ধর্ষণের লজ্জা মোটেই আমার নয়

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

‘ইতিহাসের সমস্ত কলঙ্কের মধ্য থেকে
আমি উঠে আসি
আমি উঠে আসি যন্ত্রণাময় অতীত থেকে
আমি উঠে দাঁড়াই
আমি এক কৃষ্ণসাগর, লাফিয়ে চলা, বিস্তৃত পেছনে ফেলে আসছি
আতঙ্ক আর ভয়ের রাত্রিগুলো’ (মায়া এঞ্জেলো, ভাষান্তর: অনিন্দিতা গুপ্ত রায়)
মাত্র আট বছর বয়সে মায়ের প্রেমিক কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়ে সব ক্ষোভ সংহত করে অগ্নিশলাকা হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন কবি মায়া এঞ্জেলো। তাঁর ক্ষোভ প্রাণ পেয়েছে শতধায় পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তিতে, কাব্যে, ভাষায়, শব্দে উপমায়
গ্রামের মাতবরদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে দুর্ধর্ষ ত্রাস দস্যু ফুলন দেবী বুঝি একজনই—জাগতিক ইতিহাসের মধ্যে জ্বলজ্বল করেন তাঁর সব ‘কুখ্যাতি’ বা ‘সুখ্যাতি’ নিয়ে।
কিন্তু এই আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে ওঠা সমস্ত নারীর অন্তর্গত শক্তি নয়, সবাই পারে না। বরং অধিকাংশই মুখ লুকায় লজ্জা কিংবা গ্লানির দহনে। আত্মগোপন করে সমাজ-সংসার থেকে, কখনোবা জীবন থেকেই।

যে লজ্জা, যে গ্লানি তাঁকে পৌঁছে দেয় অমূল্য জীবনের অর্থহীনতার উপলব্ধিতে, এ গ্লানি ও লজ্জা কি তাঁর?
এই একটি প্রশ্নই সব সভ্যতার অর্জন মিথ্যা করে দিতে পারে। অগ্রগতির উন্নত গ্রীবা নত করে দিয়ে এই প্রশ্ন তোমাকে কি লজ্জিত করে না, মানুষ? তুমি কি অথই গ্লানিতে ডুবে কুড়াও না জীবনের অর্থহীনতা? সভ্যতার বড়াই করে তুমি কিনা প্রবৃত্তির নখরে রক্তাক্ত করো যাবতীয় অর্জন!
কেন এই প্রবৃত্তির অদম্য অসভ্যতা? তা কি কেবলই ব্যক্তিপুরুষের বিচ্ছিন্ন জৈবিক অবনমন? এ কি নারীর তথাকথিত বিপথগামিতার অবশ্যম্ভাবিতা! এ কি সামাজিক অবক্ষয়, রাজনীতি আর ধর্মের উদ্ধত আস্ফালনের বিষফল, ব্যর্থ শিক্ষার দায়? বিচারহীন কিংবা বিচারের দীর্ঘসূত্রতার ফাঁক গলে বেড়ে ওঠা বিষবৃক্ষ?
কী করে সমাজ মুক্তি পাবে, এই অক্টোপাসের বিষাক্ত পায়ের শৃঙ্খল থেকে?
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, নিজের জীবনের সাধ-আহ্লাদগুলো বিসর্জন দিয়েছি নিষেধের যূপকাষ্ঠে। এই তো মাত্র কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেও আমি ভাবতাম, নিজের অবরুদ্ধতার শিকল আমি লাগাব না আত্মজার পায়ে। তাকে সাইকেল কিনে দিলাম, সাঁতার শিখতে নিয়ে গেলাম, তখনো তার গা থেকে যায়নি বালিকার গন্ধ। দুয়েকটা বছর মাত্র। এরপর আমি বিস্মিত-আহত হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক অনস্বীকার্য প্রথাবদ্ধতায়, অসহায় ও অক্ষম হয়ে উঠলাম যেন। মেয়ের গায়ে কিশোরীর আঁচ লাগতেই চারপাশ থেকে অর্জুনের বাণের মতো আমাকে বিদ্ধ করতে লাগল পড়শিদের সমালোচনা আর বখাটেদের উৎপাত তো ছিলই। স্বভাবতই তজ্জাত উৎকণ্ঠা-আতঙ্ক পিছু পিছু এল। মেয়েকে বন্দী করলাম ঘরে। আজীবন নিজের লালিত স্বপ্ন আত্মজার মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম। অথচ শুরুতেই পিছু হটে, আত্মসমর্পণে আমি ক্ষতবিক্ষত নিজের কাছে, আর আত্মজা আহত, আশাহত ও বিক্ষুব্ধ।

এই দহন আমার, পরাজয়ও আমার। আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যখন আমরা নারীরা—সুবিধাপ্রাপ্ত বা সুবিধাবঞ্চিত—কখনো কোথাও অপ্রিয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি কিংবা হইনি, সবাই অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইল পিকচার, তখন এর পক্ষে-বিপক্ষে চলছে তুমুল তর্ক, কেন ভিকটিমই লুকাল মুখ আঁধারের আড়ালে? অব্যাহত সহিংসতার বিপক্ষে এ কি কোনো সমাধান? মুখ লুকাবে তো অপরাধী, অন্যায়কারী। কিংবা আদৌ কি এটা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ?

খুবই ব্যক্তিগত তুচ্ছ এই বেদনা আরেকটু গভীরতর ক্ষরণ হয়ে ওঠে আমার শিক্ষকজীবনের পেশাগত অভিজ্ঞতায়। বারকয়েক এমন ঘটেছে যে আমি অক্ষম বেদনায় ছাত্রীটির মাথায় রেখেছি কেবল অসীম আশিসের হাত, আর কিছুই করতে পারিনি। একটি ঘটনা এমন: উচ্চমাধ্যমিকে একই ক্লাসে পড়ে ভাইবোন। বোনটি বেশি ভালো ছাত্রী এবং ভালো ফলের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিকভাবে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাঠানো হয় ভাইকেই।

ফলে মনে হয়, এই দহন আমার, পরাজয়ও আমার। আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যখন আমরা নারীরা—সুবিধাপ্রাপ্ত বা সুবিধাবঞ্চিত— কখনো কোথাও অপ্রিয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি কিংবা হইনি, সবাই অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইল পিকচার, তখন এর পক্ষে-বিপক্ষে চলছে তুমুল তর্ক, কেন ভিকটিমই লুকাল মুখ আঁধারের আড়ালে? অব্যাহত সহিংসতার বিপক্ষে এ কি কোনো সমাধান? মুখ লুকাবে তো অপরাধী, অন্যায়কারী। কিংবা আদৌ কি এটা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ?
কে জানে! মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার বুদ্ধির বিকাশে। বুদ্ধির বিকাশেই মানুষের সভ্যতার সৃষ্টি ও অগ্রগতি। আর মানুষের বুদ্ধিতেই এ পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হলো হাতিয়ার। হাতিয়ারের ব্যবহারে এগোল মানুষের অগ্রযাত্রা। হাতিয়ার কি কেবলই আগ্নেয়াস্ত্র? ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠের মাধ্যমে যুদ্ধ করেছেন কণ্ঠযোদ্ধারা, শিল্পীরা। এই কথা মনে রেখে এখন বলতে ইচ্ছা করে, সহস্র সীমাবদ্ধতায় নারী যদি ঘরে বসে তার সবচেয়ে সহজলভ্য হাতিয়ারটি তুলে নেয়, তবে নারী হিসেবে, মানুষ হিসেবে আমি আছি তার পাশে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের যে নারীর আর্তনাদ আমরা শুনলাম, যে আর্তনাদ আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিল, তা কেবল আমরা দেখলাম ও শুনলাম বলে। অথচ দেশের ধর্ষণের শিকার প্রত্যেক নারীর এই একই রকম আর্তনাদ ও আকুতি রয়েছে। কেবল আমরা তা শুনতে পাই না। কখনো তারা মৃত, প্রাণহীন হয়ে শুয়ে থাকে কালভার্টের নিচে, কখনো তারা নিষ্প্রাণ, পচে-গলে মিশে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।
আসুন এ মুহূর্তে নোয়াখালীর ঘটনাটাকে একটু তলিয়ে দেখি। সেখানকার সদম্ভ উল্লাসকারী ধর্ষকগুলোর বয়স কত? আঠারো থেকে ত্রিশ। পরপর দুটি প্রজন্ম। তারা কেন করেছে এই ঘৃণ্য অপরাধ? ভাবতে পারেন, নারীটির সাবেক স্বামী তাঁর ঘরে এসেছিলেন বলে তাঁকে শায়েস্তা করার ‘পবিত্র দায়িত্ব’ তারা স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছে কাঁধে।
ঘটনাটি মাসাধিককাল আগের। আক্রান্ত নারী বিচার চেয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো বিভাগের কাছে যাননি; বরং তিনি আত্মগোপন করেছেন আতঙ্কে। আর অপরাধীরা তখনো উপলব্ধি করেনি তাদের অপরাধের মাত্রা। ফলে উল্লাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের নৃশংস বর্বরতা।

আস্থাহীনতা ও আতঙ্ক কোন পর্যায়ে পৌঁছালে একজন আক্রান্ত নারী বিচার না চেয়ে আত্মগোপন করেন? মূল্যবোধের কতটা অবক্ষয় ঘটলে মাসাধিককাল পরও নির্বিকার থাকে প্রজন্ম, সদম্ভ উল্লাসে নারী নিপীড়নের এমন দুঃসহ ভিডিও ছড়িয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে?
এর সমাধান কী, কোথায় এর শেষ?

বছরের পর বছর ধরে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও রাজনীতিকে হত্যা করা হয়েছে অনেকটা সুপরিকল্পিতভাবে। শিক্ষার নামে তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে দক্ষ রোবট। শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়নি মানবিক বোধ জাগ্রত করার মতো কোনো বিষয়। রাজনৈতিক পচন সর্বগ্রাসী হয়ে গিলে খেয়েছে মানুষের আদর্শ আর নৈতিক বোধ। অর্থ, ক্ষমতা আর দাপট চিহ্নিত হয়েছে সর্বজনগ্রাহ্য সম্মান হিসেবে। রাতারাতি বিত্তের অধিকারী হওয়ার সম্মানও বেড়েছে রাতারাতি। রুদ্ধ হয়েছে প্রশ্ন করার মানসিকতা। তার বদলে অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম হয়েছে।

এসবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি বোধ হয় পড়েছে এই প্রজন্মের ওপর। অনেকে এ জন্য অভিভাবকদের অসচেতনতাকেও দায়ী করছেন।

তবে আমার মনে হয়, বছরের পর বছর ধরে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি আমাদের সামাজিক ব্যবস্থাগুলো, উপড়ে ফেলেছি অনেক মূল্যবোধ। এখন গোড়া কেটে আগায় পানি ঢাললেই কি সুফল মিলবে?

বেগমগঞ্জের ঘটনা, সিলেট এমসি কলেজের ঘটনা—সবকিছুতেই দেখা মিলছে গুন্ডাতন্ত্রের। তবে এই গুন্ডাতন্ত্র তাদের হাতে এক দিনে আসেনি, এসেছে পরম্পরা ঘুরে। হ্যাঁ, এই প্রজন্ম দেখেছে, দেখে দেখে শিখেছে ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকার অর্থ বিচার আর শাস্তির আওতামুক্ত থাকা। ক্ষমতার দাপটে অন্যায় কর্মকে হজম করা।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কেন আমাদের সম্মিলিত পাপ খালি এই কিশোরদের ওপর চাপাচ্ছি? ধর্ষণ কি কেবলই জৈবিক প্রবৃত্তি? আধিপত্যের বিকৃত মানসিকতা নয়? ধর্ষণ কি কেবলই নারীর পোশাক বা আচরণজাত প্রতিক্রিয়া?

কী হবে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিবাদে প্রোফাইল কালো করে? কী হবে মানববন্ধনে? আপাতত আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন।

কিন্তু চোখ মেলে দেখুন আপনার পাড়ায়, গলির মোড়ে এমন অনেককেই দেখতে পাবেন। দেখতে পাবেন আমার মতো আপনার মেয়েরাও নিরাপদ নয়।

আপাতভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তীব্র প্রতিক্রিয়া, সর্বমহলের আড়মোড়া ভাঙা যদি সুনির্দিষ্ট আসামিদের বিচার নিশ্চিত করে, সেটাই হবে প্রাপ্তি।
আর আমরা যারা নিজেদের সচেতন বলে দাবি করি, নিজ নিজ কন্যাদের ভেতর রোপণ করি বোধের ফলবান বৃক্ষ, সবাই যেন আশপাশের নারীদের মধ্যে জাগাতে পারি আত্মবিশ্বাস ও আত্মরক্ষার বোধ।

আর এসব ডামাডোলের অন্তরালে পড়ে থাকে যে আক্রান্ত নারী, আমরা প্রায়শই তার পরবর্তী জীবনের লড়াইয়ের খবর রাখি না। এই লেখার শেষে একটা দাবি জানাতে চাই, রাষ্ট্র নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার নারীদের দায়িত্ব নিক, যেন আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনাহূত-নিপীড়িত জীবন তাকে না কাটাতে হয়, সে যেন মাথা উঁচু করে বলতে পারে, ধর্ষণের লজ্জা মোটেই আমার নয়।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]