তাঁর মৃত্যুর পরে
১২ আগস্ট ছিল হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুদিন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর মেয়ে মৌলি আজাদ

আমার আব্বা হুমায়ুন আজাদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আজ ১০ বছর হলো। তিনি বেঁচে থাকতে যখন তাঁর এ রকম অনুপস্থিতির কথা ভাবতাম, তখন তা চিন্তা করলেই আমার সারা শরীর ভয়ে কাঁপত। সে সময় যাদের বাবা নেই, তাদের যে রকম নিদারুণ অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে দেখতাম, তা দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। কিন্তু আজ যখন তা আমার জীবনে চরমভাবে বাস্তব, তখন দেখলাম, তা কতই-না সহজভাবে মেনে নিয়ে দিব্যি খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি আর অফিস করছি। এ রকমভাবেই কি জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে শুধু নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের নানা অভিনয় করে বেঁচে থাকতে হয়?
মৃত্যুর সঙ্গে যেহেতু জন্মও জড়িত, সেহেতু বেঁচে থাকলে এ বছর বাবা তাঁর ৬৭তম জন্মবার্ষিকী পালন করতেন। আড়ম্বরপূর্ণ জন্মদিন তাঁর অপছন্দ ছিল। জন্মদিন ব্যাপারটি হয়তো জীবিত বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছে সুখকর, কিন্তু যাঁকে ঘিরে এই দিন, তিনি যদি শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকেন, তবে হারানো মানুষটির পরিবারের কাছে তা কখনোই আনন্দের ব্যাপার হতে পারে না। তাই তাঁর মুত্যুর পর আব্বার যে কয়টি জন্মদিন গেছে, পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা কোনো আয়োজন করিনি। তাঁর কথা মনে এলেই আমার চোখের সামনে প্রথমেই হালকা-পাতলা মাথাভর্তি কাঁচা-পাকা ঢেউখেলানো চুলের একজন মানুষের ছবি ভেসে আসে। সব সময় জিনস, টি-শার্ট পরতেন আর বাঁ হাতে হাতঘড়ি, চোখে চশমা। শীতকালে পুলওভার পরতেন আর বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি। আমি কখনো তাঁকে স্যুট-টাই পরতে দেখিনি।
সারা জীবন তিনি যেমন সোজা কথার মানুষ ছিলেন, তেমনি সব সময় হাঁটতেন সোজা হয়ে। তাঁর হাঁটার ভঙ্গিমা দেখে মনে হতো যেন সুবিধাবাদী এ সমাজে তিনি এক ‘হিমালয়’। তাঁর মধ্যে তোষামোদি বিষয়টি কখনো দেখিনি। সব সময় সবার মুখের ওপর সত্যি কথাটা ঠাস ঠাস করে বলতেন আর আমি ভাবতাম, কীভাবে তিনি এত সাহস পান? পরে অবশ্য এর উত্তর খুঁজে পেয়েছি। কারণ, তাঁর কারও কাছে কোনো কিছুর চাওয়া ছিল না। পেশাগত ও সাহিত্যজীবনে যা কিছু অর্জন করেছেন, এর সবটাই ছিল তাঁর নিজের কষ্টে গড়া। আর এ জন্য তিনি পাহাড়সম প্রতিকূলতা বা সমালোচনা ডিঙিয়ে পথ হেঁটেছেন। জাতীয় কবিতা উৎসব থেকে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বেরিয়ে আসা, তাঁর প্রবচনগুচ্ছ নিয়ে বিতর্ক, নারী বইটি নিষিদ্ধ করাসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় তাঁকে আমি ক্রোধান্বিত দেখতাম, কিন্তু ভেঙে পড়তে দেখিনি। নিজ বিশ্বাসে, নিজস্ব যুক্তিতে অটল থেকে তিনি তাঁর জীবনের সব জঞ্জাল সরিয়েছেন। ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্মসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি এত বেশি পড়াশোনা করতেন বলে তাঁকে পর্যুদস্ত করতে আসা লোকদের কী নিদারুণভাবে কথার মারপ্যাঁচে ছত্রভঙ্গ হতে হতো, তা দেখে হাসতাম আমি। নিজের পড়ার ঘরে বসে যেমনি পড়তেন-লিখতেন, সেই সঙ্গে চলত সিগারেট আর চা খাওয়া। কিছুক্ষণ পরপর আমায় বলতেন, ‘মৌলি, এক কাপ চা বানা তো।’ বেশ কয়েকবার চা বানানোর পর বিরক্তি প্রকাশ করতাম আমি, তখন তিনি নিজের চা নিজেই বানিয়ে নিতেন।
তাঁকে বলা হয়, তিনি ‘প্রথাবিরোধী’। অবশ্য ব্যক্তিগত জীবনে তিনি স্ত্রী ও আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। আমাদের তিন ভাইবোনের যেকোনো ভালো ফলে তিনি দুহাত ভর্তি করে আমাদের প্রিয় খাবারগুলো নিয়ে বাসায় ফিরতেন। ভালো ফলের জন্য যেমন তাঁর কাছ থেকে পুরস্কৃত হতাম, তেমনি খারাপ ফলের জন্যও খেতাম ভয়াবহ বকুনি। বিকেলবেলায় হয়তো আমি একটু আরাম করছি, এমন সময় আব্বা গম্ভীর গলায় ডাক দিতেন এই বলে, ‘মৌলি, ইংরেজি গ্রামার বইটা নিয়ে আয় তো।’ শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের এক স্রোত নেমে যেত যেন সে মুহূর্তেই।
আমি এলএলবি (অনার্স) পাস করার পর ঠিক করলাম আইনজীবী সনদ পাওয়ার জন্য পরীক্ষা দেব। আর এ জন্য দরকার ছিল হাইকোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবীর কাছে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার। তখন সবার কাছে শুনতাম, ভালো সিনিয়র আইনজীবী পাওয়া নাকি ভীষণ ঝামেলার। বিষয়টি আব্বাকে বলেছিলাম। আব্বা বললেন, ‘ঠিক আছে, কাল তোকে কোর্টে নিয়ে যাব, দেখি কী করা যায়।’ আব্বার সঙ্গে হাইকোর্টে গেলাম। আইনজীবীরা আব্বাকে ঘিরে ধরে বললেন, ‘স্যার, আপনি এখানে কী করছেন?’ আব্বা আমার শিক্ষানবিশ হওয়ার ব্যাপারটি বললেন। সবার মুখে ছিল একটাই কথা, ‘স্যার, আপনার মেয়ের জন্য আপনি সিনিয়র আইনজীবী খুঁজছেন? আপনি শুধু কোন সিনিয়র আইনজীবীর অধীনে আপনার মেয়েকে শিক্ষানবিশ করাতে চান, তা বলুন?’ আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেদিনই হয়ে গেলাম এক স্বনামধন্য আইনজীবীর শিক্ষানবিশ। বুঝলাম, এত সহজে আইনজীবী স্যারকে পেলাম আমার বিখ্যাত আব্বার জন্যই।
আব্বার সামাজিকতাবোধ ছিল খুবই কম। তবুও মাঝেমধ্যে আমাদের চাপে পড়ে বিশেষ বিশেষ কিছু বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতেন এবং সময় মেইনটেইন করতেন। দেখা যেত, তিনিসহ আমরা সবাই সবার আগে বিয়েবাড়িতে উপস্থিত। অন্যরা কেউ নেই। তিনি সব বিয়েতে তাঁর লেখা বই অটোগ্রাফসহ উপহার দিতেন। এ জন্য আমি বিরক্ত হতাম। আমি তখন বুঝতে পারিনি, যেকোনো দামি উপহারের চেয়ে তাঁর লেখা বইয়ের মূল্য অনেক বেশি। এই তো সেদিন তাঁর এক ছাত্রীর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, তাঁর বিয়েতে উপহার পাওয়া আব্বার নারী বইটি তিনি বুকসেলফ থেকে প্রায়ই বের করে পড়েন, আব্বার দেওয়া অটোগ্রাফের ওপর হাত বোলান এবং একসময় আজাদ স্যারের কথা মনে করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন।
পুরোনো ধ্যানধারণা, অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার মানুষদের সঙ্গ ভীষণ রকমের অপছন্দ ছিল তাঁর। তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের সবার আলোচনার সময় ও স্থান ছিল রাতের খাবার সময় ও খাবার টেবিল। বেশির ভাগ সময়ই আমাদের তিন ভাইবোনের পড়ালেখার বিষয়টি সেখানে উত্থাপিত হতো। তিনি আমাদের ভালোভাবে পড়াশোনা করার ওপর বিশেষ জোর দিতেন এই বলে যে, বই ছাড়া আর কোনো অর্থ-সম্পদ তিনি রেখে যেতে পারবেন না, সুতরাং তোমরা পড়ো। তাঁর লেখালেখির বিষয়টি উঠলে প্রায়ই বলতেন, ‘যদি ১০০ বছর সুস্থভাবে বাঁচি, তবে শুধু লিখব আর লিখব।’ বাংলা একাডেমির বইমেলা ছিল আব্বার অতি প্রিয় জায়গা। মনে পড়ে, একুশের প্রথম প্রহরে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি চাচার সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। বাসায় ফিরতেন ভোরে। অনেক একুশে ফেব্রুয়ারি গেছে, তিনি ভোরবেলা বাসায় ফিরবেন বলে দরজা খোলার জন্য বিরক্তি নিয়ে সকালে জেগে উঠতাম আমি। হায়! আজ আর বিরক্ত করার সেই মানুষটি নেই।
জঙ্গিবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ছিল তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন। দেশের যেকোনো বিপর্যয়ে তাঁর মুখটা আমি কালো দেখতাম। সমাজের পরিবর্তনের আশায় দাঁতভাঙা লেখা লিখে নিজের জীবনটাও দিয়ে গেছেন। আজও যখন সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়ে দেশ, মনে হয়, এ সময় তাঁর বড্ড বেশি প্রয়োজন ছিল।
জানি, আব্বার সঙ্গে কখনো আমার আর দেখা হবে না, শত ইচ্ছা থাকলেও কোনো দিন আর তাঁকে দেখতে পাব না আমরা। উচ্চ স্বরে বললেও আমার কথা শুনতে পাবেন না তিনি। তবু তাঁকে জানাতে ইচ্ছা করে, আমাদের নিরাপদে থাকার জন্যই তো তুমি জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছিলে, তাই না? সেই আমরা ভালোই আছি। তোমার হত্যা মামলার বিচার ১০ বছর ধরে কেবলই চলছে। জানি না কবে এ বিচার শেষ হবে? তবে আশা হারাইনি আমরা। হয়তো কোনো এক রোদজ্বলা সকালে তোমার আততায়ীদের শেষবিচার হবে। আমরা সাধারণ মানুষ সেই বিচার দেখে উল্লসিত হয়ে তোমার উদ্দেশে বলব, তোমার খুনিদের বিচার হয়েছে। তুমি কি এ কথা শুনে ওপারে শান্তি পাচ্ছ? তখন ওপার থেকে তুমি হাসবে কি, আব্বা? তুমি তো জানতেই এ নর্দমার কীটগুলো বেঁচে থাকলেই কী আর না থাকলেই কী?
যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।