না–পড়ার দিনগুলো ‘নাই’ হবে কীভাবে

রাইটার্স ব্লকের মতো আছে রিডার্স ব্লকও। এ সময় ভালো লাগে না কোনো বই পড়তে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ কী? বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে রিডার্স ব্লক থেকে মুক্তির উপায় বাতলেছেন নুসরৎ নওরিন

খুব ভালো পড়ুয়া। গোগ্রাসে বই পড়তে পারেন। নতুন বইয়ের গন্ধে মন সতেজ হয়ে ওঠে। এমন পাঠকের জীবনেও কখনো এমন সময় আসে, যখন কোনো বই পড়া তাঁর জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। কোনো বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা কিংবা প্রথম অনুচ্ছেদের পর আর পড়ার আগ্রহ থাকে না। হাতের কাছেই নতুন অনেক বই থাকতেও ধরতে ইচ্ছে করে না কোনোটিই। এই সমস্যার নাম ‘রিডার্স ব্লক’।

রিডার্স ব্লক দূর করার জন্য কঠিন বই দিয়ে পড়া শুরু করা উচিত নয়। ধরা যাক, আপনি শুরুতেই তিস্তাপারের বৃত্তান্ত ধরলে হিতে বিপরীতই হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ছোট আয়তনের, সহজ বই দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে বড় বইয়ের দিকে যাওয়া ভালো। হতে পারে ছোট ছোট গল্পের কোনো বই। হয়তো বনফুলের গল্প।

গার্ডিয়ান–এর সাংবাদিক স্টুয়ার্ট জেফ্রিস বলছেন, পাঠকদের সমস্যা হলো, তাঁরা খুব বড় লক্ষ্য নেন। তিনি বলেন, ‘আপনি এমন একটি বই পড়বেন বলে ঠিক করছেন, যেটি আপনি জানেন আপনার পড়া উচিত, কিন্তু আপনি হয়তো পড়বেন না।’

এই সমস্যার সমাধানের জন্য মাঝেমধ্যে একটু রুচি বদল করে দেখা যেতে পারে। আপনি হয়তো ফিকশনে অভ্যস্ত। ধারা বদলে নন ফিকশনের জগতে ঢুঁ মারলেন। আগে রহস্যোপন্যাস ভালো লাগত, এখন ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে হাসির কোনো বই পড়ে দেখতে পারেন। রোমান্টিক বিষয়বস্তুর ভক্ত হলে চেষ্টা করতে পারেন ইতিহাসনির্ভর লেখা পড়ে দেখার।

ব্রিটিশ লেখিকা লুসি ম্যানগানের মতে, রিডার্স ব্লকে ভোগা পাঠক এমন একজন, যিনি নিজের সঙ্গে সৎ নন। তিনি ভেতরে ভেতরে নিজের স্বাভাবিক রুচির বাইরে কোনো বই পড়তে চাচ্ছেন। কিন্তু অতিরিক্ত নাক–উঁচু ভাবের কারণে সেটা পারছেন না।

এই পাঠক হয়তো জেমস জয়েসের ইউলিসিস–এর খ্যাতির জন্য বইটি পড়বেন বলে পণ করেছে। কিন্তু ওখান থেকে বেরিয়ে মাসুদ রানা না পড়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না। অথচ মাসের পর মাস এ জন্য মানসিক কষ্টে ভুগছেন। অন্য রকমও হতে পারে। হয়তো শুধু খেলার বইয়েই আপনার আগ্রহ। হঠাৎ করে রাজনৈতিক স্ক্যান্ডালবিষয়ক বইয়ে আগ্রহ পাচ্ছেন। তাই নিজের সঙ্গে সৎ হওয়া জরুরি। যেসব বিখ্যাত, ভারী, ক্ল্যাসিক বইয়ের নাম আপনি জানেন, সেগুলো আপনার মনের সঙ্গে না–ও যেতে পারে। ওদিকে আপনার পছন্দের বইটি বুকশেলফে সাজিয়ে রাখলে জাত যায়। নিজের পছন্দকে সাহসীভাবে প্রকাশে লজ্জার কিছু নেই। বরং অকপট হয়ে পছন্দের বইটি কিনুন, পড়ুন এবং বুকশেলফে ‘আঁতেল’ বইগুলোর পাশে সাজিয়ে রাখুন।

যখন বই পড়ে আনন্দ পাওয়ার বদলে বই পড়াটাকে একটা কাজ মনে হয়, তখন পড়ে শেষ করতেই হবে, এমন ধনুর্ভাঙা পণের দরকার নেই। বহু কালোত্তীর্ণ বই পড়ুয়াদের ভোটে সবচেয়ে বিরক্তিকর বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস থেকে শুরু করে দস্তয়ভস্কির দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য সান অলসো রাইজেস, ভার্জিনিয়া উলফের টু দ্য লাইটহাউস, ফিটজেরাল্ডের দ্য গ্রেট গ্যাটসবি, হোমারের অডিসি পর্যন্ত আছে এই তালিকায়। তাই মাথা ঠান্ডা করে শান্তভাবে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, কী পড়তে চাই, আমাকে কোনটা টানছে।

কোনো বই পড়তে শুরু করার আগে প্রথম থেকে না পড়ে বইয়ের মাঝখানে যেকোনো একটা পৃষ্ঠা বের করে পড়ে দেখুন। হয়তো সেটা বইটার ৪৩ নম্বর পৃষ্ঠা। ওখানে খানিকটা পড়েই আপনি বুঝতে পারবেন, এই বই আপনি পড়ে যেতে পারবেন কি, পারবেন না।

কেউ কেউ অতিরিক্ত ডিজিটাল আসক্তিকে না পড়তে পারার জন্য দায়ী করেন। রাতের খাওয়ার পর টিভি, দিনের বেলায় উদ্দেশ্যহীন সোশ্যাল মিডিয়া ব্রাউজিং, নেটফ্লিক্স, এই সব নানাবিধ সময় বই পড়ার সময়টা ‘খেয়ে’ দেয়। তাই এই আসক্তি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিত।

সব রকমভাবে পড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলে নিজের কোনো পুরোনো বন্ধুর কাছে ফিরে যান। অর্থাৎ আগে পড়া খুব প্রিয় একটি বই আবার পড়ে দেখুন। পড়ার আগ্রহ হয়তো ফিরে আসবে। কিছুদিন বিরতি দিয়েও দেখতে পারেন।

রুচি তৈরি হয়ে ওঠে প্রচুর এবং বৈচিত্র্যময় পাঠের মধ্য দিয়ে। তারপরও প্রতিটি মানুষের পছন্দের নিজস্বতা থাকে। একজনের পড়ার রুচি কখনো পুরোপুরি আরেকজনের মতো হয় না। নিজের রুচি বোঝা এবং তাকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যেই সমাধান।

আর কিছু বই নিয়ে কিছুতেই এগোতে না পারার ব্যর্থতায় ফ্রান্সিস বেকনের কথাটি নিজেকে মনে করিয়ে দিতে পারেন, ‘কিছু বই চেখে দেখতে হয়, কিছু বই গিলতে হয় আর গুটিকয় বই চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে হজম করতে হয়। অর্থাৎ কিছু বইয়ের কিছু কিছু অংশ পড়তে হয়, অন্য কিছু বই পড়তে হয় তবে খুব আগ্রহের সঙ্গে নয় এবং গুটিকয় বই একাগ্রতা ও গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে পড়তে হয়।’

সুতরাং সব পড়া সমান মনোযোগ দাবি করে না।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, মেন্টাল ফ্লস ও গুডরিডস