দরজার ওপাশে অথবা গীতিকবি বাপ্পী খানের নিজস্ব পঙ্‌ক্তিমালা

‘এখন অনেক রাত’, ‘হায় স্বাধীনতার’–এর মতো অজস্র শ্রোতৃপ্রিয় গানের গীতিকবি বাপ্পী খান। গীতিকবি শেখ রানার কাছে তিনি বলেছেন তাঁর গান লেখা ও তার পেছনের গল্প। আর এসব গল্পের মধ্য দিয়ে ধরা পড়েছে আমাদের ব্যান্ড সংগীতের টুকরো টুকরো ছবিও।

বাপ্পী খানের ছবি অবলম্বনে মনিরুল ইসলাম
বাপ্পী খান
ছবি: সংগৃহীত

তখন নিবাস পুরানা পল্টনে। ঢাকা কলেজের আনন্দপাঠ আর প্রিয় শহরের আগলে রাখা বাতাবরণে সহজিয়া সময়। মহল্লার আড্ডায় একজন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন পাড়ার এক বন্ধুকে। মাদকের করাল গ্রাসে সম্ভাবনাময় একজন মানুষের ঝরে পড়ার আগাম বিউগল বেজে ওঠে কবির শব্দচয়নে। লেখা হয়:
‘এবার আমার সময় এসেছে/ আলোর পৃথিবী আমায় ডেকেছে/ অন্ধকারে হারিয়ে যাব না আর।’

তত দিনে সংগীত পরিচালক আশিকুজ্জামান টুলুর বাসায় তাঁর নিত্য যাতায়াত। এদিকে লেখাটাও একটু একটু করে পরিপুষ্ট হচ্ছে। লেখায় বৈচিত্র্য আনার জন্য উপমা খুঁজতেই পেয়ে গেলেন, ‘বাতাসের চেয়েও ছন্দময় হব/ জলের চেয়েও তরল।’
সপ্তাহ দুই পর লেখাটা শেষ হলো।

‘এই লিরিকটা টুলু ভাই দেখে ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম মিক্সড ক্যাসেট “স্টারস-১”–এ খালিদের কণ্ঠে গান হয়ে গেল। আমার খুব প্রিয় একটা গান এটা। ১৯৯১ সালের কথা বলছি। অথচ এই সেদিনও, আমার প্রতিকূল সময়ে খানিক আশাভঙ্গের দোলাচলে যখন দুলছি, দেখি নিজের অজান্তে এই গানটাই গুনগুন করছি। গানে অবশ্য টুলু ভাই “তরল” শব্দটা বদলে “সজল” করেছিলেন। আমি তো আসলে গায়ক হব ভেবেছিলাম। কিন্তু টুলু ভাই আমার গীতিকবি সত্তাটা আবিষ্কার না করলে হয়তো এত লেখা হতো না। টুলু ভাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

কথা বলছিলেন বাপ্পী খান। এই গীতিকবির শব্দচয়নেই তাহলে তাঁর গীতিকবির কথামালা শুরু করা যাক। বাংলা গানে প্রেম, দ্রোহ আর নাগরিক গীতিকবিতায় যিনি মনোযোগী শব্দচয়নে বলে গেছেন, ‘তখনো জানতে বাকি/ তুমি আর আমি/ কার চেয়ে কে বেশি কাকে ভালোবাসি।’ অথবা গিটারের ডিস্টর্শনে ঝড় তোলা, ‘আমি এক সাধারণ ছেলে/ স্বাধীন আমার বাংলাদেশের নগণ্য এক ছেলে।’
হায় স্বাধীনতা!

বিষয়ভিত্তিক গীতিকবিতা লেখার ভাবনা

১৯৮৮-৮৯ সালের ঘটনা। শহর উত্তাল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। বাংলা গানে রোমান্টিকতার আবেদন পাশ কাটিয়ে বাপ্পী খান নিয়ম ভাঙতে চাইলেন। নিয়ম ভাঙতে হলে তো নিয়ম জানতে হবে। শুরু হলো রসদ জোগাড় করা। উনিশ শতকের গোড়া থেকে শুরু করে আশি পর্যন্ত বাংলা গানের ঝাঁপি খোলা হলো একান্তে। অনেক গান শুনে শুনে এরপর কান জানল লিখতে হবে, মন বুঝল শব্দ ধরতে হবে। পাশাপাশি ইংরেজি আর হিন্দি গজল তো ছিলই সারথি হয়ে। বাপ্পী খান তখন সৃষ্টির আয়নাঘরে বিভোর হয়ে লিখছেন। ভাবনার অলিন্দে ঘুরপাক খাচ্ছে ‘হায় স্বাধীনতা’, ‘একজন জারজ সন্তান’, ‘পেনশন’ অথবা ‘এক কাপ চা’র শব্দচয়ন। গীতিকবিতা। গান।
‘একদম শুরু থেকে আমার গীতিকার জীবনের গল্প বললে তিনজনের নাম বলতে হবে—আশিকুজ্জামান টুলু, আইয়ুব বাচ্চু আর জেমস। বাচ্চু ভাই আমাকে বিষয়বস্তু নির্বাচনের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন। প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ভিত্তিক লিরিক নিয়ে গেছি। কিন্তু একদিনও তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। টুলু ভাই আমাকে ছন্দের দিকে মনোযোগী করেছেন আর জেমস ভাই দেখিয়েছেন সুরের ওপর লেখার আনন্দনগর। এই তিনজন আমাকে গীতিকার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আমিও ভাবনার পথে যাযাবর হয়ে ইচ্ছেমতো শব্দচয়ন করেছি। নাগরিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শব্দে ধরেছি চারপাশ।

‘তবে বাচ্চু ভাই আমাকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ দিয়েছেন। আমার গীতিকার জীবনের পথপরিক্রমায় বেশি হেঁটেছি বাচ্চু ভাইয়ের সুরে।’ জানালেন বাপ্পী খান। এরপর গান নিয়ে একে একে স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন তিনি।

আইয়ুব বাচ্চু ও বাপ্পী খান
ছবি: সংগৃহীত

ইদানীং আমার সুখের তক্তপোষে

‘সুখ’—এলআরবির দ্বিতীয় অ্যালবাম। ১৯৯২ সালে প্রকাশ পেয়ে ধীরগতিতে গানগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে গেল। ধীরে ধীরে কানে লেগে থাকার কারণেই বোধ হয় গানগুলো এখনো শ্রোতাদের কানে লেগে আছে। কত বছর হয়ে গেল! কিন্তু এখনো ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’, ‘সুখ’, ‘যত বেশি আমি’, ‘হাসপাতাল’—কান পাতলেই গানগুলো শুনতে পাই। গানগুলোর কথা-সুরের আল ধরে সেই পুরোনো সময়ে ফিরে যাওয়া অথবা নতুন করে আবিষ্কার করে বিস্মিত হওয়া যায় অনায়াসে! এক দুর্দান্ত ব্যান্ড, তার জমাট কম্পোজিশন আর শক্তিশালী শব্দচয়নে গাঁথা গীতিকবিতা।

‘সুখ’ নিয়ে বাপ্পী খানের এন্তার সুখস্মৃতি। এ বিষয়ে কথা বলতে তাঁকে আরেকটু উসকে দিই আমি। ফলে প্যান্ডোরার বাক্স থেকে গল্পগুলো বেরিয়ে আসে একে একে।
‘“সুখ” অ্যালবামের প্রথম গান কিন্তু “গতকাল রাতে”। তবে শ্রোতারা শুরুতেই পছন্দ করে “চলো বদলে যাই”। “চলো বদলে যাই” বসের লেখা। বস দারুণ লিরিক লিখতেন।

‘আমার আটটা লিরিক ছিল এই অ্যালবামে। “গতকাল রাতে” লিখেছিলাম একটা ভুলতে চাওয়া রাতকে মনে করে। অদ্ভুত ব্যাপার! যে রাতকে মনেপ্রাণে ভুলতে চাইছি তাকেই মনে করে শব্দচয়ন করছি। তখন তো যাত্রাপালায় বিবেক ছিল পরিচিত চরিত্র। লিখতে লিখতে যেন সেই উঁচু লয়ে সংলাপ বলা কেউ আমাকে অনবরত প্রশ্ন করছিল, আমায় ছাড়া আর কত দিন রবে! “সুখ” গানটা বস কম্পোজ করেছিলেন পিঙ্ক ফ্লয়েডের “শাইন অন ক্রেজি ডায়মন্ড” গানে প্রভাবিত হয়ে। সেই সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে দীর্ঘ পরিসরের গান “সুখ”। আমরা তখন দল বেঁধে পিঙ্ক ফ্লয়েড শুনি। আমি নিজেও রজার ওয়াটার্সের ভীষণ ভক্ত ছিলাম। পিঙ্ক ফ্লয়েডের গানে যে সুররিয়ালিজম আছে, আমাকে তা প্রচণ্ডভাবে সম্মোহিত করেছিল। বাস্তবতা বুঝতাম, কিন্তু বাস্তবতাকে নিজের মতো করে বিমূর্ত রূপ দেওয়ার প্রয়াস বরাবর ছিল।

‘আমার ভেতরে অনেকগুলো আমির যে দ্বন্দ্ব, সেখান থেকেই লেখা “আমি যে কার, আমি যে আসলে কার মতো”। একটা কথা মনে পড়ে গেল, “আমি যে কার” গানের ভয়েস রেকর্ডের সময় বাচ্চু ভাই আমাকে একদম পাশে বসিয়ে ভয়েস টেক নিয়েছিলেন। প্রতিটি শব্দের যাতে উচ্চারণ ঠিকঠাক হয় সে ব্যাপারে আমার পরামর্শ নিয়েছিলেন। এতটাই যত্ন করে গান বাঁধতেন তিনি।

‘এই অ্যালবামে একমাত্র সুরের ওপর লেখা গান হলো “ক্ষণিকের জন্য”। একদম বেসিক রক অ্যান্ড রোল প্যাটার্ন। এর পেছনের গল্পটা মজার। কবীর সুমনের গান তখন আলোড়ন তুলেছিল মনে। “আমাদের জন্য” গানটা শুনলাম। শুনে মনে হলো, আসলেই সব কি আমাদের জন্য? নাকি এই সব, যা আমাদের জন্য তা আদতে ক্ষণিকের জন্য! ব্যস! সুরের ওপর লিখতে বসে গেলাম ক্ষণিকের জন্য।
‘“ইফ ইউ লাভ সামথিং, সেট ইট ফ্রি”—এই হলো “যত বেশি আমি” গানের মূলমন্ত্র। মনের সঙ্গে আমার আলাপচারিতাও উঠে এসেছে এই লিরিকে।

‘“হাসপাতালে” গানটার জন্ম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। চন্দনা ভাবির অসুস্থতায় আমিও তখন বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে হাসপাতালে। নির্ঘুম এক রাতে এই লাইনটা মাথায় এল, “অসুস্থ আমি এক হাসপাতালে/ শূন্য এ বুক কাঁদে ভিজিটিং আওয়ারে।”
‘মাঝেমধ্যে মনে হয়, একজন শক্তিমান লেখক চারপাশের যেকোনো চরিত্রকেই গল্প বা উপন্যাসের নায়ক বানিয়ে চিত্রিত করতে পারেন। একইভাবে আবেগ আর শব্দের বুননে প্রতিটি বিচ্ছিন্ন ভাবনাই এক একটা গান হতে পারে। সেটা খুবই সম্ভব।’

‘আমার আটটা লিরিক ছিল এই অ্যালবামে। “গতকাল রাতে” লিখেছিলাম একটা ভুলতে চাওয়া রাতকে মনে করে। অদ্ভুত ব্যাপার! যে রাতকে মনেপ্রাণে ভুলতে চাইছি তাকেই মনে করে শব্দচয়ন করছি। তখন তো যাত্রাপালায় বিবেক ছিল পরিচিত চরিত্র। লিখতে লিখতে যেন সেই উঁচু লয়ে সংলাপ বলা কেউ আমাকে অনবরত প্রশ্ন করছিল, আমায় ছাড়া আর কত দিন রবে! “সুখ” গানটা বস কম্পোজ করেছিলেন পিঙ্ক ফ্লয়েডের “শাইন অন ক্রেজি ডায়মন্ড” গানে প্রভাবিত হয়ে।

প্রিয় গীতিকবিরা এবং গানের প্রেক্ষাপটের অদল-বদল

‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামের প্রচ্ছদ

‘কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখায় একটা অদ্ভুত সম্মোহন আছে। “আমায় ডেকো না” কী সুন্দর একটা লিরিক। এই মানুষটার লেখা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোথায় যেন! তারপর মনের মধ্যে গানটা শান্ত হয়ে বসে থাকে। আমি “কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে” শুনে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে টুলু ভাইকে হাসতে হাসতে একবার বলেছিলাম আমি “কবিতা পড়ার প্রহর” দ্বিতীয় পর্ব লিখব। স্বভাবতই তা লেখা হয়নি। “কবিতা পড়ার প্রহর” একটাই হয়, একবারই হয়।

‘লতিফুল ইসলাম শিবলী আমার বন্ধু মানুষ। আমার প্রিয় গীতিকবিদের একজন। শিবলী আপাদমস্তক কবি। রোমান্টিক গানে ওর নামডাক থাকলেও বিষয়ভিত্তিক গানে শিবলী ওস্তাদ লোক, সিদ্ধহস্ত। ওর লেখা অনেক গান আমার পছন্দের, কিন্তু একটা গান বেছে নিতে বললে আমি বেছে নেব “আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি”।

‘নিয়াজ আহমেদ অংশু। অংশু সহজ মানুষ, আমার ভাবনার সঙ্গে খুব মিলে যায় ওর। আমি অংশুর লেখার ভক্ত আর ও হলো আমার গুণমুগ্ধ। হা হা হা! অংশুর অনেক লেখা পড়ে মনে হয়েছে, আ রে! এ রকম তো আমি লিখব ভেবে রেখেছিলাম। এ প্রসঙ্গে অংশুর লেখা “মেয়ে” গানটার কথা বলা যায়। যে কথাটা আলাদা করে বলি, ক্যাসেট যুগে সব সেরা প্রচ্ছদগুলো কিন্তু আমাদের অংশুর করা।’

ক্যাসেট যুগ আর ইউটিউব যুগ নিয়ে কিছু কথা হোক

‘ক্যাসেট যুগ এল লং প্লে যুগ শেষে। ক্যাসেট প্লেয়ারে ক্যাসেট ঢুকিয়ে ফিতা ঘোরানোর সেই নস্টালজিয়া! আমাদের বাসায় একটা ডাবল ডেক ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। আমি নানা রকম গান সেখানে ক্যাসেট টু ক্যাসেট রেকর্ড করতাম। মাসে ৭০ টাকা পেতাম হাতখরচ। তা দিয়ে দুটি ক্যাসেট কিনতে পারতাম। সেই আনন্দ আসলে বলে বোঝানো যাবে না।

‘ক্যাসেট যুগ, সিডি যুগ পার হয়ে এখন তো অনলাইনে সবকিছু। ইউটিউবে গান। যেটা হয়েছে, এখন আগের মতো চোখ বন্ধ করে গান অনুভব করার মানুষ কমে গেছে। গানের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুতা আগের চেয়ে ক্ষয়ে গেছে। তবে আমার কোনো ক্ষোভ নেই কিন্তু এই নিয়ে। যুগের পরিবর্তন মেনে নিতে হবে। তার সঙ্গে সম্ভব হলে বদলে যেতে হবে যদি কেউ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চায়।

‘একটা ভালো দিক হলো, এখন গানগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। গান হারিয়ে যাচ্ছে না। এর ভেতরেই ভালো গান তার নিজস্ব জায়গা করে নেবে। হারিয়ে যাবে না।
‘ভালো গান কখনো হারায় না। কিন্তু কেউ যদি ভিউ গুনে ভালো গান বিচার করতে যায়, তাহলে সে গান শুনবে অনেক, কিন্তু ভালো গান আর খুঁজে পাবে না।’

এমন একটা সময় ছিল, মায়াবী রাত নিঝুম ছিল

বাপ্পী খানের গানের জগতে আগমন গায়ক হিসেবে। প্রথম অ্যালবাম করেন আশিকুজ্জামান টুলুর সুর-সংগীতে। সেখানে নিজের লেখা আটটি লিরিক ছিল। অ্যালবামের কাজের সূত্রেই আশিকুজ্জামান টুলু তাঁর লেখার প্রশংসা করেন। গান লেখায় উৎসাহ দেন। বাপ্পী খান গান লেখায় মনোযোগী হন।

আশিকুজ্জামান টুলুকেই তাই পথপ্রদর্শক মনে করেন বাপ্পী খান। অনেক কাজ হয়েছে দুজনার। তবে তার ভেতর থেকে তিনটি গান বেছে নিতে বললে বাপ্পী খান বরাবর বেছে নেন এই তিন গান—পঞ্চমের কণ্ঠে আর্ক ব্যান্ডের ‘এমন একটা সময় ছিল’, সামিনা চৌধুরীর ‘এলোমেলো ছিল আমার কবিতার খাতা’ আর খালিদের কণ্ঠে ‘স্টারস-১ মিক্সড’ অ্যালবামের ‘এবার আমার সময় এসেছে’।

ইচ্ছের পালক দিয়ে লিখেছি নতুন ঠিকানা

জেমস ভাইয়ের সঙ্গে বাপ্পী খানের আড্ডা জমে যেত খুব। গল্প–উপন্যাস–কবিতার বই নিয়ে ভাবের আদান-প্রদান হতো জম্পেশ। জেমসকে বরাবর এক বিস্ময়কর মানুষ মনে হতো তাঁর।

তখন ফাহমিদা নবীর একটা অ্যালবামের কাজ করছিলেন জেমস। জোর করে বাপ্পী খানকে সুরের ওপর গান লেখালেন। যদিও গানগুলো পরে আর প্রকাশ পায়নি। তবে একসঙ্গে কাজ হয়েছে বেশ কিছু। ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামের ‘ঝড়ের রাতে’, ‘ঢাকার প্রেম’ আর ‘ইচ্ছের পালক’। ‘পালাবে কোথায়’-এর ‘সাদা অ্যাশট্রে’, ‘ভুলব কেমন করে’। এই লিরিকগুলো বাপ্পী খানের প্রিয় লিরিক। গানগুলোও।

জেমসের সঙ্গে বৌদ্ধিক আড্ডা এখনো মিস করেন তিনি। কিন্তু পুরোনো সময়ে আর ফেরা হয় না সময়ের নিয়মেই।

এখন অনেক রাত, খোলা আকাশের নিচে

‘সুখ’ অ্যালবামের প্রচ্ছদ

‘বাচ্চু ভাইয়ের কথা আসলে আলাদা করে কীভাবে বলব বুঝতে পারি না। কত যে কথা, অভিমান, কাজ আর ভালোবাসা বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে। বাচ্চু ভাই চলে যাওয়ার পর আমি কোথাও কিছু বলতে পারিনি। বলতে চাইওনি আসলে। এত একা লাগছিল। বাচ্চু ভাইকে আমি খুব মিস করি। এই হাহাকার আমৃত্যু থেকে যাবে আমার সঙ্গে।

‘বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার ৭০টির মতো গান লেখা হয়েছে। আজ ভাবতে বসে অবাকই হলাম! এত গান কবে লিখলাম! এর ভেতর সবচেয়ে প্রিয় তিনটি কাজ হলো “গতকাল রাতে”, “এখন আনেক রাত” আর “সাড়ে তিন হাত মাটি”।

‘সেই একানব্বই সাল থেকে আমাদের পরিচয়। ক্রমে ক্রমে আমি বাচ্চু ভাই ও তাঁর পরিবারের আপন মানুষ হয়েছি, স্নেহ আর ভালোবাসা পেয়েছি।

‘সোলস থেকে এলআরবির সেই ভাঙা-গড়া পর্ব আর নতুন পথের দিশারি হয়ে নতুন করে শুরু করা—এই সবকিছুই আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এ আমার পরম প্রাপ্তি। কত স্মৃতি বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে! “এখন অনেক রাত” গানে একটা লাইন ছিল “খোলা আকাশের ছাদে”। গান সুর করার সময় বাচ্চু ভাই রীতিমতো কাঁচুমাচু হয়ে আমাকে বললেন, বাপ্পী, ছাদের জায়গায় নিচে গাই? শুনতে ভালো শোনায়। কী বলিস তুই? আমি হেসে সম্মতি দিই। জন্ম নেয় “এখন অনেক রাত”–এর মতো কালজয়ী গান।’
: একদম শুরুর যোগাযোগটা কীভাবে হলো বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে?
: ওই যে জেমস ভাই ফাহমিদা নবীর জন্য অ্যালবাম করছিলেন, সেই সূত্রেই বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। সারগামে রেকর্ডিং হচ্ছিল। গানের নাম ‘পেন ফ্রেন্ড’; ম্যানিলা। এলআরবির ডাবল অ্যালবামের কাজ তখন প্রায় শেষের দিকে। গান শুনে বাচ্চু ভাই জেমস ভাইয়ের কাছে গীতিকারের হদিস জানতে চাইলেন। আমার কথা শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার লেখা আরও গান আছে কি না। তখন আমার কাছে গান ছিল না। তবে একটা ডায়েরি ছিল। তাতে গোটা দশেক কবিতা লেখা। নিয়ে আসতে বললেন। আমি সেই কবিতার ডায়েরি সারগামে রেখে আসি।

পরদিন বসের ফোন। তিনটা কবিতা গান হয়ে গেছে। ‘পেনশন’, ‘এক কাপ চা’ আর ‘জীবনের মানে’। সেই পথপরিক্রমায় কত কত গান যুক্ত হলো অবশেষে। ‘কষ্ট’ অ্যালবামের ‘হৃদয়ের পুনর্বাসন’, মিক্সড অ্যালবামে ‘তখনো জানতে বাকি’, ‘আমি অবাক হয়ে যাই’, ‘স্বপ্ন’ অ্যালবামে ‘হৃদয়ের ভগবান’, ‘ধুন’–এ ‘লোকজন কমে গেছে’, ‘যে মানুষটি’, ‘সময়’ অ্যালবামে ‘একঝাঁক পায়রা’, ‘বিবর্ণ ভালোবাসা’, ‘তুমিহীনা সারা বেলা’র ‘পাষাণী’, নিলয় দাসের গাওয়া ‘রাত না হওয়া ভোরে’...আরও কত গান বসের সুরে!
একটা মজার তথ্য বলি। ‘তুমিহীনা সারা বেলা’র কাজ চলছে। ‘পাষাণী’ গান প্রায় শেষের দিকে। মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। বাচ্চু ভাইকে গিয়ে নিরীহ মুখে বললাম, ‘বস, ইন্ডাস্ট্রিতে তো টুটুল নামে অনেকে আছে। আমাদের টুটুলের একটা বিশেষণ দরকার। ওর নাম যেহেতু শহিদুল ইসলাম টুটুল তাই এস আই টুটুল ডাকা যায়।’ বস, সহাস্যে সম্মতি দেন। সেই থেকে আমার বন্ধুর নাম হয়ে গেল এস আই টুটুল। বস ডাকতেন এস আই।

আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে বাপ্পী খানের গল্প আসলেই অনেক। সেই গল্পগুলোও এক একটা গান। এক একটা সুর। এক একটা গীতিকবিতা। এই সব কথা, সুর আর সংগীতের সঙ্গে একজন গীতিকবি শব্দপাখিদের নিয়ে অবগাহন করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। সেই অবগাহনে আমাদের বাংলা গান ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়। আমরা যে দিনগুলো ফেলে এসেছি, সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে দেখতে পাই আমাদের শৈশব-কৈশোর আর বাংলা গানের মধ্যগগন কতটা প্রাণবন্ত ছিল বিষয়বৈচিত্র্য আর নাগরিক সহজিয়া ভোরে।
সেই ভোরগুলো ফিরে আসুক না হয় আবার।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]