জসীমউদদীন কেন আধুনিক

জসীমউদ্দীন কি ‘পল্লিকবি’, নাকি তাঁর কবিতায় আছে আধুনিকতার অন্য এক মাত্রা? জসীমউদ্দীনের মৃত্যুবার্ষিকী সামনে রেখে তাঁকে নতুনভাবে অবলোকন
জসীমউদ্দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩-১৪ মার্চ ১৯৭৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
জসীমউদ্দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩-১৪ মার্চ ১৯৭৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের কবিদের নাম বলতে গেলে প্রথমেই যে কয়েকজনের নাম মনে আসে, জসীমউদ্দীন তাঁদেরই একজন। তাঁর আগে জন্ম নেওয়া কবিদের মধ্যে মধুসূদন আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। তাঁরা বড় হয়েছেন সচ্ছল পারিবারিক পরিবেশে। পরিবারেই তাঁরা পেয়ে গেছেন আধুনিক শিক্ষার উন্নত পরিবেশ। নাগরিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বড় হওয়ায় এদিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন তাঁরা। মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের মতো জমিদারপুত্র না হলেও জীবনানন্দ দাশও ছিলেন নগরজীবনের পরিশীলনে এগিয়ে থাকা পরিবারেরই সন্তান। নজরুলের জন্ম গ্রামে। কিন্তু তিনিও প্রধানত নগর সংস্কৃতির পরিশীলনেই নিজের চেতনাকে রঞ্জিত করেছেন। অন্যদিকে, জসীমউদ্দীনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামে! তবে আধুনিক শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে তাঁরও নাগরিক সংস্কৃতির পরিশ্রুতি ঘটেছে। তবে প্রথম তিনজনের সঙ্গে নজরুল ও জসীমউদ্দীনের জীবনযাত্রা একটু আলাদা। কারণ, গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর ভিত্তি করে তাঁদের দুজনের সৃষ্টিকর্ম পাখা মেলেছে। এর মধ্যে আবার নাগরিক মানসের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও জসীমউদ্দীন প্রধানত গ্রামীণ মানুষের জীবনের রূপকে কবিতা করে তুলে পরিবেশন করেছেন। যদিও তাঁর এই পরিবেশনার লক্ষ্য নগরের মানুষেরাই। নজরুল জসীমউদ্দীনের চেয়ে আগেই আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন সৃষ্টিশীলতার বৈশিষ্ট্যে বিদ্রোহী সত্তা বা জাতীয় সত্তার জাগরণকে উপজীব্য করেছিলেন বলে। তাঁর কবিসত্তা অবশ্য জসীমউদ্দীনের মতো গ্রামজীবনেই সীমিত থাকেনি। ফলে গ্রামলগ্নতার ‘অপরাধে’ জসীমউদ্দীন আধুনিকদের পঙ্ক্তিভুক্ত হতে পারলেন না।
বয়সে জসীমউদ্দীনের চেয়ে নজরুল মাত্রই কয়েক বছরের বড়। জীবনানন্দ দাশও নজরুলেরই সমবয়সী। তিনিও জসীমউদ্দীনের চেয়ে বয়সে অল্প প্রবীণ। উভয়েই রবীন্দ্রনাথের পরের কবি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পরের কিছু কবি সচেতনভাবে নিজেদের রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আলাদা বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের আলাদাভাবে ‘আধুনিক’ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করলেন। নৈরাশ্য, নির্বেদ, বিবিক্তি আর অনিকেত ভাবনাকে ধারণ করে আছে ওই ‘আধুনিকবাদ’। জীবনানন্দ দাশও ছিলেন তাঁদের দলভুক্ত। ক্রমেই এই রবীন্দ্রবিরোধীরাই বেশি প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যিক সমাজে। নজরুল ওই দলটির চেয়ে একটু আগেই কবিসত্তায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিনিও ছিলেন আলাদা। কিন্তু আলাদা হওয়ার বিশেষত্বে গত শতাব্দীর তিরিশের দশকি আধুনিকদের তিনি ততটা দলভুক্ত ছিলেন না, যতটা ছিলেন জীবনানন্দ। জসীমউদ্দীন রবীন্দ্রবিরোধী বলে নিজেকে ঘোষণা দেননি। এমনকি পল্লিজীবন নিয়ে কবিতা লিখলেও তাঁকে কেউ কেউ রবীন্দ্রানুসারীও বলে থাকেন। ফলে তিনিও আধুনিকের দলভুক্ত হতে পারলেন না। জসীমউদ্দীনের কবিতায় আধুনিকতার সন্ধান করতে হলে বাংলা কবিতার এই বিশেষ সময়ের পটভূমিকে স্মরণে রাখতে হবে আমাদের।
গত শতকের তিরিশ দশকি আধুনিকতার সঙ্গে নগরচেতনার একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অথচ জসীমউদ্দীন গ্রামজীবনের কবি। তাহলে তিনি আধুনিক হবেন কী করে? এই প্রশ্নটা মাথায় রেখে আমরা যদি তাঁর গোটা জীবনের কথা জানতে চেষ্টা করি তাহলে হয়তো তিনি ‘আধুনিক’ কি ‘আধুনিক’ নন, সেই বিতর্কের আড়াল ঘুচতে পারে। হয়তো এর ফলে তাঁর জীবন ও কবিতার সম্পন্ন সৌন্দর্যকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করতে পারব আমরা।
বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকেই বাংলা কবিতার সঙ্গে এই ‘আধুনিকতা’র সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠেছে। ফলে বাংলা কবিতার প্রসঙ্গে ‘আধুনিকতা’ শব্দটি মোটাদাগে যে বোধকে ধারণ করে, তার কথা চলে আসে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে ওই সময় থেকেই কবিদের মধ্যে কেউ কেউ আধুনিকতার প্রতিনিধি। ফলে আধুনিক না হলে কবিতার আলোচনায় কারও নাম আসা উচিত নয়—এমনও বলতে শোনা গেছে। মানে কবিত্ব আর আধুনিকতা যে এক নয়, সে কথা কারও কারও মনে থাকেনি। যিনি আধুনিক নন, তাঁকে কবি বলে বিবেচনা করতে রাজি নন তাঁরা। কোনো কোনো কবি যথেষ্ট ‘আধুনিক’ না হয়েও যে শক্তিমান কবি হতে পারেন, এ কথা অনেকেই ভুলে যান। জসীমউদ্দীনের কবিত্ব নিয়ে একসময় তাই এমন একটা সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশের কবিতাপ্রেমিকদের একটা অংশের মনে। অথচ জসীমউদ্দীন বোঝাতে চেষ্টা করেছেন আমাদের গ্রামবাসীদের নিয়ে যাঁরা কবিতা লিখেছেন, তাঁরাই সত্যিকারের বাঙালি কবি। আমাদের গ্রামের কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমোর, জেলে বা মাঝিদের জীবনযাত্রা বা মনোজগৎ নিয়ে যেসব কবিতা রচনা করা হয়, সেসব কবিতাই সত্যিকারের আমাদের কবিতা। সে কবিতাই বাংলার খাঁটি সম্পদ।

পল্লিজীবনের নানা রূপ জসীমউদ্দীনের কবিতার সম্পদ। তাহলে কী হবে, যাকে বলে আধুনিকতা, তার অনেক কিছুই যে তাঁর নেই! তাই সে সারিতে তাঁকে রাখতে কারও কারও আপত্তি ছিল। আর রাখলেও রাখা হয়েছিল নিছকই ব্যতিক্রম হিসেবে। এটা কেন হয়েছে, তা যদি আমরা একটু বুঝে নিতে চেষ্টা করি, তাহলে জসীমউদ্দীনকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে। হয়তো সুবিধা হবে সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতার সৌন্দর্য অনুভব করতেও।

.
.

‘পল্লিকবি’ ছাপ মারা ছিল বলে নগরজীবনবাদীরা তাঁকে আধুনিকদের দলে রাখতে না চাইলেও নগরেও তাঁর পাঠকপ্রিয়তা ছিল বিপুল। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে যাঁরা কবি হিসেবে ‘আধুনিক’, তাঁদের চেয়ে অধিকসংখ্যক নগরবাসী মানুষ তাঁর কবিতা ভালোবাসে। কারণ, জসীমউদ্দীন যে কবিতা লিখতেন, তা তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের বেশিসংখ্যক মানুষের চেনা জীবনের কথা। বাংলাদেশে হাজার বছর ধরে যাঁদের বাস, তাঁদের প্রায় সবাই গ্রাম–সমাজের অধিবাসী। নদীমাতৃক বাংলাদেশে সব সময় কৃষিই ছিল প্রধান নির্ভরতা। এখন এত যে নগরের বিস্তার ঘটেছে, তাতেও সংখ্যার দিক থেকে নগরবাসীরা গ্রামবাসীদের ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। উপরন্তু যাঁরা নগরে বাস করেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই মনে বাস করে গ্রামজীবনের স্মৃতি। ফলে জসীমউদ্দীনের সামগ্রিক কবি-চৈতন্য বিবেচনায় রাখলে তাঁর মনোভাবটিও বুঝতে পারা যায়। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে কাব্যবোধের জাগরণ ঘটেছে, তাতে গ্রামের অনুভূতির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।
জসীমউদ্দীনের কবিতাকে ভালোভাবে বুঝে নিতে হলে আধুনিকতা কী, তাঁকে যাঁরা আধুনিক বলে মানেন না, তাঁরা কী বলতে চান, আবার যাঁরা জসীমউদ্দীনকেই মনে করেন সত্যিকারের আধুনিক, তাঁরা কেন সে কথা বলেন—সেসব নিয়ে আরও ভালোভাবে ভাবতে হবে আমাদের।
জসীমউদ্দীনকে ‘পল্লিকবি’ বলা হলেও যাঁকে বলে লোককবি তিনি তা নন—মোটাদাগেই তা আমরা বোঝাতে পারি। এ কথা ঠিক যে গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক জীবনযাপনের মধ্য থেকেই তাঁর কবিসত্তা জেগে উঠেছে। গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গী নানা শিল্পসংরূপের মাধ্যমেই তাঁর কবিসত্তার প্রকাশ। নৈরাশ্য, নির্বেদ, বিবিক্তি আর অনিকেত ভাবনা তাঁর উপজীব্য নয় বলে তাঁকে আধুনিক কবিদের দলে ফেলা হয় না বটে, কিন্তু অন্য এক অর্থে তিনিও আধুনিকই। কী সেই আধুনিকতা?
বাংলাদেশে ক্রমেই যে নগর গড়ে উঠছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এ কথাও মানতে হবে যে তাতে ইউরোপীয় নগরমানসের বাস্তবতাও নেই। যেসব কারণে ইউরোপে অনিকেত মানসিকতার সৃষ্টি, বাংলাদেশে ওই মানসিকতা সৃষ্টি হওয়ার ভিত্তি তা নয়। শিল্পবিপ্লব ও বুর্জোয়া পুঁজির বিকাশের প্রভাবে ইউরোপীয় সমাজে যে ধরনের সামাজিক রূপান্তর ঘটেছিল, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সমাজ রূপান্তরের অনেক কিছুরই মিল নেই! ফলে ইউরোপীয় নগরমানসের সঙ্গেও সামগ্রিক অর্থে বাংলার নগরমানসের মিল থাকতে পারে না।

জসীমউদ্দীন
জসীমউদ্দীন

আমরা লক্ষ করব যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শিল্পসংরূপগুলো তাদের জীবনযাপনের প্রতিক্রিয়াজাত। ফলে বাংলাদেশের একজন কবির আধুনিকতার বোধ ইউরোপের আধুনিকতার বোধের অনুরূপ না-ও হতে পারে। ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতার কারণে জাতীয় জীবনের নিজস্ব সাংস্কৃতিকতার মধ্যেও যে ভিন্ন এক নাগরিক মানসের জন্ম হতে পারে এবং সেই নাগরিক মানসও যে ভিন্নার্থে এক আধুনিকতারই উৎস, সে কথা আমরা ভুলে গেছি বলে জসীমউদ্দীনের আধুনিকতাকে আমরা মূল্য দিতে শিখিনি।
তিরিশি আধুনিকতা যে অনুকারী আধুনিকতা এবং এর মধ্যে যে আত্মদীনতা রয়েছে, জসীমউদ্দীনের আধুনিকতার বোধে তার জন্য বেদনা রয়েছে। তিনি স্বজাতির আত্মিক উত্থানকে গুরুত্ব দিতেন বলে অনুকারী আধুনিকতাকে অপছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গেও তিনি তাঁর এই মনোভাব প্রকাশে দ্বিধা করেননি। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন:
‘...আজকাল একদল অতি আধুনিক কবিদের উদয় হয়েছে। এরা বলে সেই মান্ধাতা আমলের চাঁদ জোছনা ও মৃগ নয়নের উপমা আর চলে না। নতুন করে উপমা অলংকার গড়ে নিতে হবে। গদ্যকে এরা কবিতার মতো করে সাজায়। তাতে মিল আর ছন্দের আরোপ বাহুল্যমাত্র। এলিয়ট আর এজরা পাউন্ডের মতো করে তারা লিখতে চায়। বলুন তো একজনের মতো করে লিখলে তা কবিতা হবে কেন?’
—রবীন্দ্রতীর্থে, ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়, কলকাতা, বলাকা-সংস্করণ, ২০০৭
আরেক জায়গায় জসীমউদ্দীন পরিষ্কার বলেছেন এই দৃষ্টিভঙ্গির সাহিত্যিকদের সম্পর্কে:

.
.

‘...আমাদের সাহিত্যের পিতা-পিতামহেরা এখন মরিয়া দুর্গন্ধ ছড়াইতেছেন, তাঁহাদের সাহিত্য হইতে আমাদের সাহিত্য হইবে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁহাদের ব্যবহৃত উপমা, অলংকার, প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করিয়া আমরা নতুন সাহিত্য গড়িব। এই নতুন সাহিত্য গড়িতে তাঁহারা ইউরোপ, আমেরিকার কবিদের মতাদর্শ এবং প্রকাশভঙ্গিমা অবলম্বন করিয়া একধরনের কবিতা রচনা করিতেছেন। ...প্রেম–ভালোবাসা, স্বদেশানুভূতি, সবকিছুর ওপরে তাঁহারা স্যাটায়ারের বাণ নিক্ষেপ করেন। তাঁহাদের কেহ কেহ বলেন, বর্তমানের সাহিত্য তৈরি হইবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের গ্রন্থশালায়, জনসাধারণের মধ্যে নয়।’
—যে দেশে মানুষ বড়, ঢাকা, ১৯৯৭ (প্রথম সংস্করণ: ১৯৬৮)
নিজের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ছিল এই রকম:
‘...দেশের অর্ধ শিক্ষিত আর শিক্ষিত সমাজ আমার পাঠক-পাঠিকা। তাহাদের কাছে আমি গ্রামবাসীদের সুখ-দুঃখ ও শোষণ-পীড়নের কাহিনি বলিয়া শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তাহাদের প্রতি সহানুভূতি জাগাইতে চেষ্টা করি। আর চাই, যারা দেশের এই অগণিত জনগণকে তাহাদের সহজ-সরল জীবনের সুযোগ লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্র্যের নির্বাসনে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষিত সমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে।’
—পূর্বোক্ত
জসীমউদ্দীনের রচনার এই উদ্ধৃতিটির মধ্যে আমরা তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিকতার একটু আভাস পাই। স্বসমাজের জাগরণচেতনার আভাসও তাঁর এই গদ্যভাষ্যে মূর্ত হয়েছে। তিনি গ্রামীণ কবিদের আঙ্গিক গ্রহণ করে নক্সীকাঁথার মাঠ (১৯২৯) কিংবা সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩) রচনা করেন। কেবল এই দুই কাহিনিগাথায়ই নয়, ছোট ছোট গীতিকবিতাগুলোতেও তিনি পুরোনো জীবনবোধের অনুকারী মাত্র থেকে যাননি। কিন্তু আমরা স্পষ্টই অনুভব করি যে এসব কবিতায় তিনি বিষয়বস্তু ও জীবনবোধে বিশ শতকের ভাবধারার অনুসারী। এই আঙ্গিক হতে পারে আমাদের নতুন আধুনিকতার মাধ্যম। আধুনিক কবিতায় যখন গীতিকা আঙ্গিকটি পরিত্যাজ্য তখন জসীমউদ্দীনের নক্সীকাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট—এই দুই কাব্য ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল আঙ্গিকের প্রাচীনত্ব নিয়ে নয়, নতুন জীবনবোধকে ধারণের সম্ভাবনা নিয়ে। তিনি গ্রাম্য গান সংগ্রহ করতে গিয়ে পরিশীলিত নাগরিক জীবনবোধ দিয়ে লক্ষ করেছেন যে গানের প্রথম কলিটি সুন্দর, কিন্তু পরবর্তী চরণগুলোতে জনগণের কুসংস্কারকেই রূপ দেওয়া হচ্ছে! তিনি তাই প্রথম পঙ্ক্তির সুন্দর কলিটিকে রেখে পরের চরণগুলোকে নতুন করে রচনা করে দিচ্ছেন। তাঁরও লক্ষ্য বাংলার নাগরিক মানসের কাছে পৌঁছে যাওয়া। এখানেই তাঁর আধুনিকতা ও তার স্বাতন্ত্র্য।
জসীমউদ্দীনের আধুনিকতার মর্মবাণী হচ্ছে বাংলাদেশের আত্মার মধ্য থেকে জেগে ওঠো। বিশ্বের দিকে তাকাও, কিন্তু তাকিয়ে আত্মবিস্মৃত হয়ো না, বরং বিশ্বকে গ্রহণ কর নিজের আত্মাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। তাই বলা যায়, জসীমউদ্দীন পাশ্চাত্য অনুকারী নগর গড়তে চাননি, চেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামের আত্মা থেকে ওঠা নতুন নগর। বিদেশে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন পাশ্চাত্য-অনুকারী আমাদের বিরাটগুলো প্রকৃতপক্ষে বিরাট নয়, অতিশয় ক্ষুদ্র। তাই আমাদের গ্রামীণ ক্ষুদ্রের যে বিরাটত্ব তাকেই অবলম্বন করতে হবে। আমাদের গ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্র্যের মধ্য থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে এর বিরাটত্বকে। এটাই তাঁর আধুনিকতার মর্মবস্তু। তাই জসীমউদ্দীনকে ‘পল্লিকবি’ বলা হলে তাঁর আধুনিকতার এই স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করা হয়। পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় তাঁর দূরদৃষ্টিকে। তাঁর আধুনিকতার অনুসারী কবিদের পেতে আমাদের একুশ শতক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কারণ, এই নবীন শতকের তরুণ কবিদের মধ্যেই হয়তো আমরা পাব আত্মবিশ্বাসী আধুনিক কবিসত্তাকে, যাঁরা নিজেদের বিকশিত করবেন, তাঁর দেখানো আধুনিকতার পথে।