নজরুলচেতনায় দুর্গোৎসব

সাম্যবাদী নজরুলপ্রথম আলো

নজরুলের কবিতায় যেমন ছিল সাম্যবাদের সুর, তেমনি ছিল বিপ্লবের রণহুঙ্কার। তাঁর কবিতার দুর্গা আর দেবী দুর্গার মধ্যে দৃশ্যমান মিল যেমন ছিল, তেমনি ছিল গভীর তাৎপর্য। নজরুলের দুর্গার হাতে খড়্গ উঠেছিল অসুররূপী ঔপনিবেশিক শাসনকে ভূলুণ্ঠিত করার মানসেই।

বাঙালি সংস্কৃতির গ্রহণ ও আত্মীকরণের ক্ষমতা অসামান্য। বাইরের ভাষার বহু শব্দ ও সাংস্কৃতিক উপকরণ বাঙালি সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে। উত্তর ভারতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণ থেকে রাম-সীতা, রাধাকৃষ্ণের মতো চরিত্র মিশে গেছে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। আরব-পারস্যের কাহিনি ঐতিহ্যও সমাদৃত হয়েছে দোভাষী পুঁথিতে, যা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ বাঙালি সংস্কৃতিতে মর্যাদা পেয়েছে ঘরের মানুষের মতো।

বাঙালি সংস্কৃতির এই আত্মীকরণের গুণটি নজরুল সাহিত্যে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, সেভাবে আর কারও সাহিত্যে হয়নি। অসাধারণ নৈপুণ্যে তিনি আরবি-ফারসি শব্দের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর লেখায়। বাঙালির চিরকালীন সমন্বিত ঐতিহ্যকে নজরুল যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে ধারণ করেছিলেন, এখানেই নজরুল অদ্বিতীয়। তাঁর কবিতায় হিন্দু পুরাণ ও ইসলামি ঐতিহ্য সমান নৈপুণ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। হামদ-নাত, ইসলামি গান ও শ্যামাসংগীত-বৈষ্ণব পদ রচনায় যে বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর নজরুল রেখেছেন, তা নজিরবিহীন। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে শারদীয় দুর্গোৎসব একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। এ ক্ষেত্রেও নজরুলের কবিতা অদ্বিতীয়।

দুর্গাকে কেন্দ্র করে লেখা নজরুলের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘আগমনী’। কবিতাটি ১৩২৭ সালের আষাঢ় সংখ্যায় উপাসনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরে সংকলিত হয় কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণায়। কবিতাটি জুড়ে যুদ্ধের আমেজ ও দানব শক্তিকে পরাজিত করার সংকল্প: ‘আজ রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্‌ মহারণ/ দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!/ পদতলে লুটে মহিষাসুর,/ মহামাতা ওই সিংহ–বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে—/ শাশ্বত নহে দানব–শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!’

দুর্গার আগমন এভাবে নজরুলের হাতে এক নতুন প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে। অসুর–বধের কালে দুর্গার যে তেজোদ্দীপ্ত রূপ দেখা যায়, নজরুলের এই কবিতায় দুর্গার সেই রূপই এক নতুন কালে নতুন প্রয়োজনে পুনর্নির্মিত হয়েছে। তাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আছে। ঘোষিত হয়েছে ন্যায়ের জয়।

কবিতাটি রূপক। কবিতায় ন্যায়যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের লাল চিহ্নবাহী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন নজরুল। যা আমাদের রুশ বিপ্লবের লালফৌজকেই মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে অসুর হিসেবে ব্রিটিশদের চিহ্নিত করেছেন। তবে এর বদলে ‘সুর’ চাননি, চেয়েছেন মানুষ। এভাবে ‘আগমনী’ হয়ে উঠেছে সে যুগের বাস্তব লড়াইয়ের প্রেরণা।

অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হওয়ার আগে ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ প্রকাশিত হয়েছিল ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যায়। এ কবিতায়ও কবি দেবীর বিধ্বংসী চণ্ডীরূপের ভজনা করেছেন। মায়ের শ্বেতশুভ্র রূপ যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, যুগের প্রয়োজনে তাঁর রক্তমাখা রূপই নজরুলের কাম্য। বাস্তবের নিরিখেই কবির এ আহ্বান—‘শ্বেত শতদল–বাসিনী নয় আজ/ রক্তাম্বরধারিণী মা,/ ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর/ সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।’

কবিতার মূল রূপকল্পটি সাজানো হয়েছে পৌরাণিক ঘটনার প্রত্যক্ষ ছায়ায়। পৌরাণিক কালে দেবী তাঁর মোহিনী রূপ পরিহার করেছিলেন পৃথিবীর মানুষের স্বার্থে। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল অসুর, দানব বা মহিষাসুর। তখন তাঁকে মোহিনী রূপ ত্যাগ না করে উপায় ছিল না। তাঁর শ্বেতবসন রঞ্জিত করতে হয়েছিল রক্তরঙের ধারায়। নজরুল পরাধীন ভারতে সেই একই দানবের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। সে জন্য দেবীর আগমন কিছুতেই সাধারণ রূপে হতে পারে না। যুগের দাবি মেটাতেই তাঁকে পরতে হবে রক্তাম্বর। অত্যাচারীকে ধ্বংস করে ন্যায়পরায়ণ পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হবে দেবীর হাতে।

ধূমকেতু পত্রিকার দ্বাদশ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। এ কবিতা বিখ্যাত হয়ে আছে কবির কারাবরণের কারণ হিসেবে। ধূমকেতু পত্রিকার প্রতিবাদী চরিত্র ও আনন্দময়ীর আগমনে কবিতার বৈপ্লবিক সুর একসূত্রে গাথা। ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত ভাতরবর্ষে নিপীড়িত, রক্তাক্ত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে এ কবিতা।

কবিতাটির তিনটি স্তর। এক স্তরে পৌরাণিক দেখা যায়, দেবী দুর্গা অত্যাচারীর হন্তারক হিসেবে যেভাবে বন্দিত হন, তার নিপুণ বিন্যাস। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে সমকালীন ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর চরিত্র, কর্মসূচি, নিপীড়ন ইত্যাদির বিবরণ। তৃতীয় স্তরে দেবীর আবাহন। তিনটি স্তর আলাদা নয়, বরং পরস্পর বুননের মধ্য দিয়ে কবিতার চিত্রটি ফুটে উঠেছে। সামগ্রিক একটি উদাহরণ দেওয়া যাক—‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি–আড়াল?/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/ দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি।/ ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’

এই পঙ্‌ক্তিগুলোতে কবিতার তিনটি স্তর একাকার হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্গার অস্তিত্ব মাটির মূর্তিতে নয়; বরং পৌরাণিক সময়ের বিভিন্ন পর্বে অসুরবিনাশী হিসেবে তাঁর যে ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতেই তাঁর অস্তিত্বের প্রকাশ। অন্যদিকে কবির স্বদেশভূমি যদি স্বর্গ হয় আর স্বর্গ দখলকারী ব্রিটিশ শাসন শক্তি যদি দানব হয়, তাহলে নতুন যুগের এ দানবদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য দুর্গার আগমন জরুরি। কবি দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ শাসন মানে দানব শাসন। কয়েদখানা ভর্তি হচ্ছে নিরপরাধ মানুষে। বিনা বিচারে নির্বাসন আর ফাঁসি দেওয়া হয়ে উঠেছে নৈমিত্তিক ঘটনা। দুর্গার বিধ্বংসী রূপ অত্যাচারী ইংরেজ সরকারকে ভীত করেছিল, নিপীড়িত মানুষদের জন্য আশ্বাসের কারণ হয়েছিল এবং বিপ্লবী-বিদ্রোহীদের বয়ে এনেছিল জন্য অফুরন্ত প্রেরণা।

নজরুল শুধু অসুরবিনাশী দুর্গার আগমন প্রত্যাশা করেননি, দেশপ্রেমিক বীরদের আত্মাহুতিকে দুর্গা আরাধনার অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দেশজননীর বীর সন্তানদের আত্মবলিদানকে নজরুল দশভুজা আরাধনার অঙ্গরূপেই দেখেছেন। রাবণকে বধ করার জন্য রাম দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন, যেটি অকালবোধন নামে খ্যাত। দেবীকে তুষ্ট করতে তিনি নিজের চোখ উৎপাটন করতে উদ্যত হয়েছিলেন। সেই ঘটনা স্মরণ করে ‘ইন্দ্রপতন’ কবিতায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুকে নজরুল বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘অসুর-নাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্বোধনে/ আঁখি উপাড়িতে গেছিলেন রাম, আজিকে পড়িছে মনে,/ রাজর্ষি! আজি জীবন উপাড়ি দিলে অঞ্জলি তুমি,/ দনুজ-দলনী জাগে কিনা−আছে চাহিয়া ভারত-ভূমি।’

প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থে ‘যতীন দাস’ কবিতায় একই সুর দেখতে পাই—‘মহিষ-অসুর-মর্দিনী মা গো,/ জাগো এইবার, খড়গ ধরো।/ দিয়াছি ‘যতীনে’ অঞ্জলি নব−/ ভারতের আঁখি-ইন্দিবর।’

দেবী দুর্গাকে নজরুল নিছক পৌরাণিক চরিত্র হিসেবে দেখেননি, অসুন্দর ও অনাচারের বিরুদ্ধে বিজয়ী শক্তির প্রতিভূ হিসেবেও দেখেছেন। আনুষ্ঠানিকতাকে পরিহার করে দুর্গোৎসবে তিনি বিপ্লবী শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছেন। এভাবেই নজরুলচেতনায় দেবী দুর্গা ভাস্বর হয়ে উঠেছেন অনন্যসাধারণ দীপ্তিতে।