‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ হাজারো কপি ছাপা হয়েছিল

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখলেন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। কীভাবে লেখা হয়েছিল এই ঐতিহাসিক কবিতা? কীভাবে তা ছড়িয়ে গিয়েছিল মানুষের মুখে মুখে? ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর নেওয়া এই অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সে কথা জানিয়েছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। জানিয়েছিলেন নিজের জীবনের আরও নানান কথা। একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে প্রকাশিত হলো সেই কথোপকথন। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মতিন রায়হান।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী (৭ নভেম্বর ১৯২৭–২৩ ডিসেম্বর ২০০৭)। ছবি: অন্য আলো

মতিন রায়হান: ভাষাশহীদদের নিয়ে প্রথম কবিতা লিখেছেন আপনি। প্রথমে জানতে চাই, কখন থেকে আপনি ভাষা আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন?

মাহবুব: ১৯৪৭ সালেই চট্টগ্রাম কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হলাম। অবশ্য এর আগে ১৯৪২ সালেই মাত্র ১৪ বছর বয়সে আমি ছাত্র কংগ্রেসের সদস্য হই। জড়িয়ে পড়ি ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে। ১৯৪৮ সালে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। তখন আবদুর রহমান সিদ্দিকী পূর্ব বাংলার গভর্নর। [এখানে একটু তথ্যগত বিভ্রাট চোখে পড়েছে যেমন মাহবুব উল আলম চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথানির্ভর ‘স্মৃতির সন্ধানে’ গ্রন্থে জানান যে, ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলার গভর্নর আবদুর রহমান সিদ্দিকী চট্টগ্রাম কলেজ পরিদর্শনে এসেছেন। কিন্তু বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নুন ১৯৫২ সালের ২৫ জুলাই থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে থাকাকালে আবদুর রহমান সিদ্দিকী ভারপ্রাপ্ত গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। তাহলে প্রশ্ন দেখা দেয়, কলেজ পরিদর্শনকালে অর্থাৎ ১৯৪৮ বা ১৯৪৯ সালে কী করে আবদুর রহমান সিদ্দিকী গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন? তাহলে এটা কি সাক্ষাৎকারদাতার স্মৃতির বিভ্রাট?] তিনি আমাদের কলেজ পরিদর্শনে আসেন। একপর্যায়ে কলেজ মিলনায়তনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কটূক্তি করেন এবং আরবি অক্ষরে বাংলা লেখার পক্ষে ওকালতি করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলা হিন্দুর ভাষা। এটা কখনোই রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না।’ তাঁর এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্যে আমার মেজাজ বিগড়ে যায়। আমি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং ইংরেজিতে চিৎকার করে বলি, ‘প্লিজ হোল্ড ইয়োর টাং’। তারপর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান তুলে মিলনায়তন ত্যাগ করি। ছাত্রদের নিয়ে কলেজ প্রাঙ্গণে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদসভা করি। সভায় ধ্বনি ওঠে আবদুর রহমান মুর্দাবাদ’।

মতিন: খুব সাহসের পরিচয় দিলেন! তারপর কী হলো?

মাহবুব: অনুষ্ঠান শেষে গভর্নর তখন অবস্থান করছেন সার্কিট হাউসে। এমন সময় কলেজ প্রিন্সিপাল আবু হেনা—তিনি আমার মামারও শিক্ষক, আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি গেলাম তাঁর কাছে। তিনি বললেন, ‘চলো, তোমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যাব। তুমি ওনার কাছে মাফ চাইবে। তা না হলে আমি তোমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হব।’ আমি সবিনয় তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখান করি। তারপর আমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এখানেই আমার ছাত্রজীবনের অবসান ঘটে। অবশ্য এটা নিয়ে আজ আর আমার কোনো খেদ নেই। তারপর নানা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়ি।

মতিন: ভাষা আন্দোলনে তো আপনার সম্পাদিত মাসিক ‘সীমান্ত’ পত্রিকার একটি ভূমিকা আছে। এ সম্পর্কে জানতে চাই।

মাহবুব: মাসিক ‘সীমান্ত’ প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করি ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে। বাংলা ১৩৫৪ সালের কার্তিক মাসে। প্রথম দুই বছর সহযোগী সম্পাদক ছিলেন সুচরিত চৌধুরী। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২—এই পাঁচ বছরে একটানা ৪৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় রাষ্ট্রভাষার ওপর প্রথম সম্পাদকীয় লেখা হয়। ‘সীমান্ত’ দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা প্রকাশ করি ১৯৫০ সালে। এটি ছিল এক বৈপ্লবিক উদ্যোগ। দুই বাংলায় সংখ্যাটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ‘সীমান্ত’র দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা প্রকাশের জন্য আমাকে কলকাতায় ৪৪ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটে এক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তখন আমার বয়স মাত্র ২৪। এ ছাড়া সীমান্তের আরও দুটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করি। একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন সংখ্যা, আরেকটি বিশ্বশান্তি বিষয়ক। ‘সীমান্ত’র প্রতি সংখ্যায় থাকত বিশ্ববিখ্যাত লেখকদের লেখার অনুবাদ। ফলে পত্রিকাটি হয়ে উঠেছিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক অনন্য সূতিকাগার।

মতিন: কারা ছিলেন এ পত্রিকার লেখক?

মাহবুব: দুই বাংলার সব বিখ্যাত লেখকই ‘সীমান্ত’য় লিখেছেন। আমাদের এখানকার নবীন-প্রবীণ লেখকদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন, কবি জসীমউদ্‌দীন, সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, মুনীর চৌধুরী, সানাউল হক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মুর্তজা বশীর, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আর পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা হলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, গোপাল হালদার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব, বিষ্ণু দে, সলিল চৌধুরী, সুলেখা সান্যাল, পূর্ণেন্দু পত্রীসহ আরও অনেকে।

মতিন: ১৯৫২ সালে ‘সীমান্ত’র প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেল কেন?

মাহবুব: এর প্রধান কারণ, ভাষা আন্দোলন ও আমার লেখা একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আমি ছিলাম কমিটির আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ ও এম এ আজিজ। ১৯ ফেব্রুয়ারি আমি জলবসন্তে আক্রান্ত হই। খবর পাই, একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ হঠাৎ গুলি চালিয়েছে। এতে শহীদ হন বরকত, রফিক, জব্বার, সালামসহ অনেকেই। ঢাকায় রক্তপাতের ঘটনায় আমি ভীষণ মর্মাহত হই। আমি তো তখন অসুস্থ। ঘরবন্দী। ঢাকার পুলিশি হত্যার প্রতিবাদে সন্ধ্যা সাতটায় ১২০ লাইনের এই কবিতা লিখে শেষ করি। পরদিন কবিতাটি লিফলেট আকারে ছাপা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানের বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশে কবিতাটি পড়ে শোনান চৌধুরী হারুনুর রশীদ। তখন তিনি শ্রমিকনেতা, পরে অবশ্য চট্টগ্রাম জেলার ন্যাপ সভাপতি হন। কবিতাটি পড়ার অপরাধে পরদিন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় কবিতাটি। কবিতা হাজারো কপি ছাপা হয়েছিল। আমার বিরুদ্ধে জারি করা হয় হুলিয়া। আমাদের বাড়ির সামনে দুজন আর্মড পুলিশের পাহারা বসানো হয়। উদ্দেশ্য, আমি যেন সুস্থ হয়ে পালাতে না পারি। পরে বোরকা পরে গাড়িতে পর্দা টাঙিয়ে আত্মগোপনে চলে যাই। একটানা ৯ মাস আত্মগোপনে ছিলাম। তখন ‘সীমান্ত’ প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়।

মতিন: ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ এটি আমাদের অমর একুশের প্রথম কবিতা। কবিতাটি কোথায় ছাপা হয়েছিল?

মাহবুব: কবিতাটি ছাপা হয়েছিল চট্টগ্রামের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে। এর মালিক ছিলেন কামাল উদ্দীন আহমদ খান। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের তত্ত্বাবধানে কবিতাটি ছাপা হয়েছিল।

মতিন: আপনি তো কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেছিলেন। এবার সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

মাহবুব: এটা ১৯৪৯ সালের ঘটনা। ২২ ও ২৩ নভেম্বর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে বিশ্বশান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চট্টগ্রাম থেকে শহীদ সাবের ও আমি যোগ দিয়েছিলাম। আর ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আবদুস সামাদ। সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, শান্তির সংগ্রাম ও বাঁচার সংগ্রাম আজ এক হয়ে গেছে। সম্মেলন শেষে মিছিল বের করা হয়। মিছিল থেকে পুলিশ আমিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে তালতলা থানায় নিয়ে যায়। পরে আলীপুর জেলে পাঠায়। তিন দিন পর আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়।

মতিন: আপনি বলছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর ফলে সৃষ্ট পঞ্চাশের মন্বন্তরে মামার হাতে গড়া জুবিলি ব্যাংক ও জুবিলি ওভারসিজ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়। সব ব্যবসা–বাণিজ্য হারিয়ে মামা আহমদ সাগীর চৌধুরী নিঃস্ব হয়ে পড়েন। পরে কী করে তিনি বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হন?

মাহবুব: সাগীর মামা নিঃস্ব হয়ে পড়লে তাঁর পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তখন ছোট মামা লুৎফে আহমদ চৌধুরী আন্দরকিল্লায় ভাড়া নিয়ে একটি মুদি দোকান চালু করেন। আমি মাঝেমধ্যে ওই দোকানে বসতাম। নিজের হাতে চাল, ডাল, গম, নুন, তেল ইত্যাদি বিক্রি করতাম। একপর্যায়ে ছোট মামা বোমার ভয়ে আমাকে নিয়ে গ্রামে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু সাগীর মামা ও মামি গ্রামে যেতে অসম্মতি জানালেন। আমিও মামার পরিবারকে দুর্দিনে ফেলে গ্রামে যেতে সম্মত হলাম না। মামা সেখানে একটি মুদির দোকান খোলেন। কিন্তু পুঁজি কম, তাই খাতুনগঞ্জ ও চাকতাই থেকে জিনিসপত্র পাইকারি দামে এনে খুচরা দামে বিক্রি করতেন। আর এই রোজগার দিয়েই সংসার চলত।
১৯৪৩ সালের কথা। একদিন দোকানে সাবান কেনার জন্য এলেন এক ইংরেজ সৈনিক। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রবার্ট ক্রস। প্রথম দিনেই তাঁর সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। আমি তাঁকে আমার ও মামার জীবনের সব কাহিনি খুলে বললাম। তিনি আমাদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলেন। রবার্ট ক্রস ছিলেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তিনি আমাকে মার্ক্সবাদের ওপর দুটি বই পড়তে দেন। আমি বই দুটি পড়ে মার্ক্সবাদের প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। শহরের অবস্থা যখন এ রকম, তখন রবার্ট ক্রস একদিন আমাকে বললেন, খবর দিয়ে মামাকে যেন গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসি। দুদিন পরই মামা শহরে এলেন। রবার্ট ক্রস মামাকে পরামর্শ দেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি আধুনিক রেস্টুরেন্ট খোলার। কে সি দে রোডের এখন যেখানে সোনালী ব্যাংক, ওখানে ছিল কলকাতা ন্যাশনাল ব্যাংক। এর উল্টো দিকে যে দালানে একসময় চিটাগাং স্টোরস ছিল, যুদ্ধের কারণে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। ওই দালানের মালিক ছিলেন চকবাজারের সৈয়দ আহমদ খান। তখন চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট স্টুয়ার্ট এবং ডিভিশনাল কমিশনার জেমিসন। রবার্ট ক্রস মামাকে স্টুয়ার্টের কাছে নিয়ে যান এবং ওই দালান রিকুইজিশন করে নেন। ওখানে চালু করা হয় রেস্টুরেন্ট। ক্রস এর নাম দেন ‘ট্রোকাডেরো’। রবার্ট ক্রস সেনাবাহিনীকে খাদ্য সরবরাহের একটি চুক্তিও আমাদের পাইয়ে দেন। সার্কিট হাউসের উল্টো দিকে ছিল আর্মির ফুড ডিপো। আমরা আলু, মাছ, মুরগি এবং ফলমূল সাপ্লাই দিয়েছি প্রায় এক বছর। এতে আমরা প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক হয়ে উঠি। আমাদের সুদিন ফিরে আসে।

মতিন: কর্মজীবনে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন?

মাহবুব: হ্যাঁ, আমার কাজের এবং দায়িত্বের পরিধি এতটা বেড়ে গেল যে আমি খাওয়া ও গোসলের সময় পর্যন্ত পেতাম না। কলকাতার করপোরেশন স্ট্রিটের সিনেমা হলের নির্মাণকাজ তদারক করা, খিদিরপুর সিনেমা হলের জন্যে কেনা জমি দখলে রাখা, চট্টগ্রামের খুরশীদ মহল সিনেমা হলের জন্যে ফিল্ম বুক করা, করাইয়া রোডের বাড়িতে মামিদের থাকা-খাওয়ায় যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা, ‘সীমান্ত’র জন্যে লেখা সংগ্রহ করা—সবকিছু মিলে আমি ভীষণ ভারগ্রস্ত হয়ে পড়ি।

মতিন: আপনি কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ঠিকই, তবে এটাও তো ঠিক, সাফল্যও ধরা দিল। তারপর কী হলো?

মাহবুব: জীবন তো আর থেমে থাকে না। সবকিছুই চলল তার আপন গতিতে। এর আগে ৯২ক ধারায় মামলা হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে আত্মগোপন থেকে ফিরলাম। বন্ধু আজিজুস সামাদের আগ্রহে যুক্ত হলাম চট্টগ্রামস্থ প্রুডেনশিয়াল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে। সামাদ কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা। বিশেষ চেষ্টা, ধৈর্য ও জনপ্রিয়তার কারণে সাফল্য অর্জন করলাম। বিমা ব্যবসা ও অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে যে পুঁজি সঞ্চিত হলো, তা দিয়ে বাড়ি করলাম। ফলে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এল।

মতিন: ইতিমধ্যে তো আপনি বিয়েও করে ফেলেছেন। বিয়ে সম্পর্কে জানতে চাই।

মাহবুব: জি, বিয়ে করে ফেলেছি। ১৯৫২ সালের ১০ অক্টোবর আমাদের বিয়ে হয়। আমার স্ত্রীর নাম জওশন আরা রহমান। জওশনের অভিভাবকেরা আমার সঙ্গে তাঁর বিয়ের ব্যাপারে কিছুটা দোদুল্যমান ছিলেন। এর কারণ, আমার রাজনৈতিক জীবনের অনিশ্চয়তা। তবে আমার রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রের যে পরিচিতি, সেটা এড়ানোও সম্ভব ছিল না। পরে আমার বন্ধু সুচরিত চৌধুরীর দৌত্যে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় জওশন ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর আক্দ সম্পন্ন হয়।
জওশন আরার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। জওশনের প্রপিতামহ শুকুর আলী। উনিশ শতকের প্রথম দিকে তিনি ব্রিটিশ রাজের অধীনে বিভিন্ন এলাকায় মুনসেফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নামে চট্টগ্রামে রয়েছে শুকুর আলী মুনসেফ সড়ক। জওশনের বাবা মাহবুবুর রহমান ছিলেন জেলা রেজিস্ট্রার। তাঁর বড় ভাই হাবিবুর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক। পরে তিনি করাচিতে পরিকল্পনা কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়েছিলেন। হাবিবুর রহমানের স্ত্রী সুলতানা রাহমান প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর সহোদর। জওশনের বোন হুসনুন্নাহারের স্বামী বিখ্যাত প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী। আর তাঁর ছোট বোন জাহানারা ইসলামের স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নজরুল–বিশেষজ্ঞ ও ভাষাসৈনিক ড. রফিকুল ইসলাম। জওশন আরার মা সাদীদা বেগম ‘মৌলুদ শরীফ’ গ্রন্থের রচয়িতা। কবি সুফিয়া কামালের স্বামী কামাল উদ্দিন খান জওশন আরার মামা।

মতিন: আপনি তো তরুণ বয়সে বেশ সুদর্শন ছিলেন। কেউ আপনার প্রেমে পড়েননি?

মাহবুব: স্কুলজীবনে এক তরুণীর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। সেটা ১৯৪৩ সালের ঘটনা। ওর নাম ছিল পঞ্চশিখা সরকার। আমরা দুজন দুই স্কুলে পড়তাম। একই ক্লাসে অর্থাৎ ক্লাস টেনে। শিখারা সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় কলকাতায় চলে যায়। তবে ১৯৫১ সালে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল। শিখার সঙ্গে আমার বিয়ে না হওয়ার পেছনে একটা কারণ ছিল। আমার বিয়ের পর মেজদির কাছে সেটা শুনেছিলাম। শিখা আমাকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমার মামার অনুরোধে। মামা তখন হেরিংটন নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন। হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত গ্যাংগ্রিন হয়ে শয্যাশায়ী। আমার অবর্তমানে একদিন শিখা মামাকে দেখতে গিয়েছিল নার্সিং হোমে। তখন মামা তাকে মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন সে যেন আমাকে বিয়ে না করে।

মতিন: আপনার লেখালেখির শুরু কীভাবে? প্রথম কী লিখেছিলেন, মনে আছে?

মাহবুব: স্কুলজীবনেই লেখালেখির শুরু। মনে আছে, এক শরৎকালের কথা। বাগানে সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে আছে অজস্র শুভ্র শিউলি ফুল। চমৎকার নজরকাড়া দৃশ্য। ফুলের ঘ্রাণে মন উতলা হয়ে উঠেছে। ইচ্ছা হলো, শিউলি ফুলের মালা গাঁথি। পরে ভাবলাম, মালা গাঁথা তো মেয়েদের কাজ। পরে শিউলি ফুল নিয়ে একটি কবিতা লিখে ফেলি। এটিই আমার জীবনের প্রথম লেখা। এর আঙ্গিক কী ছিল, আদৌ কবিতা হয়েছিল কি না, আজ আর মনে নেই।

মতিন: আপনি তো চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক পত্রপত্রিকাতেই লিখেছেন। সে সময়ের কথা যদি কিছু বলতেন!

মাহবুব: আমি তৎকালীন ‘সওগাত’, ‘সোনার বাংলা’, ‘নতুন সাহিত্য’, ‘পরিচয়’, ‘অগ্রণী’, ‘ডাক’,‘ইস্পাত’, ‘পরিচিতি’, ‘পূর্ব্বাশা’, ‘নওবেলাল’, দৈনিক ‘সত্যযুগ’, সাপ্তাহিক ‘আওয়াজ’, ‘উদয়ন’ ও ‘প্রগতি’ পত্রিকায় লিখেছি। কখনো গল্প, কখনো কবিতা আবার কখনো প্রবন্ধ লিখেছি। সেসব লেখা বিভিন্ন সময় পুলিশি হামলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কলকাতা থেকে আমার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। একটির নাম ‘ইস্পাত’, আরেকটির নাম ‘অঙ্গীকার’। এ ছাড়া ‘দারোগা’ ও ‘আগামীকাল’ নামে দুটি নাটকও লিখেছি। নাটক দুটির ভূমিকা লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন কবির। ‘দারোগা’ নাটকে পুলিশি অত্যাচার তুলে ধরেছিলাম। এ ছাড়া ১৯৪৭ সালে ‘বিপ্লব’ নামে একটি পুস্তিকা লিখেছিলাম। এর বিষয় ছিলÑকী করে ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ সরকারকে হটানো যায়। মুনীর চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় লিখেছিলাম ‘আগামীকাল’ নাটকটি। তিনি এটি সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন। পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে লিখেছিলাম ‘ভাঙন’ নাটকটি। এটি আমার লেখা প্রথম নাটক।

মতিন: কলকাতায় বহু বিখ্যাত কবি-লেখকের সঙ্গে আপনার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। স্মরণীয় কোনো স্মৃতি আছে?

মাহবুব: অনেক প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সভা-সম্মেলনে। একটি স্মরণীয় স্মৃতি আছে। ১৯৫০ সালে বিশ্বব্যাপী চলছিল বিশ্বশান্তি আন্দোলন। এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। আমি কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগ দিই। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করি বিশ্বশান্তি পরিষদ। ভারতীয় বিশ্বশান্তি পরিষদের নেতা কমরেড চিত্ত বিশ্বাসের সঙ্গে দিল্লিতে সাক্ষাৎ করি কবি পাবলো নেরুদার সঙ্গে। তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘রেসিডেন্স অন আর্থ’ আমাকে উপহার দেন। এই ঘটনা আমার জীবনে স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে আছে।

মতিন: এবার আপনাদের প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ সম্পর্কে জানতে চাই।

মাহবুব: পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আদলে চট্টগ্রামে আমরা গড়ে তুলি প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ। সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষণের বিরোধিতা করা এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করা। সংগঠনটি চট্টগ্রাম শহরের পাশাপশি গ্রামেও গণসংগীত ও নাটক পরিবেশন করত। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কলিম শরাফী, রমেশ শীল, চিরঞ্জীব দাসশর্মা, হরিপ্রসন্ন পাল, দীননাথ সেন, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, রমেশ মজুমদার, নির্মল মিত্র, মাহবুব হাসান, স্নেহময় রক্ষিত, এম এ সামাদ, এ জি নবী, এস এ জামান প্রমুখ সংস্কৃতিকর্মী। নাটকের নারী চরিত্রে তখনো কোনো মহিলা শিল্পীকে মঞ্চে আনা সম্ভব হয়নি। প্রান্তিকের মাধ্যমেই এই অচলায়তন ভাঙা হয়। দুজন নারী শিল্পী প্রথমবারের মতো মঞ্চে অভিনয় করেন। এঁরা হলেন কামেলা খান মজলিশ ও মনি ইমাম। নাটকটির নাম ছিল ‘জবানবন্দি’। তৎকালীন বাস্তবতায় এটি ছিল খুব সাহসী উদ্যোগ। ফলে প্রান্তিক নবনাট্য সংঘের গণসংগীত দল দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই গ্রামে গ্রামে সংগীত পরিবেশনের ডাক আসতে শুরু করে।

মতিন: প্রান্তিক তো চট্টগ্রামের বাইরেও অনুষ্ঠান করতে শুরু করল!

মাহবুব: চট্টগ্রামের বাইরেও প্রান্তিকের নাম ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৫২ সালে কুমিল্লায় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলনে প্রান্তিক অংশগ্রহণ করল। ১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন’-এও প্রান্তিক অংশ নেয় এবং অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। কুমিল্লা সম্মেলনে ‘সমাজ ও সাহিত্য’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম। আর ঢাকার কার্জন হলের সম্মেলনে পাঠ করেছিলাম ‘সাহিত্যে সমাজ চেতনা’ শিরোনামের প্রবন্ধ।

মতিন: আপনি তো মাওলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন?

মাহবুব: এটি একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে চট্টগ্রামের একটি সাংস্কৃতিক স্কোয়াড নিয়ে আমরা যোগ দিয়েছিলাম। সম্মেলনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে আমি বক্তৃতা করেছিলাম।

মতিন: এক সংগ্রামমুখর জীবন আপনার। কত আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করেছেন। কত সংগঠন গড়ে তুলেছেন। মিছিল-স্লোগানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?

মাহবুব: প্রথমদিকে চট্টগ্রামেই ছিলাম। কিছুদিন যাযাবরের মতো এখানে-সেখানে থেকেছি। তারপর পাহাড়ে-জঙ্গলে। পরে কক্সবাজার এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ছিলাম। তখন আমার ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমার প্রিয় লাইব্রেরি, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত গ্রন্থ এবং আমার লেখা দশ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ডায়েরি বর্বর হানাদাররা গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।

মতিন: আপনি তো পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন?

মাহবুব: জি। এটা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের ঘটনা। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলাম। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত।

মতিন: চট্টগ্রামে আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং আন্দোলন-সংগ্রামে দীর্ঘ সময় কাটানো। কবে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে এলেন? আপনার ঢাকার জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।

মাহবুব: আমরা স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি ১৯৭৬ সালে। প্রথমে ভাড়া বাড়িতেই উঠি। ঢাকায় আসার পর এলিট প্রিন্টিং ও প্যাকেজিংয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। পরবর্তী সময়ে উত্তরার বাড়িটি নির্মাণ করি। আমার ‘সীমান্ত’ পত্রিকার নামে বাড়িটির নাম রাখি ‘সীমান্ত’। ঢাকায় চলে আসার পর চট্টগ্রামের মতোই বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করি। নব্বইয়ের দশকে প্রায় আট বছর ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলাম। ক্রান্তির সভাপতি হিসেবে দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি।

মতিন: ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশে কী বলবেন?

মাহবুব: রাষ্ট্রের বুকের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী একটি দুষ্ট ক্ষত বাঁচিয়ে রেখে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। নতুন প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান—যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সবাই যেন ঐক্যবদ্ধ হয়।