নতুন বাংলাদেশের জাগরণ

শিশু উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে।  ছবি: প্রথম আলো
শিশু উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। ছবি: প্রথম আলো

এই বই মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠার ক্ষুদ্র কলেবরের হলেও আছে বিন্দুতে সিন্ধুর গভীরতা। প্রতিটি নিবন্ধে তার ছাপ সুঅঙ্কিত। বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোর ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। কিন্তু বলে রাখা ভালো, বইয়ের লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর এর চতুর্দশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রে। তবে তিন বছরের ব্যবধানেও লেখাগুলোয় প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে বা ফুরিয়ে যায়নি। তাই বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ যথার্থই বলেছেন, ‘এসব লেখা বাংলাদেশের সাফল্যের এক বিশ্বজোড়া উদ্যাপন। এই লেখাগুলো যেন উদ্দীপ্ত এক জনগোষ্ঠীর স্বপ্নযাত্রার আলেখ্য।’ আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষ্যে সেসব আলেখ্য রচনা করেছেন বিশ্ববন্দিত ১৪ জন ব্যক্তিত্ব।
জে এফ আর জ্যাকবকে দিয়েই শুরু হয়েছে পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় নামের বইটি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। এখন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল। লেখার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘কিছুকাল আমি গোয়া ও পাঞ্জাবের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছি। শাসনগত সেই অভিজ্ঞতার আলোকেও বলতে পারি, বাংলাদেশের জনগণ কর্মনিষ্ঠ এবং বাংলাদেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গিত। রাজনৈতিক সমস্যা বাংলাদেশের উন্নতির জন্য বিরাট কোনো বাধা হিসেবে গণ্য হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ রাজনৈতিক সমস্যা বিশ্বের সর্বত্র রয়েছে। একই সমস্যা রয়েছে ভারতে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। তাতে তাদের উন্নয়ন আটকে থাকেনি।’ জ্যাকবের এই অভিজ্ঞতাপ্রসূত আশাবাদ আমাদের গভীরভাবে প্রাণিত করবে।
স্পেনের সদ্য বিদায়ী রানি সোফিয়া নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে লিখেছেন, ‘ক্ষুদ্রঋণের নীতি ও ধারণাটি কীভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, সে অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য অধ্যাপক ইউনূসের আমন্ত্রণে ১৫ বছর আগে আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। এই কার্যক্রম থেকে সুফল পাওয়া কিছু মানুষের সঙ্গে, মূলত কিছু নারী গ্রাহককে আমার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছিল। এই নারী গ্রাহকেরা আমাকে বলেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা ও সহায়তা তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের প্রাত্যহিক জীবনে কী গুরুত্ব বহন করছে।’

পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরীর ড্রয়িং অবলম্বনে অশোক কর্মকার
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
নভেম্বর ২০১৫
৮৮ পৃষ্ঠা
দাম: ২০০ টাকা।

মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের বাবা উইলিয়াম এইচ গেটস সিনিয়র বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে যখন বর্ণনা করেন ব্র্যাকের একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে তাঁর সুন্দর অভিজ্ঞতার কথা, আশার আলোয় ভরে ওঠে বুক। সিনিয়র গেটস স্কুলের শিক্ষার্থীদের, যেখানে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি—জিজ্ঞেস করেন, কে কী হতে চায়, তখন কেউ বলে কৃষক হতে চায়, কেউ বলে শিক্ষক হবে। কিন্তু একটি মেয়ে যখন বলে, ‘আমি ডাক্তার হতে যাচ্ছি,’ তার প্রতিক্রিয়ায় গেটসের ভাষ্য, ‘ওই মুহূর্তটির কথা আমার কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।’
বিখ্যাত ভারতীয় অভিনেত্রী শাবানা আজমি নানা উপলক্ষে বেশ কয়েকবার এসেছেন বাংলাদেশে। এ দেশের মানুষের ভালোবাসায় অভিভূত তিনি। সেই সূত্রেই বলছেন, ‘আমি এক শক্তিশালী স্বতন্ত্র বাংলাদেশের প্রত্যাশা করি যে নিজস্ব পরিচয় নিয়ে উপমহাদেশে অন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে আবদ্ধ হচ্ছে। আমাদের পরস্পরের মধ্যে এত মিল, আমাদের উচিত এই ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করা, নিজেদের সব রকম ভেদাভেদ ভুলে যাওয়া, যাতে এই উপমহাদেশ একটি সত্যিকারের বিশ্বশক্তি হয়ে উঠতে পারে।’
বইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধটি লিখেছেন ইউনেসকোর মহাসচিব ইরিনা বোকোভা। তাঁর মতে, ‘মাতৃভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকারকে পারস্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা ও সবার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় ইউনেসকো বাংলাদেশকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানায়।...ইউনেসকো ভাষার জন্য বাঙালির রক্তঢালা ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। আমাদের কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যেন সবার কণ্ঠস্বর শোনা যায়, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আমরা বদ্ধপরিকর। ভাষাই বলে দেবে আমরা কে। ভাষা বাঁচলে আমরাও বাঁচি।’
এমনিভাবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমবিষয়ক দুই শীর্ষতম কর্মকর্তা হারভি ল্যাডসাস ও আমীরা হকের নিবন্ধের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মূল অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা, ভারতের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর ভাষ্যে ক্রিকেট-বিশ্বে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমীহ-জাগানো স্বাক্ষর রাখার কথা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশটির সক্ষমতার কথা, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা সন্দিহান, তাঁদের সন্দেহ মুক্ত হওয়ার নিদানের কথা, সুন্দরবনের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে দূরপ্রসারী ভাবনার কথা—এসবের পাশাপাশি আরও আছে বাংলাদেশের সেই দুর্জয় মানুষের কথা, যাঁরা বদলে দিতে পারেন পৃথিবীকে। সবশেষে আছে ‘বাংলা ভাষার বিশ্বযোগের কথা’। সব মিলিয়ে পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় এক নিশ্বাসে পড়ার মতো একটি বই।