
ছাপচিত্র চারুকলা অনুষদের একেবারে শুরুর দিকের একটি বিষয় হলেও শুরুতে এর ব্যাপ্তি তেমন বিস্তৃত হয়নি।
ইদানিং মাধ্যম হিসেবে ছাপাই ছবি যেমন সম্প্রসারিত হয়েছে, তেমনি বেড়েছে এর বৈচিত্র্যও। সম্প্রতি ‘শূন্য আর্ট স্পেস’ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালার ভাস্কর্য গ্যালারিতে আয়োজন করেছে ‘শেষ থেকে শুরু: বাংলাদেশের ছাপচিত্রে বহু মাত্রিকতার উদ্যাপন’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী। এখানে রয়েছে এ দেশের ছাপচিত্রের শুরুর সময় থেকে সাম্প্রতিকতম সময়ের কাজ। প্রদর্শনীজুড়ে আছে চমকে যাওয়ার মতো অজস্র উপাদান।
প্রথমেই চমকে যেতে হলো ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ নামে একটি পোর্টফোলিও দেখে। ১৯৭১ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। রশিদ চৌধুরী, দেবদাশ চক্রবর্তী, সাবিথ উল আলম, মিজানুর রহিম, আনসার আলী, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ—এই ছয়জন শিল্পীর কাজ আছে এখানে। এর মধ্যে রশিদ চৌধুরী, দেবদাশ চক্রবর্তী ও সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের কাজ নজর কাড়ে বিশেষভাবে।
রশিদ চৌধুরীর কাজে আমরা দেখি বাঘের সিংহবধের দৃশ্য আর দেবদাশ চক্রবর্তীর কাজে জ্যামিতিক নকশায় অছে দ্রোহে উদ্বেলিত মানুষের মুখ। সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ কি মুক্তিযোদ্ধা এঁকেছেন? এই সিরিজের প্রতিটি ছবিতেই প্রকাশিত হয়েছে বিদ্রোহ।
চমৎকৃত হলাম কামরুল হাসানের একটি বিশাল আকৃতি কাঠখোদাই প্লেট দেখে। এত বিশাল কাঠখোদাই এখন সচরাচর চোখে পড়ে না। সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া আমাদের ছাপচিত্রশিল্পের প্রবাদপুরুষ। এঁদের দুজনের কাজই দেখা গেল প্রদর্শনীর শুরুতে। সফিউদ্দিন আহমেদের কাজের শিরোনাম ‘গৃহের পথে’। এটি আমাদের সফিউদ্দিনের প্রথম জীবনের কাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
‘স্মৃতি-৫’—৮০ সালে করা মোহাম্মদ কিবরিয়ার এই শিল্পকর্মে আছে শিল্পীর স্বভাবগত মুনশিয়ানার পরিচয়।
আবদুর রাজ্জাক বললেই ভাস্কর্যের কথা এত বেশি আসে যে মনেই থাকে না তিনি ছাপাই মধ্যেরও একজন প্রধান শিল্পী। প্রদর্শনীতে তাঁর কাজের শিরোনাম ‘দণ্ডায়মান মানুষ’। কাজটি মধ্যমগত দক্ষতায় তো বটেই শৈলীগতভাবেও অসাধারণ। নানা ধারার কাজ করেছেন আমিনুল ইসলাম। প্রদর্শনীতে ‘ফ্লোবেজন’ শিরোনামে তাঁর যে কাজটি রয়েছে, সেটি এচিং একোয়াটিস্ট মাধ্যমে করা। এখানে রেখার পেলবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এ দেশের লোকজ মোটিফ এবং কিছুটা শিল্পীর শেষজীবনের কাজের ধারার কথাও।
কাইয়ুম চৌধুরীর ‘বেড়াল’ শিরোনামের লিথোগ্রাফটিতে দেখতে পাই অন্য এক কাইয়ুম চৌধুরীকে। ১৯৫৩-তে তিনি কেমন ধরনের কাজ করতেন, আমরা অনেকেই সেটি জানি না। তাঁর এ কাজটিতে পাওয়া যাবে যামিনী রায়ের ছায়া। এখানে অবুল বারক আলভীর যে ছবিটি আছে, সেটি আঁকার সময় শিল্পী ব্যবহার করেছিলেন সহজলভ্য উপাদান—টিনের পাত।
এ প্রদর্শনীতে না গেলে হয়তো জানাই হতো না কাঠখোদাই মাধ্যমে জামাল আহমেদের দক্ষতা কতটা। এখানে থাকা ‘নদীতে মাছ ধরা’ শিরোনামে শিল্পীর কাজটি এক্সপেÊশনিস্ট ধারার রঙিন কাঠখোদাইয়ের একটি ভালো উদাহরণ।
মনিরুল ইসলামকে আমরা চিনি তাঁর ছাপাই ছবির জন্য। এ প্রদর্শনীতে দেখা গেল ১৯৯০ দশকে করা শিল্পীর একটি চমৎকার কাজ। ‘দিগন্তের খেলা’ শিরোনামে এ কাজে বিন্যাসের ম্যাজিক ব্যবহার করে দিগন্তকে দারুণভাবে নবায়ন করেছেন শিল্পী।
আবার ঢালী আল মামুনের ‘বেহুলা’ সিরিজের কথা যাঁদের মনে আছে, প্রদর্শনীতে এসে নস্টালজিক হয়ে পড়তে পারেন তাঁরা।
রোকেয়া সুলতানার যাত্রা শুরু ‘ম্যাডনা’ সিরিজের কাজ দিয়ে। এখানে সেই ‘ম্যাডনা’ সিরিজের একটি কাজ কিছুটা সময়ের জন্য স্থির করেছে আমাদের।
পক্ষান্তরে, ছাপাই মাধ্যমে রশিদ আমিনের দক্ষতা ও রচনাশৈলী তাঁকে দিয়েছে একটি স্বতন্ত্র ভাষা। এখানে আমরা দেখব শিল্পীর ‘অসীমের সন্ধানে’ শিরোনামের ছবি, যার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দক্ষতা।
নবীন শিল্পীদের মধ্যে আবদুল সোবহান হীরার ‘জীবন এবং সময়’ শীর্ষক ছবিটি দৃষ্টি কাড়ে। তাঁর রচনায় জ্যামিতিক গঠন ও রেখার প্রয়োগ মনে করিয়ে দেয় কালিদাশ কর্মকারের আশির দশকের কাজের কথা।
রুহুল আমিন তারেকের কাজের শিরোনাম ‘বাস্তবতার জটিলতা’ এখানে দেখা যায়, তিনি এঁকেছেন নিজের আত্মপ্রতিকৃতি, আর কয়েকটি গানের কথার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে আসছেন বাইরে। এ ছাড়া নিতুন কুন্ডু, আবদুস সাত্তার, অলকেশ ঘোষ, নাসরিন বেগম, মোহাম্মদ ইকবাল, সাইদুল হক, আহমেদ নজির—শিল্পীদের ছবির একদিকে যেমন রয়েছে নিজস্বতার স্বাক্ষর, তেমনি আছে মুগ্ধতার ছোঁয়া। অন্যদিকে ভাষা বিনির্মাণ বা মাধ্যমগত উৎকর্ষের কারণে যেসব তরুণ শিল্পীর কাজ গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচনার দাবি রাখে, তাঁরা হলেন অশিত মিত্র, সৌরভ চৌধুরী, ফাহিমা আহমেদ, জয়া শাহরিন হক, রশিদা আক্তার, রুবি জামান, সুজিত সরকার, মোয়াজ্জেম হোসেন, ফারহানা ইয়াসমিন প্রমুখ।
এ প্রদর্শনীর বৈশিষ্ট্য হলো বাংলাদেশের প্রবীণ-নবীন শিল্পীদের কাজ, তাঁদের সুসংহত বর্ণিল ক্যানভাস, যার অধিকাংশই বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশের ছাপচিত্রের বিশাল জগৎকে উন্মোচিত করছে প্রদর্শনীটি।
এর সঙ্গে আয়োজিত হয়েছে দুটি কর্মশালা।
৯৬টি শিল্পকর্ম নিয়ে ১৬ মে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনীটি চলবে ৩০ তারিখ পর্যন্ত।