তারেক-মিশুক: সাথে আছ সব সময়

>
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর; চলচ্চিত্রই ছিল তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। ছবি: সংগৃহীত
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর; চলচ্চিত্রই ছিল তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের নতুন ধারার সিনেমায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের অবদান গভীর। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তাঁরা। ওই দিন তাঁদের সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদও। সেই ভয়াল দুর্ঘটনার পর তারেক ও মিশুককে নিয়ে এই প্রথম লিখলেন তিনি

তারেক আর মিশুকের কথা মনে পড়ে। মনের চোখে দুজনের ছবি ভেসে ওঠে। দেখতে পাই, তারা ক্যামেরা মনিটরের সামনে ঝুঁকে দিনের ফুটেজ যাচাই করছে; অথবা উঁচু ক্রেনে বসে পরবর্তী শট নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানসপটে ফুটে ওঠা ছবিগুলো যেন আমাকে বলতে থাকে, অবিনশ্বর জগতের কোনো এক স্বর্গীয় শুটিং স্পটে তারা সৃষ্টিশীল চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।

সিনেমার প্রতি অবিমিশ্র প্রেম তাদের কাজের মধ্যে অতি আনন্দে ডুবিয়ে রাখত। সৃষ্টিশীল কাজ ছাড়া অহেতুক একটি মুহূর্তও তারা উপভোগ করছে—এমন কথা আমি ভাবনায় আনতে পারি না। কাজের প্রতি এই দুর্মর আসক্তিই একজন আরেকজনকে কাছে টেনে এনেছিল। তাদের নতুনকে জানার দুর্নিবার কৌতূহল আর সৃষ্টিশীল কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আকাঙ্ক্ষাকে কোনো সংকীর্ণ ‘অ্যাজেন্ডা’ বা আত্মরতি নস্যাৎ করতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তারা একজন আরেকজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ তখন মাত্র জন্ম নিয়েছে। সেখানে ওরা দুজন আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্র মূল্যায়ন কোর্সে ভর্তি হয়েছিল। ওদের দুজনের কাছেই কবির ভাই ছিলেন হিমাদ্রিশিখরতুল্য মানুষ। যখন কোনো ছবির ভাষা পরিষ্কার হতো না, তখন কবির ভাই বলতেন, ‘তোমরা নিজেরাই তোমাদের নিজস্ব ভাষা তৈরি করো।’ তারেক আর মিশুক তাঁর সেই কথা অনুসরণ করেছিল। টাকাপয়সা নেই; চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়ে বিশদ জ্ঞানও নেই—এই অবস্থায় তারা শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর তথ্যচিত্র বানানোর কাজে লেগে গেল (আদম সুরত)। টানা সাত বছর লেগেছিল সেই কাজ শেষ করতে। তাদের দুজনের জন্য সেই যাত্রা ছিল মোক্ষলাভের মঞ্জিলে পৌঁছানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ। এটা যে নিছক ছবি বানানোর যাত্রা ছিল, তা-ই নয়, এটা ছিল জীবনের গভীরতা আর সৌন্দর্য আবিষ্কারের এক মহাপরিক্রমণ।
এস এম সুলতান খুবই খেয়ালি আর আত্মভোলা মানুষ ছিলেন। কোনো দিন হয়তো সুলতানের সঙ্গে কথা বলে, তাঁর সম্মতি নিয়ে এই দুই উদীয়মান নির্মাতা খুব পরিকল্পনামাফিক দৃশ্য ধারণের জোগাড়যন্ত্র করেছেন। সবকিছু ঠিকঠাক। আচমকা এক মুহূর্তের নোটিশে শুটিং বাতিল করে এই দুজনকে ফেলে সুলতান উঠে চলে গেলেন কোনো বাউল মেলায় কিংবা কবিয়াল বিজয় সরকারের সঙ্গে দেখা করতে। এই প্রামাণ্যচিত্র করতে গিয়ে যশোরে (নড়াইল) জঙ্গলের মধ্যে সুলতানের পোড়ো জমিদারবাড়ির ধূলিময় মেঝেতে দুই বন্ধু রাতের পর রাত ঘুমিয়েছে। শিল্পকলা কিংবা কৃষকশ্রেণি নিয়ে সুলতান যখন গল্প করতেন, তখন এই দুই বন্ধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। সুলতানের ওখানে গিয়ে প্রায়ই তাদের ফিল্ম শেষ হয়ে যেত। টাকাপয়সার টানাটানির কারণে একেক খেপে তারা ১৬ এমএম ফিল্মের বড়জোর কয়েক শ ফুট নিয়ে যেতে পারত। এইটুকু ফিল্ম দিয়ে বড়জোর ১০-১৫ মিনিটের ফুটেজ ধরা সম্ভব ছিল। নতুন করে ফিল্ম কেনার টাকা জোগাড় করতে আরও কয়েক মাস কেটে যেত। পয়সায় টানাটানি থাকলেও তাদের কল্পনাশক্তির কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। কোন অবস্থায় সুলতানকে ভালো লাগবে; ঘন কুয়াশার মধ্যে লম্বা আলখাল্লা পরে তাঁর হেঁটে যাওয়া, নাকি খরস্রোতা নদীতে ভেলায় দাঁড়ানো অবস্থায়; নাকি লাঙল চাষরত পেশিবহুল কৃষকের ছবি আঁকার সময়—এই নিয়ে আলোচনা করে দুই বন্ধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত।
তারেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর এই সব গল্প তার কাছে শুনেছি। সময়টা ওই প্রকল্পের পঞ্চম বছরে—মানে ১৯৮৭ সালের শেষের দিকে। ওই সময়টাতে কাজটির বেশির ভাগ শুটিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ওই অবস্থায় তারা সুলতানের কাজটি শেষ করার দিকে মনোযোগী হয়। ডিএফপিতে ছবিটির পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু হয়। ঠিক ওই সময় আমি কাজটির সঙ্গে যুক্ত হই। আমার ছবি নির্মাণের সূচনা তখনই। ওই সময়ের কোনো একদিন তারেক আমাকে একটা রিকশায় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষচ্ছায়াশোভিত ফুলার রোড ধরে একটি বাসায় নিয়ে গেল। ফ্যাকাল্টি কোয়ার্টারে তখন মিশুক মুনীর তার বিধবা মাকে নিয়ে থাকত। তখন সে জাতীয় জাদুঘরে ফুলটাইম চাকরি করে। ফলে চাইলেই সে হুট করে শুটিংয়ের কাজে বাইরে যেতে পারত না।
তবে সুলতানের ওপর বানানো তথ্যচিত্রটি নিয়ে সব সময় আমরা আলোচনা করতাম। বাকি থাকা পাস শুটিং কী হবে; সম্পাদনার কাজ কত দূর এগোল, সবচেয়ে সাম্প্রতিক ক্যামেরা কী আছে—এই সব নিয়ে নিরন্তর আলাপ করতাম আমরা। আমি খুব দ্রুতই এই দুই বন্ধুর সৌহার্দ্য ও গভীর পারস্পরিক সম্মানবোধের বিষয়টি ধরে ফেলতে পারলাম। ১৬ এমএম ক্যামেরায় ডিজলভস অ্যান্ড ফেডসের কারিগরি দিক নিয়ে ওদের আলাপ-আলোচনায় যোগ দিয়ে খেয়াল করলাম, আমি নিজেও সিনেমাপাগল এক চক্রের মধ্যে হারিয়ে গেছি।
ডিজলভস অ্যান্ড ফেডসের মতো ইফেক্ট তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাবের উপযোগিতা উপেক্ষা করা হচ্ছে দেখে তাদের চোখে যে বিতৃষ্ণাপূর্ণ জ্বালা ফুটে উঠত, আমি তার মানে বুঝতে পারতাম। যেভাবেই হোক, সে সময়টাতে দুঃখজনকভাবে এই ল্যাব-সুবিধা ছিল না। সিনেমার যে ভাষা তখন এ দেশে প্রচলিত ছিল না, সেই ভাষা পরিস্ফুটন একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল।
মিশুকের বাসায় আমাদের মিটিংটা ছিল এমন এক ত্রিমুখী পার্টনারশিপ এবং নিবিড় বন্ধুত্বের শুরু, যা পরবর্তী ২৪ বছর অটুট ছিল।
মুক্তির গান প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল একটা কম্পাইলেশন ফিল্ম। এতে মিশুক আর তারেক মিলে রাতের একটা যুদ্ধের দৃশ্য ঢুকিয়েছিল। ওরা ওই দৃশ্যের চূড়ান্ত সম্পাদনা ও শব্দ ধারণের কাজটা সারার জন্য ওই অংশটা ১০ হাজার মাইল দূরে নিউইয়র্কে আমার কাছে পাঠিয়েছিল।
১৯৯০ দশকের শেষ দিকে বানানো হয় মুক্তির কথা। ওই কাজটির সময় আমি তারেক-মিশুক টিমের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ি এবং এই দুই সৃষ্টিশীল মানুষের সৃজনশীলতার যৌথ শক্তির সংযোগমাধ্যম হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হই।

রানওয়ে ছবির সেই আইকনিক দৃশ্য
রানওয়ে ছবির সেই আইকনিক দৃশ্য

মুক্তির কথা বানাতে গিয়ে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে, এমন মানুষের মুখের গল্প ধারণের জন্য আমরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছি। ফরিদপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম কোদালিয়ায় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রায় ২০ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করেছিল। মুক্তির কথায় তারেক ও মিশুক খুব সতর্কতার সঙ্গে নির্ভুলভাবে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ঘটনাটি তুলে ধরেছিল। মানুষকে তাৎক্ষণিকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত করে কীভাবে তাকে দিয়ে সহজভাবে কথা বলাতে হয়, সে ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত ছিল তারেক। আর কখন ক্লোজআপ শট নিতে হবে, কখন কোন দৃশ্যের ওপর জোর দিতে হবে—এসব কারিগরি বিষয় ভালো বুঝত মিশুক।
আরেকটি চ্যালেঞ্জিং শুটিং ছিল অনেকগুলো ক্যামেরায় মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহ বাঙ্গালীর ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছাড়ব না’ গানটির দৃশ্য ধারণ। নরসিংদীর একটি গ্রামে গানটির শুটিং হয়েছিল। একটা ছবির প্রদর্শন শেষ হওয়ার পর মঞ্চে গিয়ে গান গাওয়ার প্রস্তাব দিলেন শাহ বাঙ্গালী। ওই দৃশ্যকে স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলাটা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পুরো দৃশ্যটা স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলেও আসলে দৃশ্যটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। যেন সেটা একটা ফিচার ফিল্ম, এমনভাবেই মিশুক, তারেক ও আমি আগে থেকেই ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল ও চরিত্রগুলোর মুভমেন্ট নিয়ে একটি ডায়াগ্রাম তৈরি করেছিলাম। এখানে তারেক ও মিশুক সাধারণ মানুষের মতোই ক্যামেরায় ধরা দিয়েছেন। এখানে সত্যি গল্পের মধ্যে সাধারণ মানুষ ও ফিকশনাল টেকনিক সব যেন একাকার হয়ে গেছে।
মুক্তির কথার পর কয়েক বছরের বিরতি গেছে। এই সময়টাতে মিশুক প্রথমে একুশে টেলিভিশন এবং পরে কানাডার একটি অনলাইন নিউজ চ্যানেলে যুক্ত ছিল। এই কারণেই সে মাটির ময়না টিমে যোগ দিতে পারেনি। ফলে এই ছবিতে মুম্বাইভিত্তিক অতি মেধাবী ক্যামেরাম্যান সুধীর পালসানেকে নেওয়া হয়। কিন্তু মিশুককে নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন আমরা কখনোই ছাড়িনি। ২০০৫ সালে আবার আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করি। ওই সময় সে কানাডায় থাকত। সে বছর ঢাকায় আসার পর অন্তর্যাত্রা ছবির জন্য সে বেশ কয়েকটি পাস শুটিং করে দিয়েছিল। মিশুক তখন টরন্টোতে একরকম থিতু হয়েছে, কিন্তু সে আমাদের বলেছিল, বড় ধরনের কোনো প্রকল্পে সে আমাদের সঙ্গে থাকবে এবং এর জন্য তার অফিসকে ম্যানেজ করে দীর্ঘমেয়াদি একটা ছুটি নেবে।
এর পরের কয়েক বছর ধরে আমরা একসঙ্গে বেশ কয়েকটা ছোট প্রকল্পে কাজ করেছি এবং এ সময়টাতে আমাদের মধ্যে ফিচার ফিল্মের আইডিয়া নিয়ে আলাপ হয়েছে। এর মধ্যে কাগজের ফুল ও রানওয়ের কথা বলা যেতে পারে।
আমাদের ছোট প্রকল্পগুলোর একটি ছিল নরসুন্দর। এই শর্টফিল্মটি আমাদের ফিকশন ফিল্মে ডকুমেন্টারি টেকনিক ব্যবহার করার সাহস জুগিয়েছিল। এটিই ছিল আমাদের ‘ফিকশনালাইজড ডকুমেন্টারি’র উল্টো পিঠ। মাটির ময়না ছবির মতো এই ছবিতেও অনেক অপেশাদার শিল্পী দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। এখানে বিহারি সম্প্রদায়ের একজন সত্যিকারের নরসুন্দরকে দিয়ে কাজ করা হয়েছে। একাধিক ক্যামেরা এবং ফ্লুইড শুটিং স্টাইল ব্যবহার করে আমরা গল্পের মধ্যে তাৎক্ষণিকতা ও টেনশন জাঁকিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
এ ছবিতে নাপিতের দোকানের আঁটসাঁট জায়গার মধ্যে অনেকগুলো আয়নার প্রতিবিম্ব সামাল দেওয়াটাই আমাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শুটিংয়ের প্রথম দিন মিশুক কালো পোশাক পরে এসেছিল। পরের দিনগুলোতে সতর্ক রিহার্সাল এবং অ্যাডজাস্টেবল মিরর ব্যবহার করে শুটিং শুরু করি। এই ছবি শেষ করতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি টেক নিতে হয়েছে।
ফিকশন ফিল্ম রানওয়ে বানানোর সময় আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বেড়ে যায়। ইতিমধ্যেই তারেক আর মিশুকের পারস্পরিক বোঝাপড়া এত সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে কোনো নির্দিষ্ট দৃশ্য কীভাবে ধারণ করতে হবে, তার জন্য তাদের আলাদা করে আলোচনাও করতে হতো না। অব্যক্ত ভাষায়ই দুজন দুজনের কথা ঠিক বুঝে নিত। শুটিংয়ের জন্য এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখে মিশুক শুধু বলেছিল, ‘টেলিফটো লেন্স’; তারেক সম্মতিসূচক মাথা নেড়েছিল। শুটিংয়ের জন্য ঠিকঠাক জিনিস জোগাড় করতে মিশুক ফিরে গেল কানাডা। সেখান থেকে সে আদি আমলের একটা পুরোনো নাইকন ২০০ এমএম লেন্স জোগাড় করল।
এই লেন্সেই তোলা হয় রুহুল নামের চরিত্রটির সেই আইকনিক ছবি, যেখানে রানওয়ে গাইড লাইটের দুটি সারির মাঝখান দিয়ে রুহুলকে হেঁটে যেতে দেখা যায়; আর তার মাথার ওপর দিয়ে একটি বিশাল ৭৪৭ উড়ে যেতে দেখা যায়। এই জাদুকরি মুহূর্ত সফলভাবে ধারণ করার সেই উত্তেজনাকর মুহূর্ত আজও আমার মনে পড়ে। এই দৃশ্য ধারণের মধ্য দিয়ে আমরা আরও একবার পরস্পরকে ঠিকঠাক বোঝার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
তারেক ও মিশুক যতই নতুন নতুন জিনিস শিখছিল এবং নতুন নতুন নিরীক্ষায় নিজেদের সম্পৃক্ত করছিল, ততই তাদের টিমওয়ার্ক ক্রমশ বিবর্তিত হচ্ছিল। তাদের মধ্যে এক অসীম সম্ভাবনাময় প্রজ্ঞা বিকশিত হচ্ছিল। কীভাবে যেন আমি তাদের সঙ্গে ঠিকঠাক খাপ খাইয়ে গেলাম এবং আমরা এক অনন্য ত্রয়ী হয়ে উঠলাম। তাদের এই আকস্মিক চলে যাওয়ার পর আমার মনে হয়, আমাকে আমার সেই ত্রয়ী শক্তি থেকে বিচ্যুত করে ফেলা হয়েছে; সেই আনন্দপূর্ণ বলয়ের প্রজ্বলিত শক্তি ছাড়াই এখন আমাকে নিজস্ব সৃষ্টিশীল পথে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছে।
কিন্তু এখনো আমার মধ্যে সেই টিমটা আছে। আমি এটা অনুভব করতে পারি। আমি যখন কোনো ডকুমেন্টারি দৃশ্য ধারণের জন্য ক্যামেরা তুলি, তখন মিশুকের কাছ থেকে নেওয়া তালিমের কথা মনে পড়ে। তার সেই শিক্ষা মাথায় রাখায় দৃশ্য ধারণের আগেই সম্পাদনার পর দৃশ্যটা কেমন হবে, সেই ছবি আমার চোখে ভেসে ওঠে। সে আমাকে কোনো কথা না বলেই অনেক কিছু শিখিয়েছিল। সে কীভাবে শুট করত, কীভাবে সম্পাদনা করত, তা আমি গভীরভাবে দেখেছি। সেই দেখা থেকে শিখেছি এবং অবশ্যই তারেক—প্রতি পদক্ষেপে তার হাজারো প্রজ্ঞাময় বাণী আমার কানে বাজে। শুধু সিনেমার ক্ষেত্রে নয়; জীবনের ক্ষেত্রেও। তারা দুজনেই এমন স্ফুলিঙ্গ ছিল যে যাদেরই তারা স্পর্শ করেছে, তাদেরই চারপাশে আশার আলো জ্বলে উঠেছে। তাদের স্মৃতি যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিন তাদের সেই আলো আমাদের অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নেবে।
আমরা কী হারিয়েছি সেটি নয়, বরং তাদের কাছ থেকে আমরা কতটুকু অর্জন করেছি, সেদিকেই আমাদের দৃষ্টিপাত করতে হবে। এই জাতি ও নতুন প্রজন্মের সামনে একটি সৃষ্টিশীল প্রতিশ্রুতিময় রূপকল্পের মডেল হলো তাদের অটুট উত্তরাধিকার। প্রথাগত সংকীর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার বাইরে নতুন চিন্তার পথপ্রদর্শক তারা।
সৃষ্টির আনন্দে ডুবে কাজের প্রতি নিবেদিত হওয়ার ক্ষেত্রে তারা ছিল অনন্য মডেল। তারা যে চলচ্চিত্র ও ছবি আমাদের জন্য রেখে গেছে, তা আমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকবে।

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ