বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন’ উপলক্ষে বাংলাদেশে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। তখন প্রথম আলোর সঙ্গে সাহিত্যসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমাদ মাযহার

আহমাদ মাযহার: আপনি লেখেন নানা মাধ্যমে। লেখক হিসেবে কোন পরিচয়ে শনাক্ত করলে আপনি খুশি হন?
নবনীতা দেবসেন: আমার প্রথম পরিচয়, আমি কবি। তারপর আস্তে আস্তে গদ্যের পাড়ায় চলে এসেছি। গদ্যে এসে সব রকম লেখা দিয়েই চেষ্টা করেছি। তবে প্রথমে হাত দিয়ে বেরিয়েছে কবিতা।
মাযহার: তার মানে, আপনাকে কবি হিসেবে সম্বোধন করলে খুশি হন বেশি?
নবনীতা: আমি কিন্তু এভাবে ভাবিনি। হ্যাঁ, হয়তো কবি হিসেবে পরিচয় দিলে খুশি হতে পারি।
মাযহার: আপনি কি বাংলাদেশের কোনো লেখকের লেখা পড়েছেন?
নবনীতা: অনেকের লেখাই পড়েছি। জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামাল—এঁদের লেখা পড়েছি। তাঁরা দুজনই আমাদের বাড়িতে যেতেন বলে চিনতাম। জসীমউদ্দীন, হুমায়ূন আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও পড়েছি। দেখেছি বাংলাদেশি থিয়েটারও।
মাযহার: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখার বিশেষ গুণগুলো কী বলে আপনার মনে হয়?
নবনীতা: তাঁর ভাষাটাই তো আলাদা। একটা অন্য রকম ব্যাপার ছিল।
মাযহার: হাসান আজিজুল হকের লেখা পড়েছেন?
নবনীতা: হ্যাঁ, পড়েছি। তবে এ মুহূর্তে বিশেষ কোনো লেখার নাম মনে পড়ছে না। আমি কিন্তু বাংলাদেশি কবিদের কবিতাই বেশি পড়েছি। শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান—এঁদের কবিতা পড়েছি, ভালো লেগেছে। এ ছাড়া কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে আরও পড়েছি সেলিনা হোসেন ও নাসরীন জাহানের লেখা। আর অনেকের কাছেই শুনেছি শাহীন আখতারের নাম। তাঁর বই এখনো পড়া হয়নি আমার। ইচ্ছে আছে এবার তাঁর বই নিয়ে যাব।
মাযহার: আপনি তো প্রচুর রূপকথা লেখেন। লিখতে গিয়ে পুরোনোকেই কি নতুন করে নেওয়ার কথা ভাবেন, নাকি নতুন কিছু লিখতে চান রূপকথায়?
নবনীতা: শুনুন, আমার রূপকথায় নতুন কিছু বলার থাকে; কল্পনা তো থাকেই। আজকের যুগের সঙ্গে, আমাদের আজকের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত থাকে বিষয়বস্তু। মজার ব্যাপার হলো, আমার রূপকথা নায়কপ্রধান নয়। আমার রূপকথায় রানি গিয়ে উদ্ধার করে রাজাকে। আমি রূপকথা লিখি আজকের বাচ্চাদের জন্যই।
মাযহার: আপনি গল্প লিখেছেন, লিখেছেন উপন্যাসও। গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের সত্তার মধ্যে কি আলাদা কিছু কি অনুভব করেন?
নবনীতা: উপন্যাস লেখার আগে অনেক ভাবি। হুট করে লিখি না। অনেক পরিশ্রম করি। তবে গল্প ও উপন্যাস দুটো বিষয় লিখতেই আলাদাভাবে পরিশ্রম করতে হয়। চট করে লেখা কিছু মানুষের হৃদয়ে পৌঁছায় না। এভাবে আমি পাঠক ঠকাতে চাই না।
মাযহার: আগেই বলেছি, গল্প, উপন্যাস, রূপকথা, কবিতা—নানা ধরনের লেখায় আপনার সক্রিয়তা। শ্রেণির দিক বিবেচনা করলে একটি তো আরেকটি থেকে আলাদা। এত সব ম্যানেজ করেন কীভাবে?
নবনীতা: আপনি যে ভাত, মাছ, মাংস খান; সব কি একসঙ্গে খান? সেটা ম্যানেজ করেন কীভাবে? আমরা তো প্রতিদিনই পরস্পরবিরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। হয়তো ঘরে আপনার মা অসুস্থ। তিনি আপনাকে বলছেন, কোথাও যেয়ো না। আবার আপনাকে অফিসেও তো যেতে হবে। ফলে সমন্বয় করে দুটো কাজই করতে হয় আপনাকে। আমিও এভাবেই সবকিছু করি।
মাযহার: অনেকেই বলেন, একটা ধরনের লেখাই লেখা উচিত চিন্তা সংগতি তৈরি করার জন্য।
নবনীতা: দেখুন, আমার মনে হয়, কার ঘর কত বড়, তার ওপরই নির্ভর করছে সব। আমার ঘর যদি বড় হয়, তাহলে সেখানে অনেক মানুষ আটবে। ছোট হলে সেটা সম্ভব হবে না। আবার এমন যদি হয়, অনেক কিছু লেখার ফলে সব লেখাই ভীষণ খারাপ হচ্ছে, তাহলে অন্য কথা। কিন্তু আমি যদি ভালো লিখি, লিখতে পারি তবে আপত্তি কোথায়?
মাযহার:লেখার ক্ষেত্রে আপনি প্রেরণাপন্থী, নাকি অন্যের চাহিদা মাথায় রেখে লিখতে সুবিধা হয় আপনার?
নবনীতা: দুটোই সত্য। কেউ তাগাদা দিলে ‘কী লিখতে পারি’ সেটি নিয়ে ভাবতে থাকি! মাথায় তখন অনেক চিন্তা কাজ করে, চোখে থাকে অনেক দৃশ্য। সবগুলোই কিন্তু আবার লেখা হয় না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কিংবা বললে তখন মনে হয়, ‘হ্যাঁ, ওটাও তো হতে পারত।’ আসলে তাগাদাও একধরনের প্রেরণা। যিনি তাগাদা দিচ্ছেন তিনি তো আমার লেখা ভালোবাসেন বলেই এটা করছেন। অনেক দিন আগের কথা। আমরা এমন এক সময় পার করেছি, যখন আমাদের কলমে বোরকা পরানো থাকত। আমি যখন লেখালেখি শুরু করি, খুব খেয়াল করে লিখতে হতো। কী লিখলাম, এটা ভাবতে হতো। কারণ, মায়েরা, মাসিরা বলতেন, ‘এটা কি লিখলি?’ বাচ্চারা যখন স্কুলে যেত, তখনো এটাই ভাবতাম যে বাচ্চারা হয়তো ভাবতে পারে ‘মা এটা কী লিখেছে!’ তাদের কথা ভাবতে হতো আমাদের। একটা পুরুষ কিন্তু এতটা ভাববে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের ভাবতে হয় না। হয়তো এখন তসলিমা নাসরিনকেও ভাবতে হয় না। কিন্তু এগুলো তো এখনকার প্রজন্মের কখা। আমাদের সময় লেখার আগে ভাবতে হয়েছে—আমি লিখছি।
মাযহার: সময়ের যে নানা ধরনের প্রতিরোধ, সেগুলো মাথায় রেখে আপনাকে চলতে হতো, লিখতে হতো।
নবনীতা: হ্যাঁ, মাথায় রাখতে হতো। এখন রাখতে হয় না। এখনকার ছেলেমেয়েরা বোধ হয় পাল্টে গেছে। টেলিভিশন দেখে ওরা এখন অল্প বয়সেই ম্যাচিউর হয়ে যায়। অনেকগুলো যুগের কত রকম সময়ের বদল দেখলাম আমি। ব্রিটিশ দেখেছি, ভারতবর্ষের স্বাধীন হওয়াও দেখেছি। দেখেছি ভারতবর্ষ ভেঙে যাওয়া, বাংলা ভাঙা এবং বাংলাদেশ গড়াও। সামাজিকভাবে আমাদের বদলে যাওয়ারও সাক্ষী আমি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় থেকে এই যে এত উদ্বাস্তু এসেছিল কলকাতায়, আমি তখন ছোট, তাদের যে ছোট ছেলেমেয়েরা এসেছে, ওদের সঙ্গে খেলা করি, ওদের বাড়িতে যাই। তো, উদ্বাস্তু মানুষের প্রভাবে আস্তে আস্তে আমাদের ভাষা ও খাওয়াদাওয়া বদলেছে। মেয়েদের তো বিরাট বদল হয়েছে। ঘটি মেয়েরা ছিল খুব ওল্ড ফ্যাশনের, তারা রাস্তায় বেশি বেরোত না। সেই সময়ে আমাদের মায়েদের বাজারে যাওয়া ছিল কল্পনার বাইরের ভাবনা। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা এপারে এল, তাদের তো লোকলজ্জার তেমন চিন্তা ছিল না, কারণ তাদের কেউ চিনত না। তা ছাড়া কাজ করার জন্য এদের অন্য কোনো লোকও ছিল না। ফলে কাজটা তাদের করতেই হতো। এরপর ওই মেয়েদের দেখে অল্প বয়সী ঘটি মেয়েদেরও মনে হলো, ‘আরে, ওরা যদি যেতে পারে, আমি কেন পারব না? আমিও যাই না বাজারে।’
মাযহার: আপনাকে কেউ নারীবাদী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করলে কীভাবে নেবেন?
নবনীতা: আমি নিশ্চয়ই নারীবাদী লেখক; কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি পুরুষবিরোধী। নারীবাদ মানে পুরুষবিদ্বেষ নয়। নারীবাদ নারীকে সম্মান দেয়, পুরুষকে অসম্মান করে না। হ্যাঁ, আমরা পিছিয়ে আছি অনেকটা। সুযোগের অভাব রয়েছে জীবনে। ইতিহাসে। আমাদের এগোতে হবে নিজের ক্ষমতায়। এখন তো অনেক পুরুষও আছেন, নারীবাদী। শরৎচন্দ্র ছিলেন, রবীন্দ্রনাথও ছিলেন, লেখাতে অন্তত; ব্যক্তিজীবনে হয়তো নয়। একজন মহৎ লেখক শুধুই পুরুষসর্বস্ব জীবনের হবেন না। নারীবাদ শব্দটির প্রতি সমাজের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। কিন্তু এর বদলে শব্দটিকে আমরা ভয় পাই—পুরুষতন্ত্র ভয় পায় শব্দটিকে। ভয় পেয়ে মনে করে, এবার বুঝি ফেলল গিলে মা গো মা! কিন্তু এটা ঠিক নয়। ভুলে গেলে চলবে না, নারী শুধু মা বা মেয়ে নয়—তারাও পরিপূর্ণ মানুষ। তাদের একটা চিন্তাজগৎ আর কর্মজগৎ আছে। নারীবাদীদের এভাবে ভাবতে হবে যে, তোমার দায়িত্ব তোমার নিজের প্রতিও আছে। এটা যদি নারীরা বোঝেন, নারীবাদ পরিপূর্ণ হবে। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে নারী যেন নিজেকে সম্মান করে। কেবল পুরুষই নয়, নারীরাও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব হতে পারে। তবে এটা একজন ইন্দিরা গান্ধী, কিংবা শেখ হাসিনাকে দিয়ে হয় না। তাঁরা ব্যতিক্রম। তাঁদের শক্তি ভিন্ন জায়গায়। এখানে নারীত্বটা অ্যাকসিডেন্টাল, শক্তিটা রাজনৈতিক সূত্রে আবদ্ধ। নারীবাদের কথা ভাবতে হবে সাধারণ জীবনযাত্রার মানুষকে নিয়ে। স্বীয় কর্মের মাধ্যমে নারীকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে নিজের ব্যক্তিত্ব। এখানে জেন্ডার এত জরুরি বিষয় নয়। কিন্তু যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি, সেখানে জেন্ডার রুলস খুবই স্পষ্ট।
মাযহার: তার মানে, তত্ত্বের কোনো নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নিজেকে চিহ্নিত করতে চান না আপনি?
নবনীতা: তত্ত্ব তো অনেক বড় ব্যাপার। আর তত্ত্ব তো একটা নয়, অনেকগুলো। নারীবাদও কিন্তু একটা নয়। নানা ধরনের ফেমিনিজম আছে। আমারটা আমার নিজস্ব। নারীকেই তার সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। আমি আমাকে কোনো মূল্য দিচ্ছি না, আপনি আমায় মূল্য দেবেন কেন? শেষ পর্যায়ে একটা কথা বলি—একজন পুরুষ কখনো ভাবে না, একজীবনে সে যে মা হতে পারে না বা পারল না, তার জন্য এটা দুর্ভাগ্য হতে পারে! তবে আমার মনে হয়, পুরুষের দিক দিয়ে এটা একটা বিরাট ঘাটতির ব্যাপার।