গল্পে আনন্দ-বেদনার ঈদ

মুর্তজা বশীর, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, সাজেদুল করিম

আমাদের আবহমান গল্প-উপন্যাসে ঈদ এসেছে আনন্দ-বেদনার সম্মিলনে। এমনই কিছু গল্প-উপন্যাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক, যেখানে আনন্দের পটে, বেদনার রঙে ঈদ হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।

চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর (১৯৩২-২০২০) একজন বিশিষ্ট কথাশিল্পীও বটে। তাঁর গল্পগ্রন্থ কাচের পাখির গান এবং উপন্যাস আলট্রামেরিন-এর কথা আমরা সবাই জানি। আজ থেকে সত্তর বছর আগে ১৯৫১ সালে লেখা মুর্তজা বশীরের গল্প ‘লাল লুঙ্গ’। লেখক গল্পের শেষে প্রদত্ত নোটে বলেছেন ঢাকার বস্তির চলতি ভাষায় তখন লুঙ্গিকে ‘লুঙ্গ’ বলা হতো। গল্পটি এক ঈদকে কেন্দ্র করে।

আকাশে উঠেছে ঈদের চাঁদ আর রিকশাচালক রমজানের মনের দিগন্তে এমন সব ভাবনার উদয় হয়ে চলেছে:

‘কালো মেঘটার ধারে আবছাভাবে চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছে। রুপালি চাঁদ। একফালি সরু বদ্ধ রেখা। ঈদের চাঁদ। হাত বাড়িয়ে সালাম করে ও। মনে মনে ভাবে: কাল ত ঈদ। কিন্তু হাতে তার কোনো পয়সাও নেই। রোজকার ঈদ, রোজই খরচ হয়। আজ যা পাবে, মহাজনকে দিয়ে বাদবাকিতে কাল আবার ঈদের সওদা করতে হবে। ছেলেটা আবার বায়না ধরেছে তার একটা লাল দেখে লুঙ্গি চাই।’

কিন্তু দরিদ্র রমজান ঈদের দিন রিকশা চালিয়ে ছেলে লালুর জন্য লুঙ্গি কেনার টাকা জোগাড় করতে পারে না। তবু আশা ছাড়ে না সে। ঈদের দুপুরে তাই বিশ্রাম বাতিল করে সে আবার বেরিয়ে পড়ে রিকশা নিয়ে:

‘জোরে জোরে চালায় রমজান জনকোলাহল ও আনন্দমুখর রাস্তায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। বাঁ হাতটা দিয়ে কপালটা মুছে নেয় ও। অন্যমনস্ক হয়ে আবার লালুর কথা ভাবে। মনে মনে হিসাব করে তিন টাকা জোগাড় হলেই লালুর লুঙ্গি হয়ে যায়। চোখের সামনে ভাসে লালুর মনমরা চেহারা। কানে বাজতে থাকে...‘আব্বা ঈদমে হামকো একঠো লুঙ্গ দিজিও। লাল দেখকার...।’

২.

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের (১৯৪৩-১৯৯৭) সাহিত্যজীবনের সূচনাপর্বের গল্প ‘ঈদ’। মুর্তজা বশীরের গল্পটির মতো তাঁর গল্পও ঈদের পোশাককে কেন্দ্র করে।

রজবের বাবা খুরশিদ কারখানার শ্রমিক, মা ফাতিমা চৌধুরীবাড়ির ঠিকা ঝি; ঈদের দিন সে রজবকে নিয়েই কাজ করতে যায়। ছেলের জন্য নতুন জামা কিনতে পারেনি, তাই গিন্নিমাকে বলে ফাতিমা একটা কলার ও বোতামছেঁড়া পুরোনো শার্ট সংগ্রহ করল রজবের জন্য। সেই শার্ট পরে চৌধুরীবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতে গেলে ওরা তাকে নিয়ে টিপ্পনী কাটতে শুরু করে এই বলে ‘দেখেছ সব? ওর জামাটার একটা বোতামও নেই! ওরে ছোড়া, বোতাম কটা খেয়েছিস, না?’

এসব শুনে রজবের মাথা ঠিক থাকে না, সেই ছেলেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিষ্ফল আক্রোশে আর এরপর রজবের ওপর ততোধিক বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে চৌধুরী-গিন্নি। ঈদের দিন সেমাইয়ের বদলে মার খেয়ে বাড়ি ফেরে রজব। ফাতিমা আসে অনেক রাতে, বিভিন্ন বাড়ির কাজ সেরে। গল্পের শেষ দৃশ্য ইলিয়াসের দরদি হাতের ছোঁয়ায় এমনই করুণ মানবিক মহিমায় ভাস্বর:

‘মাটির পিদিমটা জ্বালিয়ে ঘুমন্ত ছেলের মুখটার দিকে চেয়ে দেখে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়েছে সে। ফাতিমা শুয়ে পড়ে। রজবকে কাছে টেনে নেয়। হু হু করে কেঁদে ওঠে ফাতিমা। পেটের দায়ে তাকে ছেলের ঈদ পর্যন্ত ব্যর্থ করে দিতে হয়।

রজব জেগে যায়। তার আম্মা কেঁদেই চলে। ফাঁড়ি থানাটায় ঢং ঢং করে বারোটা বাজে। বারোটার পর থেকে ঈদের দিন চলে গেল। ভালই হল।’

ঈদের দিন যেমন আনন্দের ইশতেহার বয়ে আনে, তেমনি রজবের মতো জগতের লাঞ্ছিত-ভাগ্যহতদের দুঃখধারা যেন ঈদের দিনেও ফুরোতে চায় না।

৩.

সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) গল্প ‘সাহেবচান্দের ঈদভোজন’।

সাহেবচান্দ জলেশ্বরী অঞ্চলের এক অদ্ভুত লোক। ঈদের দিন চারপাশ যখন শিরনি-পোলাও-মাংসের গন্ধে ম–ম করছে, তখন সে এক বাড়ির উঠোনে গর্ত খুঁড়ে, উনুন তৈরি করে, পাটখড়িতে আগুন ধরিয়ে ভাত ও বেগুন একসঙ্গে চাপিয়ে দেয়। গ্রামের লোকসকল ঈদের দিনে তার এই কাণ্ড দেখে বলে ওঠে, ‘তোমার আর আক্কেল হবার নয়, বাহে।’

কিন্তু সাহেবচান্দ নির্বিকার। সে কাঁচামরিচ-পেঁয়াজকুচি ও শর্ষের তেলসহযোগে বেগুনভর্তা বানিয়ে থালাভর্তি ভাত খেয়ে সদ্য-খোঁড়া উনুন বুজিয়ে দিয়ে জলেশ্বরীর কোন দিকে যেন মিলিয়ে যায়। গ্রামের লোক তার পেছন পেছন ঘুরে একই প্রশ্নে আকুল হতে থাকে ‘ঈদের দিনে এ কি তোমার ভোজন?’

সাহেবচান্দ নিরুত্তর কিন্তু তার হয়ে গল্পকথক জানিয়ে দেন এই তথ্যটুকু যে পঞ্চাশের মন্বন্তরের কালে অনেক দিন ক্ষুধার্ত থাকার পর ঈদের দিনে হঠাৎ সাহেবচান্দের বাবা–মা এক বড়লোক-বাড়িতে পোলাও-মাংস-কোর্মা গোগ্রাসে খেয়ে বমি করতে করতে বীভৎসভাবে মারা গিয়েছিল। এই ঈদের দিনে সাহেবচান্দের হয়তো সে ভয়ংকর অতীত স্মরণে আসে, তাই সে শিরনি-পোলাও-মাংসের ঘ্রাণের তোয়াক্কা না করে সামান্য ভাত-বেগুনে নিজের ঈদের আহার সারে।

৪.

শিশুসাহিত্যিক সাজেদুল করিম (১৯১৫-১৯৯৪) ঈদ নিয়ে লিখেছেন ‘মিষ্টি ঈদের মসলা’ নামে এক ভারী চমৎকার রূপকথার গল্প।

আদ্যিকালের এক খুকুমণি ঈদের আগের রাতে ঘুমের ঘোরে পরির রাজ্য পাড়ি দেয়। পরির রানি তাকে বলে ‘হাসি’ হচ্ছে ঈদের সবচেয়ে বড় মসলা। হাসি না মাখালে ঈদের খাবার রঙিন হতে পারে না। খুকুমণি পরির রাজ্য থেকে ‘হাসি’ নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে।

হঠাৎ মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে তার। আজ তো ঈদ, খুশির ঈদ। ওদিকে রান্নাঘরের মজাদার খাবারগুলো যেন খুকুমণির নিয়ে আসা হাসির সওগাতে ঝিলমিল করছে:

‘ওমা! চাঁদের-মা-বুড়ীর দেওয়া সেই সুতোগুলোই যে আম্মা রান্না করে বসে আছেন কিসমিস-বাদাম দিয়ে। কেমন কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো সুতোগুলো, চাঁদের মতোই হাসছে। মা হেসে বলেন, খুকু, পরীরা যে একটু আগে দিয়ে গেলো তোমার নাম করে। এগুলোর নাম সেমাই। “আরে দেখো” বলে আম্মা পোলাও-এর পাতিলটা খুললেন। কেমন লাল-নীল রং ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পোলাওগুলোর উপর। মা বললেন, এ রং-এর কারসাজিও পরীদেরই শেখানো।’

সেই থেকে প্রতি ঈদে আমাদের ‘সেমাই’ পাকানোর রীতি। পরিদের বাতলানো সেই রঙের কারসাজিও ছড়ানো হয় আমাদের পোলাও–জর্দাতে। আর তাইতেই ওগুলো হয়ে ওঠে রংবেরং। আর সেই থেকে আমাদের ঈদগুলোও জর্দা-ফিরনির মতোই হয়ে উঠেছে রঙিন।

রূপকথার খুকুমণির হাসির মতোই আমাদের সবার হাসির রঙে ঈদ হয়ে ওঠে রঙিন। দুঃখী মানুষের বেদনাকে দূর করে ঈদের উৎসব হয়ে উঠুক সত্যিকার সর্বজনীন।

ঈদ মোবারক।