দিনলিপির শওকত ওসমান

শওকত ওসমান
আজ কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী

রুশ বিপ্লবের বছর ১৯১৭-তে জন্ম বাঙালি কথাকার শওকত ওসমানের। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্রের সংগ্রাম ইত্যাদি অভিজ্ঞতার আভায় স্নাত তাঁর জীবন ও সাহিত্য। ‘শেখ আজিজুর রহমান’-এর ‘শওকত ওসমান’ হিসেবে আবিভূর্ত হওয়া, পশ্চিমবঙ্গের হুগলীর সবলসিংহপুরের সন্তানের কলকাতার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ ও শিক্ষকতা, কলকাতার ইনস্টিটিউট অব কমার্সে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য অভিনেতা উত্তমকুমারকে কিছুকাল ছাত্র হিসেবে পাওয়া, দেশভাগের পর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় আগমন, কর্মমুখরতা—এসবই তাঁর বিচিত্র-বর্ণাঢ্য জীবনের একেকটি স্মারক। সাহিত্যজীবনের প্রারম্ভিক পর্বে কবিতা, গল্প ও শিশুসাহিত্যে সক্রিয় হলেও ক্রমেই বিশাল বাংলার ভূগোল ও জনজীবন ভাস্বর করতে শুরু করেন উপন্যাসের অবয়বে। ‘ওটেন সাহেবের বাংলো’ নামের শিশু–কিশোর বই দিয়ে গ্রন্থকার যাত্রা শুরু। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, অনুবাদ, নাটক, দিনলিপি, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী ইত্যাদি মিলিয়ে বিপুল গ্রন্থের প্রণেতা হয়েও নিজেকে তিনি বলতেন ‘ঝাড়ুদার গ্রন্থকার’, কারণ তাঁর আমৃত্যু ব্রত ছিল সাহিত্যসাধনার মধ্য দিয়ে ‘এই ক্লিষ্ট দুনিয়ার/ সব ময়লা করব সাফ’। তাঁর ‘ক্রীতদাসের হাসি’ (১৯৬২) উপন্যাসের শেষাংশে তাতারীর সংলাপ, ‘দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। কিন্তু-কিন্তু-ক্রীতদাসের হাসি-না-না-না-না-।’ যেন যেকোনো রুদ্ধ-বাস্তবে চিরকালের স্বাধীন মানবাত্মার সংলাপ। ‘মৌন নয়’ গল্প বা ‘আর্তনাদ’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ভাষাসংগ্রাম আর ‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘দুই সৈনিক’ উপন্যাসগুচ্ছের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামকে নতুন ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করেছেন তিনি। শওকত ওসমানের ‘জননী’ (১৯৬৮) উপন্যাস প্রকাশিত হলে সাহিত্যিক আতোয়ার রহমান তাঁকে ‘পূর্ব বাংলার গোর্কি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেন।

হুমায়ুন আজাদের পর্যবেক্ষণে শওকত ওসমান ‘সহস্র ফালতুর ভিড় ঠেলে, দালানের অশ্লীল দম্ভ পেরিয়ে বাংলার অধিকারহীন মানুষের গা ঘেঁষে এগিয়ে গেছেন।’

২.
শওকত ওসমান তাঁর সুপরিসর আত্মকথা ‘রাহনামা’য় নিজের জীবনসূত্রে আমাদের সমাজ-রাজনীতি-সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এ ছাড়া ‘স্বজন স্বগ্রাম’, ‘কালরাত্রি খণ্ডচিত্র’, ‘স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর’, ‘উত্তরপর্ব মুজিবনগর’-এর মতো জার্নালধর্মী বইয়ে তিনি সময়ের চূর্ণকথন টুকে রেখেছেন, যা সত্যের পূর্ণায়ত রূপ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ সহায়ক। তবে গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ সংগৃহীত শওকত ওসমানের ‘দিনলিপি ১৯৭২’–এ (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯) পাওয়া যাবে অন্য এক শওকত ওসমানকে। সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘মুখবন্ধ’-এ বলেছেন:
‘তাঁর ছাত্রদের তিনি পুত্রের মতো ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন আমার পিতৃপ্রতিম। এই নোটবই এবং তাঁর কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র তিনি আমাকে সস্নেহে উপহার দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন “তোমার কখনো কাজে লাগবে।”’

আমরা মনে করি, জানুয়ারি-জুলাই ১৯৭২ কালপর্বের এই দিনলিপি আমাদের সবার কাজে লাগবে; সাহায্য করবে জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রকৃত স্বরূপ জানতে।

মুক্তিযুদ্ধকালে সংগ্রামী শওকত ওসমান কলকাতায় ছিলেন, বাংলাদেশের রক্তস্নাত বিজয়ের পরও কিছুদিন সেখানেই ছিলেন। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে দিনলিপিতে লিখছেন:
‘বঙ্গজননীর অমর সন্তান বিজয়ীর বেশে ফিরে এল। আমি তাঁকে অভিনন্দন দিতে পারলাম না, অনুতাপের মতো এই দুঃখ মাঝে মাঝে খচখচ বিঁধবে।’

বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাঁর নিজের দেশে ফেরার খাতা অতঃপর খুলে ধরেন এভাবে:
‘এয়ারপোর্ট থেকে সোজা মার রোগশয্যাপাশে। যেমন বাংলাদেশকে ফিরে পেয়েছি, তেমনি জননীকে।’

বুঝতে পারি, ‘জননী’র লেখক শওকত ওসমানের কাছে দেশের জননীরূপ সব সময়ই প্রধান ছিল। তাই দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সাহিত্যিক সংগ্রাম তাঁর কাছে মায়ের প্রতি ভালেবাসা হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছে।

১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারির দিনলিপিতে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদ এসেছেন তাঁর এমন অমর-প্রতিকৃতিতে:
‘সুরকার আলতাফ মাহমুদের মৃত্যুর আরও একটা সুলুক পাওয়া গেল। তাঁর ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালায় জালেমেরা বেশ কয়েক দিন ধরে। আহ...যে বুকে শব্দরঙ্গের অজস্র কুঁড়ি ফুটে থাকত আর মাঝে মাঝে ফিরে আসত সংগীত-কুসুম রূপে, উত্তাপের মাত্রায় মাত্রায় তা ধুকধুক করছিল নিশ্বাসের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে, কী যন্ত্রণায়, আমরা কেউ কল্পনা করতে পারব না।’

স্বাধীন স্বদেশে, ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হানের নিখোঁজ সংবাদে ব্যাকুল শওকত ওসমান ১৯৭২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারির কাতর দিনলিপিতে রচনা করেন এমন আর্ত অক্ষর:
‘জহির রায়হান।

শেষ সাক্ষাৎ কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের দোতলায় পার্ক সার্কাস অ্যাভিনিউয়েড বাড়িতে। নভেম্বর মাস। একটা ডকুমেন্টারি নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

শহীদুল্লার খোঁজে গিয়েছিলে, ভাই। তোমারও খোঁজ আর পেলাম না। কদিন থেকে বাঁচার স্বাদ উবে যাচ্ছে।’

১৯৭২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির দিনলিপিতে প্রয়াত জননীকে কবর দিতে গিয়ে ১৯৬৪ সালে অকালে হারানো সন্তানের বিয়োগব্যথাতুর পিতা শওকত ওসমানকে পাই এভাবে:
‘আবার আজিমপুর গোরস্থানে। মা একা নয় এখানে। আমার তুরহান কোথাও শুয়ে আছে। পাছে পুরাতন ঘা আবার ঝিলিক দিয়ে ওঠে, তাই জায়গাগুলোর দিকে তাকাতে সাহস পাইনে।’

শোকে আচ্ছন্ন লেখকের মতোই প্রত্যয়ে দীপ্ত লেখককে আবিষ্কার করা যায় ১৯৭২ সালের ৮ মের দিনলিপিতে। সেদিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রজয়ন্তী। স্মৃতি থেকে বলছেন:
‘আজ মনে পড়ে, ১৯৫৮ সালে যখন সামরিক স্বৈরতন্ত্র বাংলার আলো-বায়ু নিভিয়ে দিতে তাদের বুটের ঠোক্কর দিগ্বিদিক মারতে লাগল, মুহ্যমান অসহায় দিশেহারা প্রায় অন্ধ আবেগের ধাক্কায় আত্মহত্যাপ্রবণ, তখন চট্টগ্রাম চন্দনপুরার বাসার দোতলার একদিকে বসে ওই মানবিক ঝড় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা পেতাম এসরাজের টুংটাঙে।

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। মন হালকা হতো অনেকখানি। শেষে নিজের কিশোর পুত্র–কন্যাদের বলতাম, আমি কী বাজাচ্ছি, তা দেশের রাজারা জানে না, জানলে এখানে থাকতে পারতাম না।’

শওকত ওসমান লেখকের স্বাধীনতার সপক্ষে সব সময় ছিলেন সোচ্চার, তাই ‘ক্রীতদাসের হাসি’র তাতারী চরিত্রের মতোই ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাইয়ের দিনলিপিতে নিজের লেখা সম্পর্কে নিরাপস অবস্থান ঘোষণা করে যান, যা চিরকালের লেখক ও স্বাধীন মানুষেরই মনের কথা:
‘কিছু লেখা এক পত্রিকা থেকে ফেরত দিয়ে গেল। তারা ছাপতে অক্ষম। কেউ ছাপুক বা না ছাপুক, আমার কাজ লিখে যাওয়া। আমি লিখে যাবই। কারণ ধ্রুবসত্য মানি, সত্যের স্বর অবিনশ্বর।’

শুভ জন্মদিন, সত্যের স্বরের সন্ধানী শওকত ওসমান।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]