কাশীনাথ রায়: আমাদের কেএনআর

আজ প্রয়াত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও কবি কাশীনাথ রায়। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এ লেখায় তাঁর টুকরো টুকরো ছবি তুলে ধরেছেন তাঁরই এক ছাত্রী।

কাশীনাথ রায়ের ছবি অবলম্বনেকোলাজ: মনিরুল ইসলাম

একটু আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অ্যালামনাই সোসাইটির পেজ থেকে জানলাম, কাশীনাথ রায় স্যার আর নেই। কয়েক দিন আগেই জেনেছিলাম তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। তাঁর মারা যাওয়ার সংবাদে এক লহমায় মনে পড়ে গেল কত কথা, কত স্মৃতি! ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ইংরেজি বিভাগের করিডরে হাঁটছেন এক শান্ত-আত্মসমাহিত সন্ত। ইংরেজি বিভাগের ঝকঝকে বেশভূষার ছাত্র-শিক্ষকের ভিড়ে অতি সহজেই দৃষ্টি কাড়তেন কাশীনাথ স্যার। ক্লাসে যখন পড়াতে ঢুকতেন, তাঁর উপস্থিতি আর পড়ানোর ধরন বলে দিত তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা।
কাশীনাথ রায় স্যার ছিলেন ‘আমাদের কেএনআর’। ইংরেজি বিভাগে একটা প্রচলন ছিল শিক্ষকদের নাম সংক্ষেপ করে ডাকার। তাই কাশীনাথ রায় আমাদের কাছে ছিলেন কেএনআর। আমাদের তিনি পড়াতেন হেনরিক ইবসেনের ‘আ ডলস হাউস’। মনে পড়ে, ক্লাসরুমে তিনি আপন মনে হাঁটতেন আর পড়াতেন। নাটকের শেষে নোরা যখন দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায়, সেই জায়গাটার ওপর স্যার অনেক জোর দিতেন। বলতেন, দরজা বন্ধ করার সেই শব্দটা যেন হাজার কামানের শব্দ হয়ে সেই সময়ে সমাজের বুকে আছড়ে পড়েছিল। ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সেই সময়টাতে ইবসেনের হয়ে স্যার আমাদের শেখাতে চেয়েছিলেন নোরার ওই চলে যাওয়াটা কেবল তার স্বামী-সন্তানদের ছেড়ে যাওয়া নয়, একই সঙ্গে তা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ওপরেও মস্ত কশাঘাত। আর আমাদের জন্যও সেটা ছিল একজন নারীর ব্যক্তিসত্তা যে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠে—এটা শেখার প্রথম ধাপ।

তাঁর মৃত্যুতে একজন অসাধারণ মানুষ এবং একজন অসাধারণ শিক্ষককে হারিয়েছি আমরা। দেশও যে একজন আদর্শ শিক্ষককে হারিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কখনো পাণ্ডিত্য জাহির করতে দেখিনি কাশীনাথ স্যারকে। নিভৃতচারী মানুষটি কখনো নিজের অস্তিত্ব জানান দেননি জোরেশোরে। পড়াতে পড়াতে একাত্ম হয়ে যেতেন চরিত্রের সঙ্গে। দড়াম করে দরজা বন্ধ করে নোরার বেরিয়ে যাবার কথা যখন বলতেন, মনে হতো সেই হাজার কামানের শব্দ যেন আমাদের কানেও সশব্দে বাজছে। মানবজীবন সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি।

তাঁর কাছে আরও পড়েছিলাম টমাস হার্ডির ‘দ্য রিটার্ন অব দ্য নেটিভ’। মনে আছে, কঠিন একটা উপন্যাসকে কত সহজভাবেই না তিনি তুলে ধরেছিলেন আমাদের কাছে!
পড়ানোর মাঝখানে প্রায়ই আওড়াতেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কোনো সময় পড়াতে পড়াতে জানালার কাছে যেতেন। বলতেন, আকাশে এত সুন্দর মেঘ করেছে, এখন কি পড়াতে ইচ্ছে করে বলো?

তাঁর মৃত্যুতে একজন অসাধারণ মানুষ এবং একজন অসাধারণ শিক্ষককে হারিয়েছি আমরা। দেশও যে একজন আদর্শ শিক্ষককে হারিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কখনো পাণ্ডিত্য জাহির করতে দেখিনি কাশীনাথ স্যারকে। নিভৃতচারী মানুষটি কখনো নিজের অস্তিত্ব জানান দেননি জোরেশোরে। পড়াতে পড়াতে একাত্ম হয়ে যেতেন চরিত্রের সঙ্গে। দড়াম করে দরজা বন্ধ করে নোরার বেরিয়ে যাবার কথা যখন বলতেন, মনে হতো সেই হাজার কামানের শব্দ যেন আমাদের কানেও সশব্দে বাজছে।

মানবজীবন সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি। সাহিত্য পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে সেসব জীবনদর্শনও আমরা জানতে পারতাম তাঁর কাছ থেকে, তাঁর গভীর জীবনবোধকে বুঝে নেওয়ার সুবাদে।

কাশীনাথ রায়—তাঁর কাছে সাহিত্য পড়েছি, এ জন্য গর্ব বোধ করি। এখনো যখন সহপাঠী–বন্ধুরা একসঙ্গে হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প করি, সেখানে অবশ্যম্ভাবীভাবে জায়গা করে নেন কাশীনাথ রায় স্যার।

আসছে সময়েও হয়তো আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষাজীবনের গল্প করব, নিজেদের স্মৃতি ভাগাভাগি করে নেব; এবং অতি অবশ্যই আমাদের সেসব গল্পে, স্মৃতির মধ্যে খানিকটা জায়গা জুড়ে থাকবেন আমাদের কেএনআর।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]