চিঠিপত্রে অন্তরঙ্গ ও অনন্য রোকেয়া

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মালেকা বেগম , প্রথমা প্রকাশন

আর ১০ বছর পর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হবে। যিনি তাঁর ৫২ বছরের জীবনে সমাজের শত শত বছরের পশ্চাৎপদতার মূল ধরে টান দিয়েছেন। তাঁর দীপদানি থেকে উৎসারিত আলো নিজ ঘরের গণ্ডি ভেদ করে ছড়িয়ে গেছে দিগ্‌বিদিক। তাঁর একার লড়াইকে তিনি সমষ্টির অর্জনের সঙ্গে একাকার করে দেখেছেন। আঁধারে ডুবন্ত সমাজের সমূহ সংস্কারে বহুমুখী সংস্কারের সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন রোকেয়া। রংপুরের প্রত্যন্ত পায়রাবন্দের ব্যক্তিগত অবরুদ্ধ অবস্থার বাধা ডিঙিয়ে বাঙালি মুসলিম নারীর সামষ্টিক মুক্তির পথকে ত্বরান্বিত করেছেন, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ, মতিচূর ১ ও ২, সুলতানাস ড্রিম-এর মতো বই লিখে বাংলা সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে নিজের শক্ত অবস্থা জানান দিয়েছেন। নিজেকে আড়ালে রেখে সমাজের বিকাশে ভূমিকা রাখাই ছিল এই মহাজীবনের মৌল মর্ম ও মূল প্রত্যয়।

প্রাবন্ধিক-গবেষক মালেকা বেগমের পর্যবেক্ষণে এভাবে উদ্ভাসিত হয় তাঁর অবদানের কালজয়ী মাত্রা, ‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের চিন্তাচেতনা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের দর্শন শতাব্দী পেরিয়ে আজও বিশ্বের নারীসমাজের সমানাধিকারের আন্দোলন ও নারীবাদী দর্শনের সমপর্যায়ে উন্নীত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাংলাদেশের সব সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়ার রচনা আজ পাঠ্য। নারী আন্দোলনের সনদ বা ঘোষণাপত্র হয়ে উঠেছে রোকেয়ার রচনাবলি।’ (রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মালেকা বেগম, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮)

শত বছরের বেশি সময়ের আগে প্রথমে বিহারের ভাগলপুরে মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় আর কলকাতায় ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রোকেয়ার যে নারীশিক্ষা বিস্তার—প্রয়াস শুরু হয়ে আজ তা এক অনন্য ইতিহাস। শুধু নারী নয়, সামগ্রিকভাবে মানবমুক্তির অন্যতম এই দিশারির অন্তর্গত সত্তার পরিচয় যেমন তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ-উপন্যাস-গল্প-কবিতা-রম্যরচনায় খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি তাঁকে গভীরে-গহনে, অনন্যতার আভায় পাওয়া যায় তাঁর চিঠিপত্রে।

মোশ্‌ফেকা মাহমুদের পত্রে রোকেয়া পরিচিতি (বাংলা একাডেমি, ১৯৬৫) বইতে সংকলিত হয়েছে দুর্লভ রোকেয়া-চিঠিপত্র; যেসব চিঠির পাতায় পাতায় পরিস্ফুট রোকেয়া ও তাঁর বৈরী পক্ষের স্বরূপ, তাঁর রসবোধ, কর্মস্পৃহা, শিক্ষাগত প্রাণের স্পন্দন, অনমনীয় ব্যক্তিত্বের বিভা।

১৯১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর চাচাতো বোন বেগম মরিয়ম রশীদকে এক চিঠিতে রোকেয়া নিয়মিত চিঠি না লিখতে পারার কারণ এবং স্কুল পরিচালনার কাজ করার ফলাফল নিয়ে লিখছেন, ‘চিঠি না লিখিবার একমাত্র কারণ সময়াভাব। বুঝিতেই পার এখন খোদার ফজলে পাঁচটি ক্লাস এবং ৭০টি ছোটবড় মেয়ে, দু’খানা গাড়ী, দুই জোড়া ঘোড়া, সইস, কোচম্যান ইত্যাদি ইত্যাদি সব দিকে একা আমাকেই দৃষ্টি রাখিতে হয়।...এই যে হাড়ভাঙা গাধার খাটুনী—ইহার বিনিময় কি, জানিস? বিনিময় হইতেছে “ভাঁড় লিপকে হাত কালা” অর্থাৎ উনুন লেপন করিলে উনুন তো বেশ পরিষ্কার হয় কিন্তু যে লেপন করে তাহারই হাত কালিতে কালো হইয়া যায়। আমার হাড়ভাঙা খাটুনীর পরিবর্তে সমাজ বিস্ফারিত নেত্রে আমার খুঁটিনাটি ভুলভ্রান্তির ছিদ্র অন্বেষণ করিতেই বদ্ধ পরিকর।’

বেগম মরিয়ম রশীদকে ‘কল্যাণীয়া মেরী’ সম্বোধনে ৫ জানুয়ারি ১৯২৬ আলীগড় সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখা আরেক চিঠিতে ফুটে উঠেছে মহামারির কবলে পর্যুদস্ত প্রিয় বাংলা নিয়ে তাঁর এমন হাহাকার, ‘বলি, আমার বাংলা দেশ! যদি কিছু না-ই করিস, তবে দড়ি ও কলসীর সাহায্যে তোর অস্তিত্ব লোপ করিতে পারিস তো। সেজন্যও আর বেশী ভাবনা নাই—ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর সে ভার লইয়াছে। আহা, বুকটা ফাটিয়া যাইতে চায়।’

তাঁর একটি চিঠিতে ত্রিশের দশকের কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সামাজিক প্রভাব অনুধাবনে আসে এভাবে, ‘স্নেহাস্পদা মরিয়ম, দাঙ্গায় আমরা প্রত্যক্ষ শহীদ হই নাই বটে, কিন্তু পরোক্ষে অনেক ক্ষতি সহ্য করিতেছি...। অনেক লোক কলকাতা ত্যাগ করায় স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা কমিয়াছে।’

২১ মে ১৯২৯ চাচাতো বোন মোহসেনাকে ‘আমার স্নেহের মোনা’ সম্বোধনে লিখছেন, ‘তোমার প্রেরিত কাসন্দ পেয়ে সুখী হয়েছি। তুমি কাসন্দ না দিয়ে যদি স্কুল ফান্ডে চার পাঁচটা টাকা পাঠাতে তাতে আমি বেশী সুখী হতুম।’

স্কুলের সহায়তার জন্য আত্মীয়ার কাছে এই আকুল আহ্বান প্রমাণ করে, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে ছিলেন রোকেয়া।

অবিভক্ত বাংলার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন খান বাহাদুর তোসাদ্দক আহমদকে ৯ আগস্ট ১৯৩১ তারিখ লেখা চিঠিতে আমলাতন্ত্রের দীর্ঘসূত্রতার বিরুদ্ধে রোকেয়ার ক্ষোভ বাঙ্‌ময় হয়েছে, ‘পূর্বতন সেক্রেটারীদের বিরুদ্ধে আমার একটিই অভিযোগ যে ইহারা আমাকে সকল সময় পিছনে টানিয়া রাখিয়াছেন। নতুবা স্কুলটি অনেক আগেই উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে পরিণত হইত। এতদিনে ইহার নিজস্ব বাড়ীও হইয়া যাইত একটি। আমার মত ও পথ “বাঁচিলে হইব গাজী, মরিলে শহীদ”। কিন্তু সেক্রেটারী সাহেবরা সবসময় গাজী হইতে চাহিয়াছেন।’

রক্ষণশীল সমাজের আঘাতে জর্জরিত রোকেয়া যেন আহত হৃদয়ের শুশ্রূষার সন্ধান পেতেন প্রকৃতির প্রশস্ত পক্ষপুটে। তাই তো ১৪ ডিসেম্বর ১৯৩১ ঘাটশিলা থেকে বেগম তোসাদ্দক আহমদকে লেখা চিঠিতে বলছেন, ‘এখন এখানে বেড়াইবার বড় আরাম। ধান কাটা হইয়াছে, সেই সব ক্ষেতের নরম খড়ের উপর হাঁটিতে কি মজা। প্রাণ ভরিয়া হাঁটিয়া বেড়াই।’

মুহূর্তেই আমাদের মনে পড়ে ‘বাসিফুল’ বা ‘প্রভাতের শশী’ কবিতার রচয়িতা রোকেয়াকে।

মৃত্যুর বছর অর্থাৎ ১৯৩২-এর ২৫ এপ্রিল শুভার্থী তোসাদ্দক আহমদকে লেখা আরেক চিঠিতে ব্যক্ত হয়েছে রোকেয়ার শিক্ষাসংগ্রামের প্রকৃত গতিবিধি; নেহাত স্বামীর স্মৃতিরক্ষা যে তাঁর স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার উদ্দেশ্য নয়, সেটি স্পষ্ট করেন তিনি, ‘ভাই সাহেব, আপনি ঘুণাক্ষরেও ভাববেন না যে, আমার শ্রদ্ধেয় স্বামীর স্মৃতিরক্ষার জন্যই আমি এ স্কুল আঁকড়ে পড়ে আছি।...আমি স্বামীর নামের কাঙ্গাল নই। কারণ আমি জানি তাঁর সত্যিকার স্মৃতি আমার সাথেই রয়েছে ও আমার সাথেই লুপ্ত হয়ে যাবে।’

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে রোকেয়া নামে যে প্রদীপ প্রজ্বালিত হয়েছিল, ১৯৩২ সালের সেই ৯ ডিসেম্বরেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে কিন্তু রোকেয়া নামের প্রদীপ আজও জ্বলছে। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামের প্রবন্ধ দিয়ে যে লেখক রোকেয়ার যাত্রা শুরু, ১৯৩২ সালে মৃত্যুর অব্যবহিত আগে অসমাপ্ত লেখা ‘নারীর অধিকার’ প্রবন্ধে তাঁর সাহিত্যিক পরিণতি। আজ নারী অধিকারের জয়মশাল-জ্বলা বাংলাদেশ যেমন রোকেয়ার স্বপ্নের বলিষ্ঠ প্রকাশ, তেমনি নিত্য নারী ও মানব-লাঞ্ছনার সমাজ প্রমাণ করে, রোকেয়ার পথ ধরে আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূরে। আর পথ চলে যেতে যেতে আমরা রোকেয়ার কাছ থেকেই তো পাব এমন অভয়ের ডাক, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা-গ্লানি, উপেক্ষা-অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে; মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’