নজরুল-জীবনীর এক খলনায়ক

যেকোনো আখ্যানে পার্শ্বচরিত্র চিরকাল অবহেলিত, এমনকি সেটা যদি প্রকৃত জীবনকাহিনিও হয়। নজরুলের বিস্ময়কর সৃষ্টিমুখর জীবনকে ঘিরে (চলচ্ছক্তিহীন নির্বাক পর্বটুকু বাদ রেখে) অজস্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁদের কজনের কথাই–বা আজ আমরা জানি? জীবনীকারকে রচনার পরিধির কথা মনে রাখতে হয়, তাই জীবন যত বিশাল ও বিস্তৃত, জীবনী ততটা নয়। নজরুলের চারপাশের অনেক মানুষ, হয়তো গুরুত্বহীন, কিংবা হয়তো তা নয়; হারিয়ে গেছেন জীবনীকারের অলক্ষ্যে বা উপেক্ষায়।

আলী আকবর খানের সৌভাগ্য, নজরুলের অধিকাংশ জীবনীতে তাঁর স্থান হয়েছে। একই সঙ্গে দুর্ভাগ্য এই, মৃত্যুর এতকাল পরও তাঁকে বহন করতে হচ্ছে অজস্র অভিযোগের বোঝা! আলী আকবর খান আছেন, কিন্তু জীবনীকারেরা তাঁর প্রতি নিষ্করুণ! নজরুলের জীবনে নয়, জীবনীগ্রন্থের খলনায়ক হয়ে উঠেছেন এই মানুষ।

আলী আকবর খান কে? নজরুলের প্রণয়িনী ও প্রথম স্ত্রী নার্গিসের মামা। ১৯২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামের কিশোরী নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে হয়েছিল কি না, এ নিয়ে জীবনীকারেরা অবশ্য দ্বিধাবিভক্ত। তথ্যপ্রমাণ দিয়ে কেউ বলতে চান বিয়ের আসরে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েছিল এবং বাসর রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে নজরুল চলে গিয়েছিলেন। স্ত্রীকে বলেছিলেন, সপরিবার ‘শ্রাবণ মাসে’ এসে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নিয়ে যাবেন। সেটা ১৯২১ সাল। এরপর ১৭টি বছর পেরিয়ে গেছে, ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না’। জীবনীকারদের অন্য অংশ বলতে চান, বিয়েটা আদৌ হয়নি, নজরুলকে ঘরজামাই হিসেবে কুমিল্লায় থেকে যেতে হবে...ইত্যাদি কাবিননামার শর্তে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বিয়ের আসর থেকে উঠে সেই রাতেই দৌলতপুর থেকে পায়ে হেঁটে কুমিল্লা শহরে চলে গিয়েছিলেন তিনি। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক পর্যালোচনা করে, বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ের গবেষকদের মতামত আমলে নিয়ে বর্তমান লেখকও প্রথম পক্ষের অবস্থানকে যুক্তিসংগত মনে করেন। অর্থাৎ নজরুল ও নার্গিসের বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল।

যা-ই হোক, আলী আকবর খানের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। নজরুলের সঙ্গে এই ব্যক্তির যেটুকু পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল, তাতে হয়তো নজরুলের অসংখ্য বন্ধু বা গুণগ্রাহীর মতো তাঁর নামটিও বিস্মৃত হতেন জীবনীকারেরা। কিন্তু আলী আকবরকে মনে রাখতে হলো নার্গিসের মামা হিসেবে। তিনিই ছিলেন এই প্রেম ও পরিণয়ের অনুঘটক। তিনি নজরুলকে সমাদরে কুমিল্লার নিজের বাড়িতে নিয়ে না গেলে তরুণ কবির সঙ্গে পিতৃহীন গ্রাম্য কিশোরীর পরিচয় ও প্রেম হতো না, এত বড় ‘ট্র্যাজেডি’ সংঘটিত হতো না।

কেন সাদরে নজরুলকে কলকাতা থেকে নিজের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন আলী আকবর খান? নজরুলের দীর্ঘদিনের সুহৃদ ও অভিভাবক কমরেড মুজফ্ফর আহমদের মতে, নিজের স্বার্থ হাসিলের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল এই লোকের মনে। নিজে তিনি শিশুপযোগী বই লিখে প্রকাশ করতেন এবং তাঁর বড় ভাই আলী আফজাল সেগুলো ক্যানভাস করে বিক্রি করতেন প্রভৃতি তথ্যের উল্লেখ করে মুজফ্ফর আহমদ বলতে চান, নজরুল এই আলী আকবরকে ‘লিচু চোর’ নামে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন শিশুপযোগী বইয়ে প্রকাশ করার জন্য। চমত্কার পদ্যটি পড়েই নাকি আলী আকবর এই তরুণ কবির প্রতিভার প্রকৃত পরিচয় পেয়েছিলেন। তাহলে তো সত্যিকারের সমঝদার বলতে হয় খান সাহেবকে! যাহোক, মুজফ্ফর আহমদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই পদ্য ভালো লাগার পর থেকে নজরুলকে হাত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন আলী আকবর। তাঁকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর পর নজরুল এ ব্যাপারে নাকি পরামর্শও চেয়েছিলেন মুজফ্ফরের কাছে, তিনি নিষেধ করে বলেছিলেন, ‘কি মতলবে তিনি তোমায় তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান কেউ তা জানেন না। তিনি তোমাকে বিপদে ফেলতে পারেন।’ (মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, পৃ. ৫৯)।

অভিভাবকের ‘অসম্মতি’ উপেক্ষা করে আলী আকবরের সঙ্গে কুমিল্লা রওনা হয়ে গেলেন নজরুল। বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ মুজফ্ফর আহমদ লিখলেন, ‘সে যে আলী আকবরের ফাঁদে পড়বে একথা আমি বুঝেছিলেম। তবুও তার অমঙ্গলের কথা ভেবে আমার মন-খারাপ হয়ে গেল।...আলী আকবরের সবকিছু ছিল সুপরিকল্পিত। লাভ-লোকসানের হিসাব খতিয়ে দেখে তিনি কাজে এগুচ্ছিলেন। “লিচু চোর” কবিতাটি নজরুলের কাল হয়েছিল। এই থেকেই খান সাহেব বুঝে নিয়েছিলেন যে সে তাঁর পরিকল্পনার সঙ্গে চমত্কার খাপ খেয়ে যাবে। “লিচু চোর” তাঁকে বুঝিয়ে দিল যে কবি শিশুদের মন বোঝে। অতএব শিশু কবিতার রাজ্যে জয়জয়কার হবে ভাবী প্রকাশক আলী আকবর খানের। যে শিশুদের জন্য কবিতা লিখতে পারে সে গদ্যে তাদের জন্য বইও লিখতে পারবে। যেমন করেই হোক কবিকে নিজের মুঠোর ভিতরে নিয়ে আসাই ছিল আলী আকবর খানের পরিকল্পনা।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ৬০)।

মুজফ্ফর আহমদের এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ই পরবর্তীকালের অধিকাংশ নজরুল জীবনীকারের বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে এবং তাঁরাও এই পথেই এগিয়েছেন। অর্থাৎ ‘লিচু চোর’ কবিতা পড়ে মুগ্ধ আলী আকবর নজরুলকে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, যাতে সেই বাড়িতে গিয়ে নজরুল তাঁর ভাগনি সৈয়দা আসার খানমের (নজরুলের দেওয়া নাম নার্গিস) প্রেমে পড়েন এবং বিয়ে করেন। অতঃপর নজরুলকে হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রকাশক হিসেবে আলী আকবর অর্থে-বিত্তে ফুলেফেঁপে উঠবেন!

একজন বন্ধুস্থানীয় কবিকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কেউ একজনের এত নিখুঁত একটি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের ‘তত্ত্ব’টি একটু কষ্টকল্পিত বলে মনে হয় না? মুজফ্ফরের এই তত্ত্ব যাঁরা পরবর্তীকালে অনুমোদন করে গেলেন এবং একই বয়ানের পুনরাবৃত্তি করলেন, তাঁদের মনে দু-একটি সাধারণ প্রশ্ন এল না কেন ভেবে অবাক হই। যেমন মুজফ্ফর আহমদের লেখা থেকেই আমরা জেনেছি, কলকাতার ৩২, কলেজ স্ট্রিটে থাকার সময় আলী আকবর খান বিশ্রী একটা রোগ বাধিয়েছিলেন (রোগের নাম উল্লেখ করা হয়নি)। তখন নজরুল নিয়মিত এই লোকের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন বলেও উল্লেখ আছে তাঁর বইতে। তাহলে রোগমুক্তির পর কৃতজ্ঞ ব্যক্তিটি কবি-বন্ধুকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতে পারেন না?

দ্বিতীয়ত, নজরুলকে দিয়ে বই লিখিয়ে নিয়ে প্রকাশক হিসেবে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবানুগ? নজরুল পরবর্তীকালে দেশজুড়ে যখন খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পান, তখনো কি বাজারে তাঁর বইয়ের এমন চাহিদা ছিল যে প্রকাশকেরা তাঁর বই ছেপে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন? তাহলে কেন নজরুলকে অল্প কিছু টাকাপয়সার জন্য প্রকাশকদের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিতে হতো, কেন নামমাত্র মূল্যে কবিতার বইয়ের স্বত্ব পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়েছিল তাঁকে? গ্রামোফোন কোম্পানির চাকরিতে থাকাকালীন কয়েক বছর অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখলেও (এ সময় তিনি একটি গাড়িও কিনেছিলেন), জীবনে বেশির ভাগ সময় তাঁর কেটেছে অর্থকষ্টেই। সুতরাং একজন কবিকে ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’ মনে করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ একালে যেমন নেই, সেকালেও ছিল না, তা তিনি যতই বিপুল জনসমাদৃত কাজী নজরুল ইসলাম হোন না কেন।

আসলে যে আলী আকবর খানকে নজরুল-জীবনীকারেরা চিত্রিত করেছেন, তাঁদের সবারই প্রধান ও একমাত্র সূত্র ছিলেন মুজফ্ফর আহমদ। তাঁর বিবৃত তথ্য বিশ্বস্ত মনে করার কারণও আছে। ব্যক্তিজীবনে সৎ ও সজ্জন মানুষ হিসেবে একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ছিল তাঁর, ভারতবর্ষে সাম্যবাদী রাজনীতির প্রবক্তাদের একজন ছিলেন তিনি।

কিন্তু কথা হচ্ছে, এই সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কি কারও প্রতি ব্যক্তিগত রাগ-বিদ্বেষ থাকতে পারে না? সেই রাগ ও বিরূপ মনোভাব থেকে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি যা বলবেন তা-ই গ্রহণ করতে হবে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে? তৃণমূলের কয়েকজন প্রায়-অখ্যাত লেখক ছাড়া অধিকাংশ জীবনীকারেরা তা-ই করেছেন।

মুজফ্ফর কেন শুরু থেকেই আলী আকবরকে অপছন্দ করতেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উদ্​ঘাটন সম্ভব হয়নি। কিন্তু অপছন্দ যে করতেন, তার অজস্র দৃষ্টান্ত ছড়ানো তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে:

‘পরীক্ষা দিতে গিয়ে ঢাকায় কলেজে পড়ুয়া অনেক ছাত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আলী আকবর খানের সঙ্গে তখন আমার পরিচয় হয়েছিল।...পরীক্ষা দিতে গিয়ে যে-পরিচয় ঢাকার কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে আমার হয়েছিল তা ছিল প্রায় ট্রেনের কামরার যাত্রী আর যাত্রীতে পরিচয়ের মতো। গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর পরেই অধিকাংশ যাত্রী একে অন্যকে ভুলে যান। আমার কিন্তু আলী আকবর খানের নামটি মনে ছিল। কারণ, তার স্বভাবে বড় কৃত্রিমতা ও নাটকীয়ভাব ছিল। তার ওপরে তিনি ইউরোপীয় পোশাক পরতেন এবং ইংরেজীতে ছাড়া কথা বলতেন না।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৬) অর্থাৎ শুরু থেকেই ‘কৃত্রিম ও নাটকীয়ভাব’, ‘ইউরোপীয় পোশাক পরা’, ‘ইংরেজীতে কথা বলা’ ইত্যাদি কারণে আলী আকবর খানকে অপছন্দ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁকে মনেও রেখেছিলেন। তার মানে, দশজনের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না আলী আকবর। এরপর আরও প্রায় ছয় বছর পর দেখা হলো দুজনের। প্রথমে মুজফ্​ফর চিনতে পারেননি, কিন্তু চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। ‘তিনি খোলস বদলে ফেলেছিলেন। এবারে তিনি ধুতি ও খাকি শার্ট পরেছিলেন, কথাও বলেছিলেন বাংলায়।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৭)।

কথা হচ্ছে ইংরেজি স্কুল থেকে পাস করে আসা ঢাকা কলেজের ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র, বিত্তবান খানদানি পরিবারের তরুণ যদি কেতাদুরস্ত পোশাক পরেন এবং ইংরেজিতে কথা বলেন, সেটা মুজফ্ফরের রুচি-সংস্কৃতির সঙ্গে না মিলতে পারে, কিন্তু অপরাধ বলে তো গণ্য হতে পারে না। পরে কিছুটা পরিণত বয়সে সেই ব্যক্তিটিই যদি ধুতি ও শার্ট পরেন, তাহলে সেটা ‘খোলস বদল’ হবে কেন? পোশাক পরিবর্তনকে ‘খোলস বদল’ বলে শনাক্ত করার মধ্যেই তো মুজফ্ফরের মনোভাব প্রকাশ পায়। এখানে কোথাও অপছন্দের (হয়তো ঈর্ষারও) ব্যাপার ছিল।

আলী আকবর খানের ওপর মুজফ্ফর সবচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন নজরুলকে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়ায়। নজরুলকে যেতে মানা করেছিলেন, কিন্তু নজরুল শোনেননি, ‘অভিভাবক’ হিসেবে এই ব্যাপারেও অপমানিত হয়েছিলেন তিনি। এর দায়ও চেপেছিল ‘নন্দ ঘোষে’র ওপর।

মুজফ্ফর নজরুলের ওপর একটা অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চিরকাল করে গেছেন। শুধু ‘সাম্যবাদ্যের গান’ রচনা নয়, এই কবি যাতে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতেও তাঁর অনুগামী হন, সেই চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু রাজনীতির নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা পড়ার মানুষ তো নজরুল নন। উপরন্তু কুমিল্লায় গিয়ে দৌলতপুর গ্রামের এক কিশোরীকে ভালোবেসে ফেলার মতো একটি ‘হঠকারী’ কাজকে কিছুতেই সমর্থন করতে পারেননি মুজফ্ফর। এর জন্য বাইশ বছরের যুবকটিরও বিশেষ অপরাধ খুঁজে পেলেন না, সব দোষ খান সাহেবের। কারণ, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ অনুযায়ী তিনি আগেই তো সব পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন!

আলী আকবর খানকে নজরুল-জীবনীর (জীবনের নয়) খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করতে হলে অবশ্যই মুজফ্​ফর আহমদের নামই আসবে। কিন্তু পরবর্তীকালে যাঁরা নির্বিচারে তাঁর বক্তব্য গ্রহণ করেছেন, তাঁদের দায়ও কম কিছু নয়। কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে আলী আকবরের চরিত্রে আরও কতটা কালি মাখিয়ে দেওয়া যায়, তার চেষ্টাও করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের লেখক ও সাংবাদিক জিয়াদ আলীর (মুজফ্ফর আহমদের একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুসারী। মুজফ্ফর আহমদ: জীবন ও সাহিত্য নামে বইও আছে তাঁর লেখা) গ্রন্থে পাই, ‘আরও এক গোপন অভিসন্ধি ছিল আলী আকবর খানের। নজরুল লজ্জায় সে কথা সকলকে বলতে পারেননি। তাঁর রুচিতে বেধেছিল। তবে ঠাট্টা-মস্করার বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে কিছুটা আঁচ দিয়েছিলেন কলকাতায় ফিরে। নিজের প্রেমিকা অন্যের কাছে অশ্লীলভাবে আদর খাচ্ছে দেখলে কোন প্রেমিকের মাথা ঠিক থাকে!’ (নজরুল: অজানা কথা, পৃ. ১১১)। এ ধরনের কথা বলতে নজরুলের ‘রুচিতে বেধেছিল’, কিন্তু জিয়াদ আলীর রুচিতে বাধেনি, কারণ, আলী আকবর ও নার্গিসকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করার বিরাট ‘দায়িত্ব’ অর্পিত হয়েছিল তাঁর কাঁধে।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একই কথা বারবার বলতে থাকলে তার প্রভাব গবেষক ও জীবনীকারদের ওপর পড়তে পারে। নইলে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের মতো সর্বজনমান্য লেখক ও গবেষক দীর্ঘ জীবন নজরুল বিষয়ে লেখালেখির পরও কী করে ভুল তথ্যের ফাঁদে পড়েন! নার্গিসের চিঠির উত্তরে লেখা নজরুলের চিঠি উদ্ধৃত করে অধ্যাপক ইসলাম তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘উদ্ধৃত অংশের একটি বাক্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সে হল “তোমাদেরই ঢাকার কুকুর একবার কামড়েছিল আমার অসাবধানতায়” নজরুল কার প্রতি এ ইঙ্গিত করেছেন বুঝতে অসুবিধা হয় না। বস্তুত নার্গিসের প্রতি নজরুলের কোন অভিযোগ না থাকলেও আলী আকবর খানের প্রতি তার মনোভাব যে দৌলতপুর ঘটনার পনের বছর পরেও পরিবর্তিত হয়নি তা বোঝা যায়।’ (কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃজন, পৃ. ৯১)। অথচ এই ‘ঢাকার কুকুর’ ব্যাপারটির সঙ্গে আলী আকবর খানের সুদূর সম্পর্কও নেই। মূল ঘটনা হচ্ছে, ঢাকার বনগ্রামের রানু সোমকে (প্রতিভা বসু) গান শিখিয়ে তাঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর পথে নজরুলকে রাতের অন্ধকারে একদল যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করেছিল। নজরুলের চিঠিতে তাদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। লেখকের অবচেতনে আলী আকবর খানের নেতিবাচক ভাবমূর্তি ছিল বলেই এ রকম তথ্যবিভ্রান্তি ঘটেছে বলে আমাদের ধারণা।

মুজফ্ফর আহমদের বইতেই উল্লেখ আছে, ‘আলী আকবর খান কুমিল্লা জিলা স্কুলে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের সহপাঠী ছিলেন। এই সূত্রে বীরেন্দ্রকুমার সেনের সঙ্গে তাঁদের বাসায় যাতায়াত করার ভেতর দিয়ে বীরেন্দ্রকুমারের মাতা শ্রীযুক্তা বিরজাসুন্দরী দেবীর স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের সঙ্গে সঙ্গে আলী আকবরও তাঁকে মা ডাকতেন।...বীরেন সেনের বোনেরা আলী আকবর খানকে ‘আলী-দা’ ডাকত’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ৬০)। একটি বিধর্মী সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে (মুজফ্ফর আহমদ নিজে এই পরিবারের মর্যাদা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন) দীর্ঘকাল ধরে যাঁর এ রকম গ্রহণযোগ্যতা, তাঁর চরিত্রকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার আগে অন্তত দুবার তো চিন্তা করা দরকার। জীবনীকারেরা কেউ এসব দিকে নজর দিলেন না!

আলী আকবর খান ছিলেন নজরুলের কাব্য-প্রতিভার সমঝদার, একজন ভক্ত-অনুরাগী। ৩২, কলেজ স্ট্রিটের বাড়িটিতে দুঃসময়ে অনুজপ্রতিম সাহচর্য ও সেবা পেয়ে ভালোবেসে ফেলেছিলেন তাঁকে। নিজে তিনি শিক্ষিত, সে আমলের গ্র্যাজুয়েট। নজরুল তাঁর ভাগনি নার্গিসকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইলে পরিবারের অন্যদের আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি সানন্দে রাজি হয়েছিলেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘অপরাধ’। বিবাহ আসরে যেকোনো কারণেই হোক (অনেকে বলেন ঘরজামাই করার প্রস্তাব, অনেকে বলেন, কাবিননামার ২৫ হাজার টাকার শর্ত, অনেকে বলেন সেনগুপ্ত পরিবারের প্ররোচনা) অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। সেই সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি। পিতৃহীন ভাগনির এই পরিণতির জন্য কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি আলী আকবর। নার্গিসকে ঢাকায় এনে স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করিয়েছেন তিনি। তখনকার দিনের হিসেবে কিছুটা বেশি বয়সে আজিজুল হাকিম নামের একজন কবির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের যাবতীয় সহায়-সম্পত্তি নার্গিসের নামে লিখে দিয়েছিলেন এই অকৃতদার ব্যক্তিটি। কিন্তু ইতিহাস এই ট্র্যাজিক চরিত্রের প্রতি চিরকাল অবিচার করেছে। ভবিষ্যতে কি কোনো তরুণ গবেষক প্রকৃত সত্যের সন্ধান করবেন? কাজটা কঠিন। অনেক বইয়ের ধুলো ঝাড়তে হবে, তদুপরি কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রাম থেকে ঢাকার কলতা বাজার এবং কলকাতার কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত অনেকটা পথ হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে তাঁকে।