‘জীবনে যা কিছু করেছি, খ্যাতির জন্য করিনি, নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য করেছি’

মুর্তজা বশীর (১৭ আগস্ট ১৯৩২—১৫ আগস্ট ২০২০)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
মুর্তজা বশীরের চিত্রকর্ম

প্রশ্ন :

মোহাম্মদ আসাদ: সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারে আপনার জন্ম। সেখান থেকে পড়লেন আর্ট কলেজে। এরপর আকৃষ্ট হলেন পাশ্চাত্য জীবনধারায়। পরে অবশ্য সরেও এলেন ওই মোহ থেকে। নিজের জীবনের এই বৈচিত্র্য ও বোঝাপড়া সম্পর্কে বলুন।

মুর্তজা বশীর: ছোটবেলা থেকেই মনেপ্রাণে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও জীবনযাপন, মন-মানসিকতা নিয়েই আমি আচ্ছন্ন ছিলাম। আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে পাস করার পর একদিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বারে আড্ডা দিয়ে রাত দুইটার সময় বাড়িতে ফিরলাম। বাড়িতে আসার পর বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এত রাতে বাড়ি ফিরলে কেন?’ আমি বললাম, আই অ্যাম গ্রোন আপ। আমার বয়স তখন ২২ বছর। আমাদের মুসলিম পরিবারে ‘আমি গ্রোন আপ’—এটা কিন্তু বিদ্রোহের মতো ছিল। বিশেষত, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মুখের ওপর এই কথা বলা তো বিদ্রোহই। তবে বাবা যেহেতু প্যারিসে ছিলেন, তিনি বুঝতেন। ফলে আর কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। তখন আমার জীবনযাপন, চলাফেরা যদি কেউ স্টাডি করত, আমি যে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির, এটা বোঝা কষ্টকরই ছিল। হ্যাঁ, পরবর্তীকালে আমি বিয়ে করেছি, আমার সন্তান হয়েছে। তবে আমার পরিবারে নিয়ম ছিল অনেকটা পাশ্চাত্যের মতো।

কিন্তু আমার চিন্তার বদল ঘটল আশির দশকে। ১৯৮০ কি ’৮১ সালে বাংলাদেশ সরকার ও শিল্পকলা একাডেমি দ্বিতীয় ফোকোকা এশিয়ান আর্ট ভিয়েনালে প্রবন্ধ পড়ার জন্য আমাকে জাপানে পাঠাল। সেখানে ২৪-২৫ বছর একটা মেয়েকে আমার গাইড হিসেবে দিয়েছিল জাপানি কর্তৃপক্ষ। তো পরিচয়ের প্রথমে আমি ওই মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু সে হ্যান্ডশেক করল না, মাথা নিচু করে অভিবাদন জানাল। তখন আমার মনে হলো, আমার গায়ে কে যেন চাবুক মারছে। আধুনিক মেয়ে, পাশ্চাত্যধর্মী বেশভূষা, মিনি স্কার্ট পরা। তবে তার যে সংস্কৃতি, সেটা সে ধরে রেখেছে। ছেলেবেলায় গল্প পড়েছিলাম, একটা কাক ময়ূর হতে চেয়েছিল। ময়ূরের পালক নিজের গায়ে লাগিয়েছিল। তারপর ময়ূর তাকে গ্রহণ করেনি, কাকও না। নিজেকে আমার ময়ূরপুচ্ছধারী সেই কাকের মতো মনে হলো।

আমার মনে হলো, আমি কে? কোত্থেতে এসেছি, আমার পরিচয় কী? এটা জানার জন্য ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। দেখলাম, বাংলাদেশ একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, এই উপমহাদেশেরই একটা অঙ্গ। নিজেকে জানার জন্য এ সময় আমি ছবি আঁকা বন্ধ করে দিলাম। ছয় বছর আমি ছবি আঁকিনি। সে সময় উপমহাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পড়া শুরু করলাম। শুধু তা-ই নয়, এখানে যেসব ধর্ম আছে, সেগুলো সম্পর্কেও জানতে শুরু করলাম, শুধু নিজেকে খোঁজার জন্য।

প্রশ্ন :

আসাদ: উপমহাদেশের শিল্পকলা নিয়ে পড়েননি?

বশীর: হ্যাঁ, তখন আমার জানতে ইচ্ছা হলো, আমাদের শিল্পকলা কী? পাল যুগের শিল্পকলা কী? পাল যুগের শিল্পকলা বাংলার মাটিতে হলেও পরবর্তীকালে পালরা কিন্তু বিহার-ওডিশার দিকে চলে যায়। পাল যুগের শিল্পকলা দেখার জন্য আমি ১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ফেলোশিপ নিলাম। ‘হেরিটেজ আর্ট অব বেঙ্গল’-এর ওপর কাজ করতে তিন মাসের জন্য বিলেতে গেলাম। ওখানে পাল যুগের চিত্রকলা দেখলাম। সেই সঙ্গে কালীঘাটের চিত্রগুলোও দেখলাম। ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার আমাকে ফেলোশিপ দিল ‘হেরিটেজ অব বেঙ্গল’ দেখার জন্য। আসলে পাল যুগ তো এখানে নেই, বিশেষ করে কালীঘাটের আর্ট, আর্লি এইটিন-নাইনটিন সেঞ্চুরির উড ব্লক আছে। তো, ভারতে গিয়ে কাঠের যে ব্লক আছে, ওগুলো দেখলাম। পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলো জেলার গ্রাম এবং গ্রামের মন্দিরগুলো দেখলাম। এভাবে মাঠপর্যায়ে ঘুরে গ্রামের মন্দিরগুলো আমি পর্যবেক্ষণ করেছি।

প্রশ্ন :

আসাদ: টেরাকোটা দেখে কী পেলেন?

বশীর: টেরাকোটাগুলো অনেকটা কালীঘাটের কম্পোজিশনে করা। যেহেতু একই সময়ে করা, তাই আমার মনে হয়েছে, এগুলো পাল যুগের চিত্রকলা, অনেকটা অজন্তারই ছোট ভার্সন।

প্রশ্ন :

আসাদ: আপনার সংগ্রহে যে টেরাকোটা আছে, সেগুলো কোথাকার?

বশীর: কোথাকার তা বলতে পারব না। লোকের কাছ থেকে কিনেছি। আমার কাছে এগুলো খুব ইউনিক মনে হয়েছে। কারণ, ফিগারের ড্রয়িংগুলো সাধারণত আমি যেসব টেরাকোটা দেখেছি, তার মতো নয়, একটু অন্য রকম। টেরাকোটা সবই ধর্মীয়। কিছু আছে সমসাময়িক জীবন—পালকি চড়ে যাচ্ছে, বাইজি নাচছে, শিকার করছে—এমন খণ্ডচিত্র।

প্রশ্ন :

আসাদ: আপনার এই টেরাকোটা গবেষণা, এটি নিয়ে কোনো প্রকাশনা কি হয়েছে?

বশীর: টেরাকোটার ছবি দিয়ে আমার একটা বই বের করার কথা ছিল। এইচএসবিসি ব্যাংক অর্থায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি আর আগাইনি। তোমাকে আমি একটা কথা বলি, আমি জীবনে যা কিছু করেছি, খ্যাতির জন্য করিনি, নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য করেছি। মন্দিরের টেরাকোটা, পাল যুগের চিত্রকলা বা কালীঘাট—এগুলো আমি দেখেছি নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য। বিশেষত টেরাকোটা দেখার জন্য আমাকে গ্রামে ধানখেতের আইলের ওপর দিয়ে, কখনোবা হাঁটুপানি ভেঙে যেতে হয়েছে। সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমি বুঝতে চেয়েছি, হোয়াট ইজ বেঙ্গল আর্ট? আসলে বেঙ্গল আর্ট নিয়ে কাজটা করেছি নিজের জন্য।

প্রশ্ন :

আসাদ: টেরাকোটা নিয়ে গবেষণা আপনার ক্যানভাসে কি কোনো প্রভাব ফেলেছিল?

বশীর: পাল যুগের চিত্রকলা, কালীঘাটের চিত্রকলা, উড ব্লক, টেরাকোটা—এগুলো হচ্ছে বাংলার আর্ট। এগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি সেই শিক্ষা আমার ফিগারেটিভ কাজে অ্যাপ্লাই করেছি। এ জীবনে বারবার নিজেকে আমার মনে হয়েছে, আমি একজন তৃষ্ণার্ত মানুষ। পিপাসায় একেবারে কাতর। আমি মাটি খুঁড়েছি পানির জন্য। আমি পানির শব্দ শুনেছি। কিন্তু পানি দেখিনি। এটাই তো আনন্দ।

প্রশ্ন :

আসাদ: ছবি আঁকা নিয়ে কী ভাবছেন?

বশীর: ২০১৩ সালে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ছবি আঁকা নিয়ে নানা পরিকল্পনা করলেও শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে কিছুদিন আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিল। ২০১৭ সালে সে চলেই গেল। আসলে আমি কখনোই ধারাবাহিকভাবে ছবি আঁকিনি। ভেবেচিন্তে তৈরি হয়েছি। তারপর ছবি আঁকা শুরু করেছি। একটা সিরিজ আঁকার পর আবার গ্যাপ দিয়েছি।

এখন ছবি আঁকছি না। কিন্তু মাথায় ঠিকই ছবি আঁকা নিয়ে কাজ করছি। চিন্তা করেছি, বিয়ের পর থেকে আমার স্ত্রী থাকা অবস্থায় যে সিরিজ কাজগুলো করেছি, সেগুলো আবার নতুন করে এঁকে একটা প্রদর্শনী করব। সে জন্য তৈরিও হয়েছিলাম। শিল্পীজীবনের প্রথম দিকে জ্যামিতিক ফর্মের কিছু কাজ করেছিলাম কাগজের ওপর প্যাস্টেলে। এর মধ্যে ও রকম আরও কয়েকটি আঁকলাম। সেগুলো তো বিক্রি হয়ে গেল।

প্রশ্ন :

আসাদ: সারা জীবন তেলরঙে কাজ করেছেন আপনি, এখন প্যাস্টেল ধরলেন কেন?

বশীর: তেলরং বা অয়েল কালারের কেমিক্যাল ইফেক্টে আমার ক্ষতি হতে পারে। চিকিৎসক নিষেধ করেছে। এখন আমাকে সব সময় অক্সিজেন নিয়ে থাকতে হয়। তাই প্যাস্টেল দিয়ে করেছি।

প্রশ্ন :

আসাদ: কী নিয়ে ভাবছেন এখন?

বশীর: আমি কালিমা তাইয়েবা নিয়ে পেইন্টিং করেছি। সেটা সুলতানি আমলের মুদ্রার হরফগুলোর আদলে করেছি। এবার আল্লাহর মহত্ত্ব নিয়ে পেইন্টিং করব। কোরআন শরিফে আল্লাহকে নিয়ে যে বর্ণনাগুলো আছে, সেটা ধরে। আমি কোরআন শরিফের কয়েক পারা পড়ে নোট নিয়েছি। ৩০ পারা পড়ার পর কাজে হাত দেব। চিন্তা করেছি, এবারের হরফগুলো হবে বাংলার শিলালিপির আদলে, ওপরে-নিচে লম্বা লম্বা হরফে। আমেরিকা থেকে মাস্ক আনিয়েছি। সেটা পরে অয়েলে কাজ করব।

তারপর ইচ্ছা আছে বাসে বছরের পর বছর রং লাগানোর পর যে রং ধারণ করে, সেটা নিয়ে কাজ করার। নানা জায়গা থেকে সেটার অনেক ছবি সংগ্রহ করেছি। এই কাজও দ্রুতই করব।