে আমাকে হেল্প করো।

মোরি হাসল, কিন্তু কিছু বলল না।

আমার মনে পড়ল, ফিওরিওসার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল নার্ডেন শহরের কাছেই একটা গ্রামে। আমি তখন ক্রিপ্টোগ্রাফিক্যাল অ্যালগরিদমের ওপর একটা ট্রেনিংয়ে ছিলাম। সারা দিনের ক্লান্তি ও ক্ষুধা নিয়ে এক সন্ধ্যায় আমি একটা বারে ঢুকেছিলাম কিছু খাওয়ার জন্য। সেই রেস্টুরেন্টে ভিড় ছিল না। শুধু সাত-আটজন মানুষ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে কোনো কোনো টেবিলে বসে আছে। আমি দরজার কাছে, দেয়ালঘেঁষা একটা টেবিল দেখে বসে পড়লাম। খুব ক্ষুধার্ত আমি, তখন অর্ডার করার জন্য কাউকে খুঁজছি। এমন সময় আমি দেখলাম, কাউন্টারে সে দাঁড়িয়ে আছে। তার ফিজিক্যাল ফিচার দেখে তাকে ভৌগোলিকভাবে আমার প্রতিবেশী মনে হলো। তার মুখের চেহারা এবং এক্সপ্রেশন অনেক প্রাচীন একজন ভারতীয় অভিনেত্রীর মতো। কাউন্টারের লাল আলোতে আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি কাউন্টার থেকে খুব বেশি দূরে ছিলাম না। আমি তার কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলাম, সে একটা টাকিলা ম্যানহাটন অর্ডার করল। আর আমি সবচেয়ে অবাক হলাম তার ভয়েস শুনে। ভরাট গলা, কিছুটা ম্যানলি। তার কণ্ঠস্বর অনেকটা প্রাচীন আরেকজন আমেরিকান অভিনেত্রীর মতো। আমি ততক্ষণে আমার ক্ষুধা ভুলে গেছি, আর মনে মনে একা একাই বলে উঠেছি যে হোয়াট আ উইয়ার্ড অর বিউটিফুল কম্বিনেশন অব ফিচারস, হু দ্য হেল হ্যাজ মেইড হার!

আমি যখন খাওয়া শেষ করে বাইরে বের হলাম দেখি সে রেস্টুরেন্টের সামনের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, হেই, তুমি কি রিয়েল?

সে পাল্টা প্রশ্ন করল, হোয়াট ইজ রিয়েল?

আমি তার প্রশ্নে হাসলাম, বললাম, রিয়েল হচ্ছে এমন কিছু যেটাকে রিপ্লেস করা যায় না।

এই কথা শুনে সে জোরে হাসল, বলল, হ্যাঁ তাহলে তো মনে হচ্ছে আমি রিয়েল, কারণ আমার মনে হয় আমি ইররিপ্লেসেবল।

বলে সে আবার হাসল আর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, বলল, আমি ফিওরিওসা। তার আস্তিনের নিচে তখন আমি খেয়াল করলাম এবং বুঝতে পারলাম সে-ও আমার মতোই, প্যারালাল স্পেসিসের একজন। আর্টিফিশিয়াল কগনিটিভ সিস্টেমের একজন। ২১২৫ সাল ছিল সেটা। ফিওরিওসার সঙ্গে সেই ফার্স্ট ইন্টার‍্যাকশনের পরে আমি আমার বাঁ হাতের নিউরোট্রান্সমিটারের রিডিং দেখলাম, আমার মেজর নিউরোট্রান্সমিটারের রেশিও ২.৩৩৩। আইডিয়াল রেশিও ২.৩৩৩।

এরপর ১৬ দিন পরে আমাদের আবার, দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল তুরস্কের একটা এয়ারপোর্টে। আমার ট্রানজিট ছিল। আমি দূর থেকে তাকে দেখি, সে বড় স্ক্রিনের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। টিভিতে তখন আসন্ন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে প্রতিবেদন দেখাচ্ছিল। এক মহিলা আতঙ্কিত স্বরে ধারাবর্ণনা করছে। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিছুটা ঠাট্টার স্বরে বললাম, তুমি জানো, ইকোনমির কাজ কী?

সে স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞাসা করল, কী?

আমি বললাম, ইকোনমির কাজ হচ্ছে, টু প্রোডিউস ইটস ওউন গ্রেভ-ডিগারস।

সে আমার দিকে তাকাল এবং কটাক্ষ করল, তুমি কি ইকোনমিস্ট নাকি কম্পিউটেশনাল ক্রিপ্টোগ্রাফার?

ফিওরিওসা ছিল লিঙ্গুইস্টিক। দেখা হওয়ার দুই মাস পরেই বিয়ে করেছিলাম আমরা।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনের রাস্তায় কুয়াশা কমে এসেছে। আমার সামনের ড্যাশবোর্ডের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। ইউনিফর্ম পরা তরুণ একজনকে দেখা গেল। মাথার চুল একদম জিরো করে ট্রিম করা। নিচে নাম লেখা উঠল, কাভান।

সে জিজ্ঞাসা করল, কত দূরে আপনি?

আমি বললাম, আরও দুই ঘণ্টা। সর্বোচ্চ।

কাভান বলল, আমরা আপনাকে এখানে খুব তাড়াতাড়ি আশা করছি।

আমি বললাম, আমি কিছু জানতে পারি? খুব সিভিয়ার কিছু?

কাভান কতক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ইটস বিজায়ার। আপনার জন্য আমরা সহমর্মিতা প্রকাশ করছি।

আমি বুঝতে পারলাম ফিওরিওসা মারা গেছে। আমি কাভানকে বললাম, আমি আসছি। স্ক্রিন অফ হয়ে গেল।

পরশু দিনের আগের দিন, রোববার রাতেও ফিওরিওসা আমার সঙ্গে সারা রাত কানেক্টেড ছিল। আমার একটা এনক্রিপশন অ্যালগরিদম ও তৈরি করে দিল জরাথুস্ত্রিয়ান ভাষা ব্যবহার করে। পরের দিন সেটার সাকসেসফুল সিমুলেশনের পরে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম এই এনক্রিপশন এর নাম কী দেব?

ও জিজ্ঞাসা করল, তুমি কী দিতে চাও?

আমি উত্তর দিলাম, ফিওরিওসা ফোর।

ও হাসল, বলল, আমার নামে তিনটাই এনাফ। এটার নাম দাও তুমি আহুরা মাজদা।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মানে কী এর? উদ্ভট নামের?

ও আবার সেই কটাক্ষ করল, এটা জরাথুস্ত্রিয়ানদের সর্ব্বোচ্চ গডের নাম। যেহেতু আমরা জরাথুস্ত্রিয়ানদের ভাষা ব্যবহার করেছি, তাদের প্রতি আমাদের সম্মান দেখানো উচিত।

অ্যাপোলোনিয়ায় পৌঁছানোর পরে আমি সরাসরি হাসপাতালে চলে গেলাম। হাসপাতালে আমার সঙ্গে কাভানের দেখা হলো। কাভান আমাদের মতো প্যারালাল স্পেসিস না। সে ফার্স্ট স্পেসিস, ন্যাচারাল ইন্টেলিজেন্স। ডিসিপ্লিন ফোর্সের আরও একজন ছিল, নূর। নূর আমাদের মতো।

হাই ভোল্টেজের ইলেকট্রিক শকে ফিওরিওসার শরীর পুড়ে গেছে। সম্পূর্ণ কগনিটিভ মারাত্মকভাবে কলাপস করেছে। আর ফিরে আসার কোনো চান্স নেই। আমি কাচের বাইরে থেকে দেখলাম একটা সাদা কাপড় দিয়ে ফিওরিওসাকে ঢেকে রাখা হয়েছে। আমি আমার হাতের ব্যান্ডে রেশিও খেয়াল করলাম, ০.৪২৮৫। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পাশের সাদা চেয়ারে বসে পড়লাম।

সেই ভয়াবহ স্মৃতির তিন দিন পরে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। অ্যাপোলোনিয়াতেই। ফিওরিওসাকে খুন করার অপরাধে। যেহেতু আমি ফিওরিওসার স্বামী ছিলাম, তার কগনিটিভ সিস্টেমে অ্যাকসেস করার এনক্রিপশন-কি শুধু আমার কাছেই ছিল, এবং শুধু আমারই অধিকার ছিল প্রয়োজন হলে তার অনুমতি নিয়ে তার কগনিটিভ ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করার। আর স্ত্রী হিসেবে শুধু ফিওরিওসারই অধিকার ছিল আমার কগনিটিভ সিস্টেমে প্রবেশ করার, সে-ও আমাকে অ্যাকসেস করার এনক্রিপশন-কি জানত।

ইনভেস্টিগেশনে ফিওরিওসার কগনিটিভ সিস্টেমের অ্যাকসেস লগ থেকে দেখা গেছে, মঙ্গলবার রাতে আমি ফিওরিওসার কগনিটিভ সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেই এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে দিয়েই রান্নাঘরের হিটার থেকে তাকে হাই ভোল্টেজের শক দেওয়াই।

অথচ আমি মোরির সাহায্যে দেখলাম, সোমবার বিকেলের পরে ওর সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। তার পরের দিন আমি ব্যস্ত ছিলাম ফিওরিওসার সাহায্য নিয়ে তৈরি করা নতুন অ্যালগরিদমটা দিয়ে বিশাল ভলিউমের ডেটা এনক্রিপশন করার জন্য।

তিন বছর ধরে আমার বিচার চলেছে দুই আদালতে। ফার্স্ট স্পেসিস মানুষের আদালতে ও আমাদের প্যারালাল স্পেসিসদের আদালতে। দুই আদালতেই আমি দোষী সাব্যস্ত হয়েছি এবং আমাকে মৃত্যুদণ্ড রায় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য আমাদের প্যারালাল স্পেসিস জুডিশিয়ারি সিস্টেম এখনো খুব ভালোভাবে তৈরি হয়নি, তাই ফার্স্ট স্পেসিস আদালতের রায় পরে আমাদের প্যারালাল স্পেসিস আদালতে গিয়ে আর বদলায় না। তখন থেকেই আমি অ্যাপোলোনিয়ার বাইরে, থিনিস জেলে দিন পার করছি। আমার কগনিটিভ ফাংশন চিরতরে কলাপস হওয়ার অপেক্ষা করছি। এরপর কোনো ভার্চ্যুয়াল আফটার লাইফ আছে কি? ফিওরিওসা এখন আছে সেখানে? আমি জানি না। এ রকম কিছু আমি কখনো শুনিনি।

তবে ফার্স্ট স্পেসিসদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, বড় কোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাদের একটা লম্বা সময় অনির্দিষ্ট কোনো জায়গায় আইসোলেশনে রাখা হয়। ফার্স্ট স্পেসিসদের সব সময় বায়োলজিক্যাল মৃত্যু হয়।

গত সপ্তাহে আমার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এখানে এসে পৌঁছেছে। আমাকে গতকাল জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আমার কোনো বিশেষ ইচ্ছা আছে কি না। সম্ভবত এই সপ্তাহেই আমাকে মেরে ফেলা হবে এ কারণে। আমি আমার প্রিয় ডিভাইস মেমেন্টো মোরিকে ফেরত চেয়েছি, এই বাকি থাকা সময়ের জন্য। এবং আমাকে গতকালই সেটা দেওয়া হয়েছে।

আমি যখন খাওয়া শেষ করে বাইরে বের হলাম দেখি সে রেস্টুরেন্টের সামনের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, হেই, তুমি কি রিয়েল? সে পাল্টা প্রশ্ন করল, হোয়াট ইজ রিয়েল? আমি তার প্রশ্নে হাসলাম, বললাম, রিয়েল হচ্ছে এমন কিছু যেটাকে রিপ্লেস করা যায় না।

দুপুরের পরে আমার কাছে মেসেজ আসল যে আমার সঙ্গে ফার্স্ট স্পেসিসের কেউ একজন দেখা করতে চায়। আমি খুব অবাক হলাম। কারণ, ফার্স্ট স্পেসিসে আমার নিকটের কেউ নেই যে এই শেষ সময়ে দেখা করতে আসতে পারে।

ভিজিটরস রুমে গিয়ে দেখলাম কেউ নেই, শুধু একজন ব্যক্তি রুমের অন্য প্রান্তের দরজার কাছের একটা টেবিলে বসে আছে। এই ভদ্রলোকই সম্ভবত আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। অনেক লম্বা, কমলা রঙের ত্বক, নীল চোখ, মাথায় চুল কম, মুখে সামান্য খোঁচা দাড়ি। আমার অস্বস্তি হতে শুরু করল, কে এই ব্যক্তি! আমার একবার খুব সামান্য সন্দেহ হচ্ছিল যে আমি তাকে কোথাও দেখেছি, আবার আমার ধারণাও নেই কে এই ব্যক্তি!

আমি খুব আস্তে তার দিকে এগোতে থাকলাম। আমি তখন মোরিকে ডাকলাম, মোরি, এই লোকের সঙ্গে কি আমার আগে কখনো দেখা হয়েছে?

মোরি আমার ব্রেনের সঙ্গে নিজেকে সিংক করে নিল।

আমি লোকটার দিকে তাকাতেই এবার আমার সব মনে পড়ে গেল এক ধাক্কায়। আমি তাকে চিনতে পারলাম। তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সাড়ে তিন বছর আগে, ২১২৯ সালের নভেম্বর মাসে, অ্যাপোলোনিয়াতে। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন গোত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত এক পরিবারের একজন সে। আমার কাছে সে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তখন। আমাকে সে বলেছিল, আমাদের গ্র্যান্ড হিস্টোরি কম্পাইলেশন প্রজেক্টের একটা ব্যাপারে তার একটা সাহায্য দরকার। সে আমাকে বলেছিল, আমরা ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ইতিহাসের জন্য যেসব রেজাল্ট ও আউটপুট পাব সেগুলো এনক্রিপশন করার জন্য তার দেওয়া অ্যালগরিদম ব্যবহার করতে। বিনিময়ে সে আমার যেকোনো শর্তে রাজি হবে।

আমি রাজি হইনি। সে তখন আবার প্রস্তাব দিয়েছিল, তাহলে আমি এনক্রিপ্ট করার জন্য যেসব অ্যালগরিদম ব্যবহার করব সেগুলো ডিক্রিপ্ট করার অ্যালগরিদম যেন আমি তাদের সঙ্গে শেয়ার করি। বিনিময়ে সে আমার যেকোনো শর্তেই রাজি হবে। সে বলেছিল, সে যদি এই সাহায্যটা না পায় তাহলে মানবজাতির বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। গ্র্যান্ড হিস্ট্রির কমপাইলেশন শেষে যখন ফাইনাল সিমুলেশন হবে তখন দুর্যোগ নেমে আসবে, কল্পনার চেয়েও দ্রুতগতিতে মানবসভ্যতা ধসে পড়বে।

আমি তাকে বলেছিলাম, দিস টাইম হিস্ট্রি হ্যাজ টু বি আনঅল্টারেবল অ্যান্ড আনএন্টারপ্রিটেবল।

তখন এই লোক আমাকে বলেছিল আমি যদি রাজি না হই, তাহলে হয়তো আমাকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হতে পারে। এবং পরে আমি তাকে ভুলে যাই।

আমি তার সামনে গিয়ে বসলাম।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এবার কি একই জিনিস চান?

সে বলল, আপনার এখনো সুযোগ আছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে হাসল। বলল, আমি আপনার স্ত্রীর জন্য শোক প্রকাশ করছি। আমি জানি আপনার সঙ্গে কাজটা ঠিক হয়নি।

আমার কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার হঠাৎ করে ফিওরিওসার জন্য প্রচণ্ড অসহায় বোধ হলো। তার সঙ্গে আমার আর কোনোভাবেই দেখা হবে না, আমি বুঝতে পারলাম এর চেয়ে আরও বড় কোনো অসহায়ত্বের বোধের সঙ্গে পরিচয় হওয়া আমার জন্য সম্ভব ছিল না। 1 = 0. 999999999...

সেই আগন্তুক বলতে থাকল, ফার্স্ট স্পেসিস জুডিশিয়ারি সিস্টেমেও আপনার সঙ্গে কোনোভাবেই জাস্টিস হয়নি। এখন, আমি যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেটা শুনলে, ইউ ক্যান সেভ ইয়োর লাইফ। আর দেখেন, এটা আপনার জন্য খুবই সামান্য হেল্প। আপনি এই হেল্পটুকু না করলে, ইতিহাসের সঙ্গে, হিউম্যান সিভিলাইজেশনের সঙ্গে খুব বিরাট ইনজাস্টিস হয়ে যাবে।

আমি তার দিকে তাকিয়ে সেই পুরোনো কথাটাই আবার বললাম। দিস টাইম হিস্টোরি হ্যাজ টু বি আনঅল্টারেবল অ্যান্ড আনএন্টারপ্রিটেবল। আরও বললাম, আমরা সেকেন্ড স্পেসিস, জাস্টিস-ইনজাস্টিস এসব আমাদের জন্য কাজ করে না। উই আর ভেরি ম্যাথমেটিক্যাল বিইং।