দুই বিশ্ববীক্ষার সংলাপ

গ্যালিলিও
গ্যালিলিও

গ্যালিলিওর জন্মের (১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দ) আধা শতক আগে নিকোলাস কোপার্নিকাস প্রথম ঘোষণা করেন, মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আছে সূর্য, পৃথিবীসুদ্ধ অন্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো নিজ নিজ কক্ষপথ ধরে ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রায় আধা শতক ধরে এই তত্ত্বে তেমন কেউ ভ্রুক্ষেপ করেনি। কারণ, কোপার্নিকাস যখন এই কথা বলেন, তখন সবাই বিশ্বাস করত; বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে আছে পৃথিবী এবং এই পৃথিবী স্থির। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র—সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে এই স্থির পৃথিবীকেই কেন্দ্র করে। এই ধারণার পক্ষে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যিশু-পূর্ব গ্রিক মনীষী অ্যারিস্টটল। এর প্রতি প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে ‘বৈজ্ঞানিক’ সমর্থন জুগিয়ে এসেছেন খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের গ্রিক-রোমান জ্যোতির্বিদ, গণিতজ্ঞ ও ভূগোলবিদ ক্লডিয়াস টলেমি।

পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন স্বয়ং ঈশ্বর; মানুষকে তিনি এই জ্ঞান দান করেছেন নিজের বাণীর মারফতে। স্থির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের এই ধারণার প্রধান প্রতিপালক ছিল ক্যাথলিক গির্জা। গির্জার পক্ষে ছিলেন রোমের শাসক। গ্যালিলিও ছিলেন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্ক ও মন ছিল এমন কৌতূহলী ও পর্যবেক্ষণশীল যে ঈশ্বরের বাণী হিসেবে প্রচারিত সব কথার প্রচলিত ব্যাখ্যা অন্ধের মতো বিশ্বাস করা ছিল তাঁর পক্ষে অসম্ভব। বিজ্ঞান ও অধিবিদ্যার জগতে গির্জার কাঠপুরোহিত ও বিদ্যাপীঠের ততোধিক কাঠপণ্ডিতদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই তাঁর মনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা জেগেছে খুব অল্প বয়সে। পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যার জনক বলা হয় গ্যালিলিওকে। ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে টেলিস্কোপ আবিষ্কার করার পর মহাকাশ পর্যবেক্ষণে বৈপ্লবিক গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। নিজের বাগানে টেলিস্কোপ বসিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন ছায়াপথ, চন্দ্রপৃষ্ঠের পাহাড় ও উপত্যকা, বৃহস্পতি গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণমাণ চারটি চাঁদ এবং আরও অনেক কিছু, যা তাঁর আগে কেউ কখনো পর্যবেক্ষণ করেননি। অতঃপর গ্যালিলিও নিশ্চিত উপসংহারে পৌঁছান যে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক ব্যবস্থার তত্ত্বটিই সঠিক।


কিন্তু এহেন কথা সেই সময় প্রচার করা ছিল ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার শামিল। এ ধরনের কিছু লেখালেখি করে গ্যালিলিও ইতিমধ্যেই সমালোচনার শিকার হয়েছেন। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে ‘লেটারস অন দ্য সোলার স্পটস’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করার পর তাঁর বিরুদ্ধে গির্জার পুরোহিত ও বিদ্যাপীঠের পণ্ডিতদের প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হয়। তিনি সেসব আক্রমণের কিছু জবাবও দিয়েছেন। কখনো তিনি বলেছেন, পুরোহিত ও পণ্ডিতেরা বাইবেলের সব কথার মানে করেন আক্ষরিকভাবে, নিহিত অর্থ বা রূপক অর্থ বোঝার চেষ্টা করেন না। কিন্তু তর্ক-বিতর্কের ফল গ্যালিলিওর জন্য প্রীতিকর হয়নি। কারণ, প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে অভিনব ধারণার প্রবর্তনকে ঘিরে তর্ক-বির্তক কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফ্লোরেন্সের পুরোহিত-পণ্ডিতেরা প্রচার করতে শুরু করেন যে গ্যালিলিও পবিত্র বাইবেলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এক পণ্ডিত তো রোমের শাসকের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করে বসেন। গ্যালিলিওকে শাসকের ভর্ৎসনা ও তিরস্কার শুনতে হয়।

ডায়ালগ কনসার্নিং টু চিফ ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস বইয়ের প্রচ্ছদ
ডায়ালগ কনসার্নিং টু চিফ ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস বইয়ের প্রচ্ছদ

প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস থেকে ভিন্ন রকমের চিন্তা করার দায়ে গিওর্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারার নৃশংস ঘটনাটি যে সময় ঘটে (১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ), গ্যালিলিওর বয়স তখন ৩৬। তিনি এমন বিপ্লবী ছিলেন না যে বিজ্ঞানের জন্য প্রাণটা অকাতরে দিয়ে দেবেন। বরং প্রবল আক্রমণের মুখে একটা পর্যায়ে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের সমর্থনে লেখালেখি তিনি বন্ধই করে দিয়েছিলেন। তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় ১৬২৪ সালে, যখন পোপ অষ্টম উরবান জানান, গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের তত্ত্ব আলোচনা করতে পারেন, তবে সেই তত্ত্ব অভ্রান্তরূপে সত্য, এমন দাবি করা চলবে না। গ্যালিলিও সে বছরই কাজ শুরু করেন তাঁর প্রধান গ্রন্থটি নিয়ে। ইতালীয় ভাষায় লেখা গ্রন্থটির নাম ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে ডায়ালগ কনসার্নিং টু চিফ ওয়ার্ল্ড সিস্টেমস। ভ্যাটিকানের শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন পাওয়ার পর বইটি ছাপা হয় ১৬৩২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু পুরোহিত-পণ্ডিতেরা সঙ্গে সঙ্গে প্রবল আপত্তি তুলে হইচই শুরু করলে জুন মাসেই পোপের নির্দেশে বইটির বিপণন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পোপ গ্রন্থটির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার জন্য একটা বিশেষ কমিশন গঠন করেন। সেই কমিশন গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিলে পোপ মামলাটি পাঠিয়ে দেন রোমান ইনকুইজিশন বা ক্যাথলিক গির্জার বিচারালয়ে। গ্যালিলিওকে তলব করা হয় রোমে; গ্যালিলিও মামলাটি ফ্লোরেন্সে হস্তান্তরের জন্য আবেদন করেন। আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তিনজন চিকিৎসক প্রত্যয়নপত্র দেন, গ্যালিলিও এমন অসুস্থ যে তাঁর পক্ষে ফ্লোরেন্স থেকে রোম যাওয়ার ধকল প্রাণঘাতী হতে পারে। কিন্তু সেটাও খারিজ করে দিয়ে বলা হয়, গ্যালিলিও স্বেচ্ছায় রোম না গেলে তাঁকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে।

অবশেষে ১৬৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্যালিলিও রোম যেতে বাধ্য হন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, বিচারালয়ের ভবনেরই একটা কক্ষে তাঁকে বন্দী করে রাখা হয় দুই সপ্তাহ ধরে। গুরুতর শাস্তির আশঙ্কার কথা জানানো হয় তাঁকে। তিনি সেটা এড়ানোর লক্ষ্যে দোষ স্বীকার করে জানান, বইটিতে কোপার্নিকাসের তত্ত্বের পক্ষে সমর্থনটা একটু বেশি প্রবল হয়েছে। তিনি এটা খণ্ডন করে আরেকটি বই লিখবেন। তবু তাঁকে অনির্দিষ্টকাল ধরে কারাগারে আটকে রাখার রায় দেওয়া হয়। জুন মাসে তিনি লিখিতভাবে গ্রন্থটি প্রত্যাহার করে নিলে তাঁকে কারাদণ্ডের বদলে এক পুরোহিতের বাড়িতে গৃহবন্দী হিসেবে বাস করার অনুমতি দেওয়া হয়। ছয় মাস পর ডিসেম্বরে তাঁকে ফ্লোরেন্সে নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তবে নিজ গৃহেও তাঁর মর্যাদা হয় গৃহবন্দীর। গ্যালিলিও তারপর বেঁচে ছিলেন আট বছর। ১৬৪১ সালে মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তিনি সম্পূর্ণভাবে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

শেষ খবর হলো, কোপার্নিকাসের তত্ত্বের সমর্থনে গ্যালিলিওর তত্ত্বটি সঠিক—এটা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে ক্যাথলিক গির্জা। কবে? গ্যালিলিওর মৃত্যুর ৩৫১ বছর পর, ১৯৯২ সালে! কিন্তু গির্জার এই বিলম্বিত জ্ঞানোদয়ে বিজ্ঞানের বা মানবসভ্যতার কিছু কি এসে-যায়?

;mso-bi�p!ag7o@�m। ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা প্রায় এক লাখ।

পৌরাণিক যুগে ফেরার এই প্রয়াস নিয়ে যে যা-ই বলুক, মাউন্ট অলিম্পাসে প্রতিবছর নিয়মিত আয়োজিত হয় প্রমিথিয়া উৎসব। সেখানে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের পর চাঁদের আলোয় সমবেত নৃত্য আর আনন্দ-উদ্যাপনের একটা আলাদা আবেদন তো অবশ্যই আছে।

সূত্র: বিবিসি অনলাইন