জীবন সম্পর্কে তলস্তয়ের সঙ্গে আলাপ

আজ কালজয়ী কথাসাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের জন্মদিন। ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর ‘রাশিয়ান বিয়ন্ড’ নামে একটি অর্ন্তজাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল তলস্তয়ের এই সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি কাল্পনিক হলেও উত্তরগুলো নেওয়া হয়েছে তলস্তয়েরই দিনপঞ্জি থেকে। আন্তরিক এই কথোপকথনে, তলস্তয়কে তাঁর অনুতাপ, তাঁর কাজ, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক এবং একজন মহান লেখককে বিষম নির্মম জগৎ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে দেখা যায়।

প্রশ্ন :

তলস্তয় সাহেব, এখন আপনার কেমন লাগছে?

উত্তর: আমি ইয়াসনায়া পলিয়ানাতে আছি। আমার স্বাস্থ্য ভালোর দিকে। অতিথিরা চলে গেছেন। এ জন্য আমি আনন্দিত।

প্রশ্ন :

আপনার কি প্রায়ই অতিথি থাকে? আইনজীবী ও দরিদ্র লোকেরা আপনার বাড়িতে অবশ্য নিয়মিত আসেন...

উত্তর: বহু আইনজীবী। বিধবা যারা তাদের জমি হারিয়েছে, ভিক্ষুকেরা, আরও অনেকে। আমার পক্ষে এটি যে কতটা কঠিন! কারণ এসব জাল। আমি তাদের কিছুই দিতে পারি না। তাদের আমি চিনি না। আর তারা সংখ্যায় অনেক। তাদের আর আমার মধ্যে একটি প্রাচীর আছে বলে মনে হয়। আমি বুঝতে পারি তারা—বেশির ভাগ লোকেরা আরকি—আমাকে ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করে না, তবে সেলিব্রিটি হিসেবে করে। তারা এমন একজন ব্যক্তির কাছে আসে, যিনি অর্থবহ ও সুস্পষ্ট চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে তাঁর খ্যাতি অর্জন করেছেন, তারা লোকটার কাছে আসে এবং একটি কথাও বলতে দেয় না তাঁকে। যখন তারা কথা বলে, বলতেই থাকে, হয় শুধু তাদের জানা বিষয়গুলো নিয়ে অথবা লোকটি অনেক আগেই যেগুলো হাস্যকর প্রমাণিত করেছেন তা নিয়ে...
আজ বিকেলেই ‘রাশিয়ান জনগণের ইউনিয়নের’ একজন মাতাল শ্রমিক আমার সঙ্গে ওকালতি করছিল ‘অর্থডক্স চার্চে’ ফেরার জন্য। সে সৎ চরিত্রের লোক, কিন্তু পুরোপুরি উন্মাদ। এরপর এক নারী বিশাল দুটি লেফাফা নিয়ে এসে দাবি করছিল যে আমি যেন ‘শাউট আউট ফ্রম হার হার্ট’ পাঠ করি। আত্মগর্ব, লেখকের উন্মাদনা ও লোভ। আমি হতাশ হয়েছিলাম আসলে। আমার শান্ত হওয়া উচিত ছিল।

‘রাত পোহানো এবং শতাব্দী শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকুন। যেন দুনিয়াতে আজই আপনার শেষ রাত এবং শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার সময় আপনার কাছে আছে এভাবে বাঁচুন। কারণ আপনি যা করছেন তা যেন অবিরামভাবে চালিয়ে যেতে পারেন।’

প্রশ্ন :

আপনার প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আপনার অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে লোকে আপনার প্রতি এতটা মনোনিবেশ করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আপনার বার্ধক্য সম্পর্কে কিছু বলবেন?

উত্তর: আপনি যখন বৃদ্ধ হন, আপনার সামর্থ্য, বাহ্যিক অনুভূতি যা আপনাকে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহায্য করে, তা ম্লান হয়ে আসে। এমনকি আপনার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্বাদও...পরিবর্তে নতুন অভ্যন্তরীণ অনুভূতি জন্ম নেয় আধ্যাত্মিক বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। আর এটি দশ গুণ বেশি প্রাপ্তি। আমি এখন এটির সম্মুখীন হচ্ছি। তাই আমি আনন্দিত, কৃতজ্ঞ ও সুখী।

প্রশ্ন :

আপনি একজন বিখ্যাত লেখক এবং ধনী বাড়িওয়ালা। আপনার জীবনে কোনো ঝুটঝামেলা আছে?

উত্তর: সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঝুটঝামেলার মধ্যে একটি হলো আমি বিলাসিতার মধ্যে বসবাস করি। সবাই আমার বিলাসিতার পেছনে ব্যয় করে, অনর্থক এটা–সেটা নিয়ে আসে এবং আমি ওগুলো ফিরিয়ে দিলে তারা কষ্ট পায়। প্রতিটি পক্ষের লোকই আমার কাছে অনুনয় করে, কিন্তু আমাকে তাদের প্রত্যাখান করতে হয়। এটি বাজে অনুভূতি প্রকাশ করে।

লিও তলস্তয়।
ছবি সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনার অন্যান্য অনুতাপগুলো কী?

উত্তর: ভাবছি কীভাবে আমি পাখি, পশু হত্যা করেছি, পাখিকে বর্শা বিদ্ধ করেছি, খরগোশকে ছুরি দিয়ে মেরেছি, কোনো দয়ামায়া দেখাইনি, আমি যা করেছি ভীতি ছাড়া এগুলোকে আমি কল্পনা করতে পারি না...

প্রশ্ন :

মনে হচ্ছে আপনার অপূর্ণতার অনুভূতি আপনাকে ছেড়ে যায়নি...

উত্তর: আমি ভীতিকর। চূড়ান্ত দুটি কারণে আমি ভীতিকর—একটি আত্মার মুক্তি ও অন্যটি তীব্র নারী আসক্তি। এটি একটি শোচনীয় লড়াই। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এর কারণগুলো আমি খুঁজছি: ধূমপান, পানাশক্তি, চিন্তাশক্তির অভাব হতে পারে। তবে এগুলো পিনাট। আর এর একটা কারণ হতে পারে একজন প্রিয় ও প্রেমময়ী স্ত্রীর অভাব।

প্রশ্ন :

বাহ্যিকভাবে আপনার পরিবারকে বেশ সুখী মনে হয়। তবে কি হতে পারে যে আপনার ও সোফিয়া অ্যান্ড্রিভনার মধ্যে সমস্যা হয়েছে?

উত্তর: তাঁর আর স্ত্রী হওয়ার আগ্রহ নেই। স্বামীর একজন অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে? অনেক দিন হয়েছে তিনি কোনো কাজে আমাকে সহায়তা করেন না, বরং বাধা দেন। আর আমাদের সন্তানদের মা হিসেবে? তিনি তা হতে চান না। কে তাদের (সন্তানদের) খাইয়ে দেয়? তিনি সেটাও করেন না। রাতের বন্ধু? এগুলো থেকে দূরে থাকতেও তাঁর জুড়ি নেই। আমার খুব খারাপ লাগে বাচ্চাদের জন্য। তাই আমি তাদের আরও বেশি ভালোবাসি এবং কষ্ট পাই ওদের জন্য।

স্ত্রী সোফিয়ার সঙ্গে তলস্তয়।
ছবি সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনি কি আপনার বাচ্চাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারছেন?

উত্তর: পরিবারে আমার পক্ষে এটি কঠিন। কঠিন, কারণ আমি সহানুভূতিশীল হতে পারি না। তাদের সব আনন্দ যেমন পরীক্ষা, সমাজে সাফল্য, সংগীত, গৃহসজ্জা, কেনাকাটা, এই সব কিছুই আমি তাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক মনে করি, এগুলো তাদের জন্য খারাপ। তবে আমি তাদের তা বলতে পারি না। আশা করি আমি নিশ্চয়ই পারব এবং করব, তবে আমার কথাগুলো কাউকে স্পর্শ করে না। মনে হয় যে আমি যা বলছি তারা তা বোঝে না। কিন্তু এগুলো বলার বদ অভ্যাস আমার আছে।

প্রশ্ন :

আপনার কাজ সম্পর্কে আপনার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি কী?

উত্তর: আমি নিশ্চয়ই সবাইকে বিরক্ত করে তুলেছি একই বিষয়ের ওপর নিঃশেষিত লেখাগুলো দিয়ে (অন্ততপক্ষে সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই এটা ভাবে)। এর চেয়ে চুপচাপ বেঁচে থাকা ভালো। আর শুধু তখনই লিখুন যদি লেখার তাড়না অসহনীয় হয়ে ওঠে। কেবল ফিকশন আমাকে প্রায়ই আকৃষ্ট করে। তবে সাফল্যের জন্য নয়, বিপুল পাঠকের কাছে আমার কী চাই, তা জানানোর জন্য। তবে আমার কাজকে চাপিয়ে দিয়ে নয় বরং প্রয়োজনের সময় এটি হাজির করতে পেরে...ঈশ্বর আমার সহায় হোন।

প্রশ্ন :

আপনার শেষ অভিব্যক্তি?

উত্তর: আমি বলতে ও ভাবতে ভয় পাচ্ছিলাম যে ১০০ জন লোকের মাঝে ৯৯ জনই উন্মাদ। তবে শুধু এ কারণে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেবল বলা ও ভাবা কাউকে সাহায্য করতে পারে না। লোকজন যদি উন্মাদ আচরণ করে (শহুরে জীবনযাপন, লালন–পালন, বিলাসিতা, আলস্যতা), তাহলে কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলবেই। তাদের দিকে অগ্রসর হোন, তাদের বিরক্ত করতে নয় বরং সাহায্য করতে, যদি সম্ভব হয়।

প্রশ্ন :

বর্তমানে আপনি ইয়াসনায়া পলিয়ানাতে রয়েছেন, তবে আপনি সাধারণত খামোভনিকিতে মস্কোর ম্যানরে শীতকাল উদ্‌যাপন করেন। সমসাময়িক মস্কো সম্পর্কে আপনি কী বলতে চান?

উত্তর: দুর্গন্ধ, পাথর, বিলাসিতা, দুর্দশা। কামনা-বাসনা। ভিলেনরা, যারা তাদের লোকদের অপহরণ করেছিল, তারা একত্র হয়েছিল, সৈন্য ও বিচারকদের ডেকেছিল তাদের বেলেল্লাপনা গোপন করার উদ্দেশ্যে, একত্রে তারা ভোজ উৎসবও করেছে। এই লোকদের আকাঙ্ক্ষা কাজে লাগিয়ে তারা লোকগুলোর মূল্যবোধের যে অপব্যবহার করেছে, তা ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এ ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষেরা বেশি ধূর্ত। নারীরা ঘরে আছেন আর পুরুষেরা বাথহাউসে মেঝে এবং নিজেদের শরীর ঘষে পরিষ্কার করছেন, কোচম্যান হিসেবে কাজ করছেন।

প্রশ্ন :

নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে এই মুহূর্তে আমাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?

উত্তর: রাত পোহানো এবং শতাব্দী শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত বেঁচে থাকুন। যেন দুনিয়াতে আজই আপনার শেষ রাত এবং শুধু গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার সময় আপনার কাছে আছে এভাবে বাঁচুন। কারণ আপনি যা করছেন তা যেন অবিরামভাবে চালিয়ে যেতে পারেন।

প্রশ্ন :

ঈশ্বর সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

উত্তর: যদিও এটি অদ্ভুত লাগতে পারে, তবু একমাত্র ভালোবাসাই ঈশ্বরকে জানতে সাহায্য করতে পারে। ভালোবাসা বা প্রেমই একমাত্র মাধ্যম, যা দিয়ে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায়।

প্রশ্ন :

তাহলে আপনি কী ভালোবাসেন?

উত্তর: প্রায়ই ভীতিগ্রস্ত হয়ে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, আমি কী ভালোবাসি? কিছুই না। ইতিবাচক অর্থেই কিছু না। এটি একটি দুঃখজনক ব্যাপার। সুখী জীবনের সম্ভাবনা এখানে নেই। এভাবেই মানবিক পৃথিবীর বাসিন্দা হওয়া সহজতর, তবে এ জন্য শারীরিক প্রয়োজনীয়তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লিও তলস্তয়ের ‘উত্তরগুলো’ তাঁর বিভিন্ন বছরের দিনপঞ্জি থেকে সংগৃহীত।
অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]