জীবনের যুদ্ধ, নাকি যুদ্ধই জীবন?

রাজধানীর কদমতলী এলাকার অলিগলি ঘুরে চা-বিস্কুট বিক্রি করেন রিয়া। দেড় বছরের শিশুসন্তানকে নিয়েই তাঁর সংসার। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই প্রতিদিন চলে রিয়ার জীবনযুদ্ধছবি: হাসান রাজা

পিঠে সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক মা। সন্তান ঘুমে। আর তার ঘুম নিশ্চিন্ত করতে মা বিক্রি করছেন চা-বিস্কুট। ঘুরে ঘুরে সেই কাজেরই ফাঁকে দাঁড়ানোর এক চিলতে সুযোগ মিলেছিল। মায়ের চোখে কি শ্রান্তি ছিল? নাকি ছবিটির ক্যাপশনের মতো জীবনের যুদ্ধে লড়তে লড়তে এক টুকরো অবসর? সেখানে ক্লান্তিকে আর পাত্তা দেওয়ার সুযোগ বেশি থাকে না হয়তো।

আচ্ছা, যুদ্ধ কি জীবনের একটা অংশ? নাকি বড় যুদ্ধের ছোট্ট অংশ হলো জীবন?

অনেকেই বলবেন, যুদ্ধের চেয়ে জীবন অনেক বড়। মোটিভেশনাল স্পিকাররা নিশ্চয়ই এক লহমায় উড়িয়ে দেবেন জীবনকে যুদ্ধের ক্ষুদ্রাংশ ভাবার চিন্তা। বলবেন, সংগ্রাম করতে করতে একদিন প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। জানো না, অমুক বিখ্যাত ব্যক্তি কত কষ্ট করেছিলেন? সেই কষ্ট থেকেই তিলে তিলে তিনি বড় হয়েছেন। বিশাল বড়। তাতেও উদ্বুদ্ধ করা না গেলে টেনে আনবেন নিজেকেই। কবে বা কত দূর রাস্তা পদব্রজে যেতে হয়েছিল রিকশার অভাবে, সেসব বলা হবে মহাসমারোহে। ওসব কিছুটা লাগেও। এতটুকু ব্র্যান্ডিং না হলে আর ফেসবুক লাইভে এসে সময় নষ্ট করার মানে কী, বলুন? খরচও তো আছে।

এসব বাক্য আমাদের মনের আশার সমুদ্রে জোয়ার তোলে অবশ্য। তাতে অন্তর্জালের দুনিয়ায় লাইক-কমেন্টের ফেনা ওঠে। সেই ফেনার বুদ্‌বুদে অনেকের স্বপ্নের ঘুড়ি আকাশে ওড়ে। হয়তো কোনো এক পরীক্ষাধীন জীবনসংগ্রামী মনে মনে সংকল্প নেয়, একদিন আমার গল্পও এভাবে জাকারবার্গের দুনিয়ায় হুলুস্থুল ফেলে দেবে! কিন্তু ফেলে কি? নাকি স্বপ্নের সেই ঘুড়ি শুধু ভোকাট্টা হয়ে যায়?

সংবাদপত্র মারফত জানা গেছে, ছবির মায়ের নাম হলো রিয়া। তাঁর মাস্কঢাকা মুখের অভিব্যক্তি পড়া যায় না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বদলে হাঁটু ভেঙে তাঁর একটু নুয়ে থাকা বরং জানান দেয়, যুদ্ধই তাঁর জীবনের প্রতিশব্দ। অভিধানের মতো এক শব্দের একাধিক অর্থ সেখানে মেলে না। বিশেষ্য, বিশেষণ ভেদাভেদ নেই তাতে। যুদ্ধ চালাতে চালাতেই তাঁকে পেতে হয় জীবনের স্পর্শ।

দেড় বছরের শিশুটি কিন্তু ঘুমোচ্ছিল বেশ। মা তো আছেন সঙ্গে, তাই হয়তো উৎকণ্ঠাহীন। কিন্তু পিঠে বাঁধা সন্তানের ঘুমমগ্ন সেই শান্ত মুখশ্রী কি রিয়া দেখতে পাচ্ছিলেন? ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখাটা একটু কঠিন। আলোকচিত্রী হাসান রাজার ক্যামেরার লেন্স অবশ্য খুঁজে নিয়েছে ঠিকই। সন্তানের চিন্তাহীন নিদ্রিত মুখ এ ছবির সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক মুহূর্ত। রিয়ার যুদ্ধের ফাঁকে এভাবেই হয়তো জীবন নিরুপদ্রব রূপে দেখা দেয়।

রিয়ার বৃত্তান্ত জানার চেষ্টা চালানো যেত। তাঁকে খুঁজে বের করে অন্তর্জালে লাইভ করা যেত, ইউটিউবে হতো ভিডিও আপলোড, চ্যানেলের ভিউ আকাশে মুখ তুলে ভেংচি কাটতে পারত। তবে ব্যস্ত রাজধানীর অলিগলিতে জীবিকার খোঁজে হনহন পায়ে হেঁটে চলা এই মায়ের সঙ্গে কথা বলার সাহস কি আদৌ মিলত? জীবনকে যদি যুদ্ধের অংশ মনে করি, তবে উত্তর হতো, ‘না’। দুই হাতে চায়ের ফ্লাস্ক ও বিস্কুটের ঠোঙা, আর কাঁধে সন্তান নিয়ে রিয়া অনেক বড় যোদ্ধা। তাঁর বীরত্বের ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আমাদের মতো শৌখিনেরা সেখানে পাইক-পেয়াদা মাত্র।

দেড় বছরের শিশুটি কিন্তু ঘুমোচ্ছিল বেশ। মা তো আছেন সঙ্গে, তাই হয়তো উৎকণ্ঠাহীন। কিন্তু পিঠে বাঁধা সন্তানের ঘুমমগ্ন সেই শান্ত মুখশ্রী কি রিয়া দেখতে পাচ্ছিলেন? ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখাটা একটু কঠিন। আলোকচিত্রী হাসান রাজার ক্যামেরার লেন্স অবশ্য খুঁজে নিয়েছে ঠিকই। সন্তানের চিন্তাহীন নিদ্রিত মুখ এ ছবির সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক মুহূর্ত। রিয়ার যুদ্ধের ফাঁকে এভাবেই হয়তো জীবন নিরুপদ্রব রূপে দেখা দেয়। রিয়ার বৃত্তান্ত জানার চেষ্টা চালানো যেত। তাঁকে খুঁজে বের করে অন্তর্জালে লাইভ করা যেত, ইউটিউবে হতো ভিডিও আপলোড, চ্যানেলের ভিউ আকাশে মুখ তুলে ভেংচি কাটতে পারত। তবে ব্যস্ত রাজধানীর অলিগলিতে জীবিকার খোঁজে হনহন পায়ে হেঁটে চলা এই মায়ের সঙ্গে কথা বলার সাহস কি আদৌ মিলত?

এমন আমজনতার যুদ্ধ খুব একটা চাউর হয় না কখনো। যুদ্ধে জয়ী পক্ষের ওজনদার সদস্য হতে না পারলে কে আর পাত্তা দেয় বলুন? মানুষ চায় আশার বেলুনে আকাশে উড়তে। দিন শেষে তাই ‘শ্রেণিবিভাজন’ এক অসামান্য হন্তারক রূপে আবির্ভূত হয়। যুদ্ধে জয়ী হয়ে পুঁজি ও শ্রেণির বিচারে উত্তরণ ঘটলেই তা হয় সফলতা। এর ব্যতিক্রম চলে যায় বাতিলের খাতায়। লালরঙা হালখাতার মতো তা বাঁধানো থাকে না। জাঁকজমকহীন সেই খাতায় নাম তোলা মানুষের কাছে যুদ্ধই জীবন। সংগ্রাম থেকে তাঁদের মুক্তি মেলে না কখনো। আর তাঁদেরই বিন্দু বিন্দু সংগ্রাম দিয়ে ঝান্ডা বানিয়ে আমরা কতিপয় কোমলম্পর্শী জীবনমুখী লোক বিজ্ঞের মতো বলে উঠি, ‘জীবন স্রেফ যুদ্ধ নয়, একে উপভোগ করতেও শিখতে হয়!’
জীবন উপভোগের এ মন্ত্র জিডিপির ঊর্ধ্বগতির এ দেশে শ্রেণি-বিত্তনির্বিশেষে কার্যকর করা যায় না? তবেই হয়তো স্বস্তিতে নিজ সন্তানের ঘুমমাখা চেহারা দেখার সুযোগ আসবে রিয়ার জীবনে। আর ঘাড় ঘুরিয়ে কষ্ট করতে হবে না। অবিরত যোদ্ধাদের যুদ্ধরূপ জীবনে এতটুকুই–বা কম কিসে!

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]