বাংলা একাডেমিতে চলছে ‘ঢাকা সাহিত্য উৎসব’। তিন দিনের এই আয়োজন শুরুর আগ মুহূর্তে প্রথমআলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন উৎসবের অন্যতম পরিচালক সাদাফ সায্। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
আলতাফ শাহনেওয়াজ: এর আগে আপনারা চারটি উৎসব করেছেন। এবারের আয়োজনের শিরোনাম ‘ঢাকা সাহিত্য উৎসব’। বিগত চার উৎসবে আপনাদের অর্জনগুলো কী?
সাদাফ সায্: সত্যি বলতে, সাহিত্যের বৈশ্বিক পরিমণ্ডল থেকে আমরা বাঙালি লেখকেরা একটু দূরে অবস্থান করছি। সমকালীন পৃথিবীর খ্যাতনামা লেখক-প্রকাশকদের সঙ্গে আমাদের তেমন যোগাযোগ নেই—বিষয়টি আমাকে ভাবাত। একসময় মনে হলো, আমাদের কেউ যদি ভালো কোনো কিছু লেখেন, বাংলাদেশের বাইরের কারও পক্ষে সেটি জানা তো দুষ্কর। তখন ভাবলাম, আমাদের যে সমৃদ্ধ সাহিত্যসম্ভার রয়েছে কীভাবে তা অন্যদের সামনে তুলে ধরা যায়। আমরা কি এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারি না, যার মাধ্যমে একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা যাবে এবং বিশ্ব সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটবে।
তো, ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো আমরা শুরু করি ‘হে সাহিত্য উৎসব’। আজ চার বছর বাদে অর্জনগুলো যদি বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে অর্জন কম নয়। আমাদের অনেকের লেখা এখন বাইরে থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। মারিয়া চৌধুরী, কাজী আনিস আহমেদ, খাদেমুল ইসলামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রকাশকদের চুক্তি হয়েছে, তাঁদের বইও বের হয়েছে। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক সাদ জেড হোসেনের বইও বের হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
আমরা যতটা লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের সম্পর্কে জানি, ঠিক একইভাবে এ দেশের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের সমন্ধে বাইরের পৃথিবীর মানুষ জানে না। আমাদের উৎসবের একটা মূল উদ্দেশ্য এই যে বাংলাদেশের লেখক ও তাঁদের লেখাজোখা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া, যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। দিনে দিনে বাংলাদেশের লেখকদের সম্পর্কে বাইরের প্রকাশকদের যেমন আগ্রহ বাড়ছে, তেমনি বাংলা সাহিত্য অনুবাদ করে প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও তাঁরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
এ ছাড়া গত চার বছরে কয়েকটি নতুন ইংরেজি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছে এ দেশে—ডেইলি স্টার বুকস, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ও বেঙ্গল লাইটস বুকস। উপরন্তু বেঙ্গল লাইটস নামে ইংরেজি সাহিত্যের একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীও এখন প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নিজের দেশে আমরা যদি নিজেদের লেখা ইংরেজিতে ছাপাতে পারি, তবে অন্য দেশের প্রকাশকও আমাদের ব্যাপারে উৎসাহ দেখাবেন। এ ক্ষেত্রে সাদ জেড হোসেনের কথা বলা যায়। তাঁর ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, প্রথমে ওঁর বই বের হয়েছিল বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে। তারপর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই দেশেই প্রকাশক পেয়েছে বইটি।
উৎসবে আসার পর ভিনদেশি লেখকেরা প্রথমে বাংলা ভাষা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেন। ভাষা নিয়ে আমদের রয়েছে গর্বের ইতিহাস, ভাষার জন্য আমরা জীবন উৎসর্গ করেছি—এসব জেনে তাঁরা আপ্লুত হন। আবার কবিতা শোনার জন্য আমাদের এখানে যখন শত শত মানুষ জড়ো হয়—দৃশ্যটি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হন বাইরের দেশের লেখকেরা। ঢাকাকে এখন তাঁরা এক নামে চেনেন। তারপর ধরুন, এই চার বছরে বড় লেখক-প্রকাশক ও বিশ্বের অন্যান্য উৎসব-আয়োজকদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে, একটা সংযোগ তৈরি হয়েছে। আজকালকার যুগে এটি খুব দরকার। সহজ করে বললে আমাদের অর্জন এগুলোই। তবে অর্জন কিন্তু একবারে নয়, দিনে দিন হবে।
আলতাফ: ২০১১ সালে উৎসবের শুরুর পর্বে উদ্যোগক্তা ছিলেন কারা?
সাদাফ: সাহিত্য উৎসব করার বিষয়ে প্রথম কথা হলো কথাশিল্পী তাহমিমা আনামের সঙ্গে। এর কিছুদিন পর তাহমিমা আমাকে জানালেন, হে সাহিত্য উৎসবের বিশ্ব পরিচালক পিটার ফ্লোরেন্স তাঁকে জানিয়েছেন, পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশ ও কলকাতায় ‘হে সাহিত্য উৎসব’ করতে চান তাঁরা। তারপর ইংরেজিতে লেখেন এমন অনেক লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম আমরা। প্রথম দিকে এবং পরবর্তী সময়ে ডেইলি স্টার খুব সাহায্য করেছে আমাদের। ব্রিটিশ কাউন্সিল তো ছিলই। ছোট পরিসরে প্রথম উৎসবটি ব্রিটিশ কাউন্সিলেই হয়েছিল। পরের বছর থেকে বাংলা একাডেমিতে বেশ বড় পরিসরেই উৎসবটি করেছি আমরা। এবারের উৎসবে আমি ছাড়াও দুজন পরিচালক রয়েছেন—আহসান আকবার ও কাজী আনিস আহমেদ, যাঁরা গোড়া থেকেই সংশ্লিষ্ট এ উৎসবের সঙ্গে।
আলতাফ: ২০১২ সালে বাংলা একাডেমিতে যখন উৎসবটি বড় আয়োজনে শুরু হলো, উৎসব নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল সে সময়।
সাদাফ: আমি মনে করি, বিতর্কের প্রয়োজন ছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের অনুরাগ ও ভালোবাসা। একটা কথা বলি, আমাদের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যচর্চা নয়; বাংলা ভাষার মহৎ সাহিত্যগুলো অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাই আমরা। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব এ জন্য যে তাঁদের সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতা করতে পারি। সর্বোপরি আমরা চাই বাংলাদেশের সাহিত্যকে জগতে তুলে ধরতে।
আমরা অনেকেই বাংলা মাধ্যমে পড়েছি এবং বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করছি। কিন্তু আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে এখন তো ইংরেজি মাধ্যমেও পড়ছেন। তাঁদের অনেকে এবং বাংলা মাধ্যমে পড়া অনেকেই ইংরেজি ভাষায় চালিয়ে যাচ্ছেন সাহিত্যচর্চা। আমার তো মনে হয়, এতে করে সাহিত্যের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে তুলে ধরা অনেক সহজ হচ্ছে।
আলতাফ: ‘হে সাহিত্য উৎসব’ থেকে এবারের আয়োজনটির নাম ‘ঢাকা সাহিত্য উৎসব’। হঠাৎ নাম পরিবরর্তন হলো কেন?
সাদাফ: আগেই বলেছি, চার বছর ধরে উৎসবটি করার মধ্য দিয়ে খানিকটা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আমরা। ‘হে সাহিত্য উৎসব’ নাম দিলে আমাদের ঢাকা অনেকটা ঢাকা পড়ে যায়। তা ছাড়া উৎসবের সব ধরনের পৃষ্টপোষকতাও আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ থেকে। সুতরাং দেশের টাকা খরচ করে কেন বিদেশি ব্র্যান্ডকে প্রমোট করব? হ্যাঁ, প্রথম দিকে ‘হে’-এর ব্যানারে উৎসব করা ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। কারণ, তখন আমরা অনেক কিছুই জানতাম না। তবে এই চার বছরে ধীরে ধীরে জেনেছি, শিখেছি। এখন সময় এসেছে পরবর্তী পদক্ষেপের। আর সেই পদক্ষেপটি হলো, বাংলাদেশ ও ঢাকাকে ব্র্যান্ডিং করা। ‘ঢাকা সাহিত্য উৎসব’ নামকরণের মাধ্যমে ঢাকা ও বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে চেয়েছি আমরা।
আলতাফ: কারা আসছেন এবারের উৎসবে?
সাদাফ: বরাবরের মতো কবি, লেখক, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, মানবাধিকারকর্মী—সব মিলিয়ে একঝাঁক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সমাগম ঘটছে এবারের উৎসবে। আসছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেলজয়ী হ্যারল্ড ভার্মাস, বিজ্ঞানী হলেও লেখালেখিতে তিনি সক্রিয়; এ ছাড়া ভারতীয়দের মধ্যে রয়েছেন নয়নতারা সায়গল, শোভা দে, আরিভন কৃষ্ণ মেহেরোত্রা, রামচন্দ্র গুহ, তিলোত্তমা মজুমদার এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক অমিত চৌধুরী; পাকিস্তানের মানবাধিকারকর্মী ও লেখক আসমা জাহাঙ্গীর; যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক জনস স্নো; ফিলিস্তিনের কবি হাসান যাকতান; কিউবার বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকার ইয়োস; কেনিয়ার কথাশিল্পী মুথনি গার্লেনসহ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি।
আলতাফ: অতিথিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কী ভেবেছেন?
সাদাফ: নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকার আমাদের সহযোগিতা করছে। আমাদের সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আছে, সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে বাংলা একাডেমি। এ ছাড়া লেখকেরাও যুক্ত রয়েছেন।
আলতাফ: বিগত উৎসবগুলো থেকে এই উৎসবের বিশেষত্ব কী?
সাদাফ: ইতিমধ্যে এ উৎসবে অনেকগুলো থিম বের হয়ে এসেছে। এর একটা হলো, ‘সাহিত্যের মধ্য দিয়ে নারীর সংগ্রাম, নারীর লড়াইয়ের প্রকাশ’। ফলে ‘উইমেন ইন দ্য ওর্য়াল্ড’ এবার আমাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে। আরেকটি থিম, ‘বাংলাদেশের লেখা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া’, যার অংশ হিসেবে প্রসিদ্ধ সাহিত্য সাময়িকী ওয়াসাফিরি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিষয় করে পুরো একটি সংখ্যা বের করছে। বাংলাদেশ ও লন্ডন থেকে একযোগে প্রকাশিত হবে পত্রিকাটি। উৎসব উপলক্ষে ওয়াসাফিরির সম্পাদক সুশীলা নাস্তা আসছেন ঢাকায়।
আলতাফ: বাংলা ও ইংরেজি—এই দুই ভাষায় বাংলাদেশে যাঁরা লেখালেখি করছেন, তাঁদের মধ্যে সংযোগ তৈরির ক্ষেত্রে উৎসব কীভাবে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন?
সাদাফ: আমাদের দেশে যাঁরা বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেন তাঁদের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করা লেখকদের সাধারণত খুব একটা যোগাযোগ হয় না, হলেও কালেভদ্রে। কিন্তু এই উৎসবের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পর ভাব বিনিময়ের সুযোগ পান, কথা বলতে পারেন, একে অপরের ভেতরে ভাবনা আদান-প্রদানের সুযোগ ঘটে, বইয়ের লেনদেন হয়। যে সংযোগের কথা বললেন, সেটি সৃষ্টি হচ্ছে এভাবেই।
আলতাফ: ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করছেন আমাদের অনেকেই। এঁদের মধ্যে সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে কারও কি কোনো অবস্থান তৈরি হয়েছে?
সাদাফ: না, আমরা এখনো কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারিনি। তবে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিভিন্ন প্রকাশক এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে জানেন, আমাদের লেখকদের ব্যাপারে উৎসাহী। প্রতিবছর উৎসবে তাঁরা ঢাকায় আসছেন। আর এর মাধ্যমে আমাদের অবস্থান তৈরির একটা সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলেই মনে হয়।
আলতাফ: বাংলা ভাষার সাহিত্য আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। প্রতিবন্ধকতাটি কোথায়?
সাদাফ: প্রতিবন্ধকতা দুটি—প্রথমত, আমাদের অনুবাদের মান ভালো ছিল না। দ্বিতীয়ত, নিজেদের সাহিত্যকে আমরা ঠিকঠাকমতো বাজারজাত করতে পারিনি। আশার কথা হলো, ধীরে ধীরে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটছে।
আলতাফ: বাংলা সাহিত্য যথাযথভাবে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে আপনাদের পরিকল্পনাটি কেমন? উৎসবের মধ্য দিয়ে আপনারা আসলে কোথায় পৌঁছাতে চান?
সাদাফ: আমাদের স্বপ্ন অনেক বড়। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে বাংলা সাহিত্যের উৎসব করার স্বপ্ন দেখি আমরা। এখন ঢাকায় করছি, তখন হয়তো লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা দিল্লিতে করব। তাদের জানাব, আমাদেরও রয়েছে বিশ্বমানের সাহিত্য। এর জন্য সবার আগে দরকার মানসম্পন্ন অনুবাদ, যার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। একজন লিও তলস্তয়কে দিয়ে গোটা বিশ্ব যেমন রাশিয়াকে চেনে, গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ যেমন প্রতিনিধিত্ব করেন লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের; একইভাবে আমরা চাই, বাংলাদেশের সাহিত্যও বিশ্ব্যাপী পরিচিত পাক। জগৎবাসী জানুক আমাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সাহিত্য আছে। উৎসবের মধ্য দিয়ে আসলে আমরা এমন একটি পাটাতন নির্মাণ করতে চাই, যার মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে বিশ্ববাসী।