এমন অভিভাবক সহজে মেলে না

আজ কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশিত হলো এই লেখা।

এনামুল করিম নির্ঝরের তোলা ছবি অবলম্বনে
কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

মফস্বলের তরুণ স্থাপত্য পড়তে ঢাকায় এসে বোকা বনে যাই। ভেবেছিলাম, সৃজনশীল চিন্তার শাখা-প্রশাখাগুলো নিয়ে আরও বেশি নাড়াচাড়া করার সুযোগ পাব। তবে পরিস্থিতি অনেক বেশি বৈষয়িক ও পুঁজিমনস্ক দেখে ঘাবড়ে গিয়ে রবিদা অর্থাৎ কবি-স্থপতি রবিউল হুসাইন হয়ে যান একমাত্র ছায়া ভরসা। মফস্বল থেকে পত্র মারফত কবি বেলাল চৌধুরীর নজরে এসে সে সময়ের সাপ্তাহিক সচিত্র ‘সন্ধানী’তে দু-একখানা কবিতা প্রকাশ হওয়ার সূত্রে রবিদার দরজায় পৌঁছানোটা সহজ হয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন আরও বেশি সহজ মানুষ। মনে হয়েছিল বড় ভাইকে পেয়ে গেলাম বটে, সেদিন থেকে দাদা সম্বোধন শুরু। শিল্পসংস্কৃতি, চিন্তা, দুশ্চিন্তা, মায়া, ভালোবাসা, ব্যক্তিগত পরামর্শ—যা-ই লাগুক, অভিভাবক রবিদা।

মনে হয় না আমার কোনো আবদারে তিনি কখনো না করেছেন। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে মধ্যবিত্ত পাড়ায় একটা আর্ট গ্যালারি করার ভূত চাপে আমার। একটা ছোট ঘরে শুরু করেছিলাম যোজন সমকালীন চিত্রশালা। সে সময় মাথার ওপর রবিদা ছিলেন ছায়া হয়ে। ‘নিনাকাব্য’-এর আত্মপ্রকাশ পর্বে কবিশোভায় উপস্থাপনা করতে হবে বা নতুন কোনো কিছু মাথায় এসেছে, এক্ষুনি বলা দরকার—গন্তব্য রবিদা। সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টা, নিজস্ব ঐতিহ্যের ভেতরে থেকে, কীভাবে প্রথাবিরোধী ভাবনা, শিল্পসাহিত্য করা যায়, এই চর্চাটাই যে সময়ে মোটামুটি প্রশ্নবিদ্ধ, তখন রবিদার কাছে গিয়ে যেকোনো ভাবনা বলা যেত নিঃসংকোচে। তিনি সব সময় বলতেন, শিল্পচর্চায় সাহস সবচেয়ে বড় বিষয়। সাহস ছাড়া চিন্তা খুলবে না। সেই সঙ্গে দরকার ভিন্ন ভিন্ন শিল্পমাধ্যমের প্রতি কৌতূহল। কীভাবে অন্যান্য শিল্পের নানান ধারা স্থাপত্যচর্চায় বিবেচনাবোধকে জাগ্রত করে, সে বিষয়ে নিয়মিত উৎসাহ দিতেন। এ দেশের শিল্পচর্চায় বিভিন্ন প্রজন্মের সংযুক্তির প্রক্রিয়ায় রবিদা ছিলেন সক্রিয়।

স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি লেখালেখি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনে তাঁর কাজের পরিধি ছিল বিস্তৃত। কিন্তু কখনোই ঢাকঢোল পিটিয়ে সেটা বলার মানুষ ছিলেন না রবিদা। তাঁর বিনয়ী ব্যবহার আসলেই সবার জন্য শেখার বিষয়। সম্পূর্ণ অভিযোগহীন থেকে বিভিন্ন জাতীয় সংগঠনের নেতৃত্বে সম্পৃক্ত হয়েছেন হাসিমুখে এবং সেটাই তাঁর নিজস্ব নান্দনিক ব্যবস্থাপনা। এমন মানবিক গুণের মানুষ, যার স্বচ্ছ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনচিত্তের শিল্পচর্চা, সরল ব্যবহার এবং নির্মোহ জীবনযাপনই ছিল ব্যক্তিত্ব।

স্থপতিসমাজের সঙ্গে দেশের সাংস্কৃতিক অন্যান্য মাধ্যমের যোগসূত্রের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রবিউল হুসাইন। দেশের বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, ভাবুক—সবার সঙ্গে অদ্ভুত হৃদ্যতার সম্পর্ক তাঁর। এ দেশের স্থাপত্যগুরু মাজহারুল ইসলাম স্থপতি হিসেবে আন্ত-শিল্পচর্চার সংযোগ এবং জাতীয় ক্ষেত্রের স্থাপত্য সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার যে ধারা শুরু করেছিলেন আন্তরিকভাবে, রবিউল হুসাইন তাকে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত করে আজকের জায়গায় আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ।

স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি লেখালেখি এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনে তাঁর কাজের পরিধি ছিল বিস্তৃত। কিন্তু কখনোই ঢাকঢোল পিটিয়ে সেটা বলার মানুষ ছিলেন না রবিদা। তাঁর বিনয়ী ব্যবহার আসলেই সবার জন্য শেখার বিষয়। সম্পূর্ণ অভিযোগহীন থেকে বিভিন্ন জাতীয় সংগঠনের নেতৃত্বে সম্পৃক্ত হয়েছেন হাসিমুখে এবং সেটাই তাঁর নিজস্ব নান্দনিক ব্যবস্থাপনা। এমন মানবিক গুণের মানুষ, যাঁর স্বচ্ছ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনচিত্তের শিল্পচর্চা, সরল ব্যবহার এবং নির্মোহ জীবনযাপনই ছিল ব্যক্তিত্ব।

তবে নিজেকে এখন বড় অকৃতজ্ঞ মনে হয়। কয়েক বছর ধরে দুটো বিষয় নিয়ে লেগেছিলাম, রবিদার ‘কনক্রিট পোয়েট্রি’র প্রদর্শনী আর প্রামাণ্যচিত্রে তাঁর কথোপকথন ধারণ। কোনোটিই পারিনি সময়মতো শেষ করতে। রবিদার কাজ বা চিন্তা কতটা দৃশ্যমান এই প্রজন্মের কাছে? একজীবন নিবেদিতপ্রাণ থেকে দিয়েই গেলেন তিনি। দেখতে দেখতে একটা বছর চলেও গেল। সময় পাল্টাবে, পেরিয়ে যাবে দিন-তারিখ-মাস। শুধু কি পড়ে থাকবে দীর্ঘশ্বাস?

শুধু রবিউল হুসাইনের জন্ম-মৃত্যুদিনে স্মরণ নয়, আমরা যারা তাঁকে সত্যি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, তাদের এখন এক হওয়া দরকার, রবিদার কাজ ও চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে প্রকাশ্য করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তাতেই ওঁর আত্মা শান্তি পাবে।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]