কলমের জন্য এলিজি

কলম না কি-বোর্ড, লিখতে কোনটায় স্বচ্ছন্দ বেশি। লেখকদের কেউ বলেন কলম, অনেকেই বলেন কি-বোর্ড। আবার একদল লেখক আছেন, যাঁরা কলম আর কি-বোর্ড—দুই মাধ্যমেই লিখেছেন। কলম ও কি-বোর্ডের দ্বন্দ্ব নিয়ে এই লেখা।

কোলাজ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

কলম আর কি-বোর্ড কি একই কথা বলে? দুটি দিয়েই লেখার অভিজ্ঞতা আছে, এ রকম সবার মনেই সম্ভবত এ প্রশ্ন কখনো না কখনো জাগে। প্রায় ৩০ বছর ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করছি, কি-বোর্ডই হয়ে উঠেছে লেখালেখির প্রধান উপকরণ, দাপ্তরিক কাজ ছাড়া কলমের ব্যবহার প্রায় হয়ই না, তবু আমার ঘরে সাজানো থাকে সারি সারি কলম। তার সঙ্গ এখনো মিস করি আমি। মনে হয়, কলম যেভাবে আমার সঙ্গে কথা বলত, কি-বোর্ড সেভাবে বলে না। কেন মনে হয় এ রকম? এটা কি অভ্যস্ততার ব্যাপার? ছোটবেলা থেকে তো কলম দিয়েই লিখে এসেছি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা তো বটেই, যখন লিখতে শুরু করলাম, তখনো সে-ই ছিল সঙ্গী। ১৯৯৯ সালে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করলাম, কিন্তু লিখে ঠিক সুখ পেতাম না। মনে হতো, আমার চিন্তার সঙ্গে কি-বোর্ড যেন তাল মিলিয়ে উঠতে পারছে না। ভাবতাম, হয়তো টাইপ করার গতি কম বলে এমন হচ্ছে। কিন্তু যখন গতি বাড়ল, টাইপ করতে করতে একসময় অভ্যস্তও হয়ে গেলাম কি-বোর্ডের সঙ্গে, তখনো মনে হতো, হচ্ছে না, ঠিক আগের মতো হচ্ছে না। খুবই অস্বস্তি হতো। ফিরে যেতাম কাগজ-কলমের কাছে, মনে হতো প্রাণ ফিরে পেয়েছি। সময় বদলাতে লাগল, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে একসময় কাগজ-কলম ছাড়তে হলো আমাকেও। এখন আর আগের মতো অস্বস্তিটা নেই, কিন্তু আজও মনে হয়, কলমের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক ছিল, সেই সম্পর্ক কি-বোর্ডের সঙ্গে গড়ে ওঠেনি। অভ্যস্ততার জন্যই যদি কলমের জন্য মন পুড়ে, তাহলে কুড়ি বছর ধরে কি-বোর্ড ব্যবহার করেও কেন অভ্যাস হলো না আমার?

ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় একটা শব্দ ব্যবহার করা হয়—সিংক। খুব জনপ্রিয় শব্দ লিপসিং। ওই যে কণ্ঠশিল্পী গান গাইছেন নেপথ্যে আর নায়ক-নায়িকা ঠোঁট মেলাচ্ছেন পর্দায়, ওটাই লিপসিং। সম্ভবত শব্দটা এসেছে সিনক্রোনাইজেশন থেকে, বাংলায় যাকে সামঞ্জস্যবিধান বলা যেতে পারে। শিল্পীর গানের সঙ্গে নায়ক-নায়িকার ঠোঁট যদি ঠিকভাবে না মেলে, তাহলে দেখতে যেমন বিদঘুটে লাগে, অস্বস্তি লাগে, ঠিক তেমনই চিন্তার সঙ্গে কলম বা কি-বোর্ডের সিনক্রোনাইজেশন নাহলে অস্বস্তি লাগে। মনে হয়, যেমন চাইছি তেমনটি হচ্ছে না। আমার মনে হয়, হাজার বছর ধরে কলম ব্যবহার করার ফলে মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে এর যে রকম সিনক্রোনাইজেশন তৈরি হয়েছিল, কি-বোর্ডের সঙ্গে তা হয়নি। অন্তত আমাদের প্রজন্মের হয়নি। পরের প্রজন্মে হয়তো হবে। যদি না-ও হয়, তারা হয়তো পার্থক্যটা বুঝতে পারবে না। আমাদের মতো অর্ধেক জীবন কলমের সঙ্গে পার করে তারা তো কি-বোর্ড ধরবে না, ধরবে শৈশব থেকেই।

কলমের সঙ্গে সিনক্রোনাইজেশনের ব্যাপারটা আসলে কী রকম? কোনো লেখকই পুরো লেখাটা মাথায় সাজিয়ে লিখতে বসেন না, মোটামুটি সাজিয়ে বসলেও লেখার সময় সেই রূপ আর থাকে না, লিখতে লিখতে নানা চিন্তা আসে, লেখা এগোয় আপন গতিতে, কলম সেই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলত। লেখক বিরতি নিতে চাইলে সে-ও থামত, লেখককে ক্রমাগত ‘লেখো লেখো’ বলে খোঁচাত না। একবার লেখা হয়ে গেলে সেটি পরিবর্তন করাও তো ঝামেলার ব্যাপার ছিল। কাটাকুটি বেশি হয়ে গেলে পুরো পৃষ্ঠাটিই ফেলে দিতে হতো, নতুন করে আবার লিখতে হতো, তারপরও অবশ্য কাটাকুটি এড়ানো যেত না। তাই সতর্কতা থাকত অনেক বেশি, সে জন্য ভাবার জন্য সময়ও নিতে হতো বেশি, তাতে কলমের কোনো আপত্তি ছিল না। প্রেমিকার মতো সে অপেক্ষা করত ভালোবাসা নিয়ে, মমতা নিয়ে। কি-বোর্ডের সেই মমতা নেই। তার কেবল খাই খাই। কেবল ‘গতি বাড়াও, গতি বাড়াও’ বলে দাবড়ানি, যেন পরীক্ষার হলে বসেছি আর মাস্টারমশাই তাড়া দিচ্ছেন ‘সময় শেষ, সময় শেষ’ বলে! ভাল্লাগে না এই অত্যাচার।

শুধু সিনক্রোনাইজেশনই নয়, কাগজ-কলমে লেখার সঙ্গে অনেক রকম স্মৃতিও জড়িয়ে ছিল। লেখার সময় যে কাটাকুটি হয়, সেটিও আসলে অনেক কথা বলে। কী ভেবেছিলাম, কী লিখেছিলাম আর শেষ পর্যন্ত কী রইল, তার স্মৃতিচিহ্ন ধরা থাকত ওই কাটাকুটিগুলোতে। এমনকি কেটে দেওয়া বাক্য থেকে জন্ম নিত নতুন কোনো চিন্তা, কোনো গল্প বা কবিতার পঙ্​ক্তি, এমনকি কোনো উপন্যাসের বীজও। এখন আর সেই চিহ্ন থাকে না। লিখে পছন্দ না হলে অবলীলায় ডিলিট করে ফেলি, কী ভেবেছিলাম, কী লেখা হয়েছিল ওখানে, তা মনেও থাকে না।

আমরা এক যুগসন্ধিক্ষণের প্রজন্ম। আমাদের বেড়ে ওঠা কাগজ-কলমের সঙ্গে। কলমেরও কত রকমফের! একসময় ঝরনা-কলমে লিখেছি; কালির দোয়াত, কালির দাগ, বৃষ্টিতে বা অসাবধানে পড়ে যাওয়া গ্লাসের পানিতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া লেখার মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা—সবকিছুর সঙ্গেই হৃদয়ের যোগ ছিল। তারপর এল বলপেন, কালির ‘ঝামেলা’ ফুরাল তখন, ব্যবহার করো একবার, তারপর ফেলে দাও। বলপেনের সেই রমরমা যুগেও অবশ্য কেউ কেউ কালির কলম ব্যবহার করতেন, আমিও করতাম, হয়তো ওই স্মৃতির কারণেই। একেকটা কলম যেন একেকটা স্মৃতি, একেকটা লেখা যেন একেকটা গোপন ইতিহাস, লেখায় কাটাকুটি যেন একটা শিল্প।

কালির কলমই হোক আর বলপেনই হোক, কাগজ-কলমের বিকল্প যে কিছু হতে পারে, ভেবেই দেখিনি কখনো। টাইপরাইটার ছিল অনেক আগে থেকেই, কিন্তু তার ব্যবহার ছিল সীমিত। দু-একজন লেখক ছাড়া আর কেউ টাইপ রাইটার ব্যবহার করতেন বলে শুনিনি। আমরা তো রীতিমতো বিলাসিতা ভাবতাম ওটাকে। তারপর কম্পিউটার এল, অফিসের ডেস্ক ছেড়ে একসময় বাসায়ও চলে এল এই অদ্ভুত যন্ত্রটি, হয়ে উঠল আমাদের নিত্যসঙ্গী। আমরা চিঠির যুগে বেড়ে উঠেছি। এক এক করে এল মুঠোফোন, ই–মেইল, ফেসবুক, মেসেঞ্জার এবং অনেক রকমের অ্যাপস। ক্ল্যাসিক্যাল জীবন থেকে আমরা প্রবেশ করলাম ডিজিটাল যুগে। অনেক কিছু সহজ হলো। যোগাযোগ সহজ, লেখা সহজ, সম্পাদনা সহজ, সংরক্ষণ সহজ; সবকিছু এত সহজলভ্য হয়ে উঠলে কেন গ্রহণ করব না আধুনিক প্রযুক্তিকে? কিন্তু কী যেন হারিয়ে গেল! দেখা না হলে কথা হওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না, কথা বলার কী তুমুল আকাঙ্ক্ষা ছিল, এখন ফোনে-মেসেঞ্জারে-ভাইবারে-হোয়াটসঅ্যাপে কেবল কথা আর কথা, কথা বলতে বলতে ক্লান্ত, কথা বলার সেই আকাঙ্ক্ষাই হারিয়ে গেল। সেই চিঠির যুগে প্রিয়জনের একটা চিঠির জন্য কী আকুল প্রতীক্ষা ছিল, সেই প্রতীক্ষা হারিয়ে গেল। চিঠি পেলে কতবার যে পড়া হতো! আর তা যদি হতো বিশেষ কারও চিঠি, তাহলে তার গন্ধ শুঁকে দেখা, বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বা বালিশের নিচে রেখে ঘুমানো—কারণ তার স্পর্শ-গন্ধ লেগে আছে ওটাতে; গুরুজনদের গোয়েন্দার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেই চিঠি গোপন কোনো কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা আর মাঝেমধ্যে তা লুকিয়ে পড়া—সবই হারিয়ে গেল। গুরুজনদের চোখে পড়লে প্রলয়কাণ্ড ঘটে যাবে জেনেও কত ঝুঁকি নিতাম, একটা চিঠিও ফেলতাম না। আর এখন, কত সহজেই একটার পর একটা এসএমএস মুছে ফেলি, মেসেঞ্জারের মেসেজ মুছে ফেলি, ই–মেইল ডিলিট করে দিই কিংবা আরও হাজারটা মেইল-মেসেজের আড়ালে সেগুলো গুরুত্ব হারিয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে। সহজলভ্য হয়েছে বটে, কিন্তু মূল্যও কমেছে সবকিছুর। কমেছে আবেগ, স্মৃতি, বিহ্বলতা।

কলম হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে আমাদের অনেককালের চর্চিত সেই সব গোপন সুখ ও আনন্দ, আকুলতা ও বিরহকাতরতা, আকাঙ্ক্ষা ও না পাওয়ার বেদনা। কলমের জন্য এলিজি না লিখে কি পারি?