জাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ: মায়েস্ত্রো হুমায়ূনের অন্য উন্মোচন

‘লীলাবতী’ উপন্যাসের উপসর্গপত্রে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন:
‘শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ
কবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাইনি।
আমি আপনার মতো একজন হতে চেয়েছি।
হায়, এত প্রতিভা আমাকে দেয়া হয়নি!’

হুমায়ূন আহমেদ কী হতে চেয়েছেন, আর কী হয়েছেন, তার সাক্ষ্য তাঁর সৃষ্টিকর্ম। তবে বিধি তাঁকে কিছু কম দেননি। বরং প্রয়াণের পর তাঁকে নিয়ে আরও নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে। এই বহুমাত্রিক স্রষ্টার নতুন এক পরিচয় উন্মোচিত হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত বই ‘জাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ’–এর মধ্য দিয়ে।

হুমায়ূনের জীবদ্দশায় তেমন আলোচিত না হওয়া—এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী জাদুশিল্পী এম এ জলিল। আলোচ্য বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন তথ্যবহুল, ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ, আলোকচিত্র ও ড্রয়িং সমন্বিত এক অদেখা জাদুকরকে।

‘জাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন হুমায়ূন অনুজ ও দেশের একমাত্র রম্য সাময়িকী ‘উন্মাদ’–এর সম্পাদক, লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব।

স্বীয় অগ্রজের কর্ম নিয়ে লেখা এ বইয়ের ভূমিকায় আহসান হাবীব লিখেছেন, ‘আমি বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য পেলাম।’ অদেখা ভুবনে হুমায়ূন আহমেদের চলে যাওয়ার প্রায় ৮ বছর পর প্রকাশিত এ বই সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আসলে হয়তো সময়ের অনেক পরে লিখলে পর্যবেক্ষণ আরও বেশি তীক্ষ্ণ হয়।’

জাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ
এম এ জলিল
প্রচ্ছদ: শিবেন চক্রবর্তী, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০২০, ১১৬ পৃষ্ঠা, দাম: ২৫০ টাকা।

লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব ১৯৭২ সালে, ‘নন্দিত নরকে’–এর মাধ্যেমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র তখন তিনি। বয়স মাত্র ২২ বছর। যদিও তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ছিল ‘শঙ্খনীল কারাগার’, যে বই প্রকাশ পায় পরে। এ তথ্য বহু চর্চিত। হুমায়ূন ভক্তদের অনেকেরই তা অজানা নয়। তবে ‘জাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ’ বইয়ে লেখক হাজির করেন এক অন্য সৃষ্টিমানকে। পাঠককে তিনি জানান, লেখনীতে জাদু ছড়ানোর আগে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একজন জাদুশিল্পী।

১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান টেলিভিশনে জাদু প্রদর্শন করেন। তাই তথ্য প্রমাণ করে, হুমায়ূন আহমেদ আগে ছিলেন জাদুশিল্পী, পরে হয়েছেন লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁর এ খ্যাতি। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘দুই বছর পর ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে বেরুলাম। বন্ধুমহলে আমি তখন ম্যাজিশিয়ান হুমায়ূন বলে পরিচিত।’

আমৃত্যু এ দেশের শীর্ষ জনপ্রিয় লেখক হয়ে থাকা এ মায়েস্ত্রো ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাদু সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিশিয়ানসের সম্মানিত সদস্য। মানুষকে মোহিত করার নেশা তিনি লালন করেছেন শৈশব থেকে। জাদুবিদ্যা নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করতেন। দেশ–বিদেশের যেখানেই গেছেন, সেখান থেকেই জাদুর সরঞ্জাম ও এ–বিষয়ক বই, ডিভিডি সংগ্রহ করেছেন। খ্যাতিমান জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের ভাষায়:
‘ক্লোজআপ ম্যাজিকে হুমায়ূন আহমেদের ছিল রাজার ভান্ডার।’

তীব্রভাবে নতুন কিছু শেখার একাগ্রতা তাঁকে জাদুশিল্পে মর্যাদায় আসীন করে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘জাদুর জন্য যে সাধনা করতে হয়, তার চাইতে অনেক কম সাধনাতেই ঈশ্বর ধরা দেন।’

হুমায়ূন আহমেদ।
ছবি: প্রথম আলো

ব্যর্থতা নামে কোনো শব্দ হুমায়ূনের জীবনে ছিল না। যেখানে হাত দিয়েছেন, তাতেই সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছেন। জাদুবিদ্যায় অনবদ্যতা তারই নজিরমাত্র।

‘জাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ’ বইয়ের লেখক এম এ জলিল ১৯৯০ সালে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হন। তখন তিনি প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন ও সন্তানদের নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। আমুদে স্বভাবের হুমায়ূন আহমেদ জাদুশিল্পীদের কদর করতেন। ফলে হুমায়ূন পরিবারের দরজার উন্মুক্ত হয়ে যায় এম এ জলিলের জন্য। জাদুবিদ্যা নিয়ে অবাধ চর্চা হতো দুজনের মধ্যে। বইয়ে সে অন্তরঙ্গতা ছবিসহ প্রকাশিত। এই বইয়ের সূত্রেই জানা যায়, হুমায়ূন–তনয়া শীলা আহমেদ ও বিপাশা পারিবারিক আসরে এম এ জলিলের সঙ্গে জাদু প্রদর্শনে সহকারীর ভূমিকায় থাকতেন।

বইটি ২২টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। ১১৬ পৃষ্ঠার এ বই ‘শুরুর কথা’ থেকে আরম্ভ করে ‘তথ্যসূত্র’ অধ্যায়ে শেষ। গোগ্রাসে তা পড়ে পাঠক বিস্ময়মানব হুমায়ূনকে চিনবেন নতুন করে।

অন্য এক হুমায়ূন আহমেদকে জানতে ‘জাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ’ বইটির পড়া যেতে পারে। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন হুমায়ূন আহমেদের বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজকে। হুমায়ূন আহমেদ যেমন মানুষের অন্তরে মুগ্ধতা তৈরিতে সক্ষম, তাঁর জাদুচর্চা নিয়ে লেখা বিরল বইয়ে লেখকও সে পথেই হেঁটেছেন। পুরো হুমায়ূন পরিবারের ওপর অপার শ্রদ্ধাবোধ এ বইয়ের আদ্যন্তজুড়ে।

‘জাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ’ বইটি নিজ গুণেই পাঠকপ্রিয় হবে, আশা করা যায়।