নিথর মুদ্রার ফিসফিসানি

কোলাজ মনিরুল ইসলাম
সুলতানি আমলের মুদ্রা সম্পর্কে জানতে বইটি খুবই কার্যকরী।

বইটি বাংলাদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহৃত আকর সূত্রের গ্রন্থতালিকায় একটি নতুন সংযোজন। লেখক মো. শরিফুল ইসলাম পেশাগত জীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং মোহাম্মদ আবদুর রহিম বিশিষ্ট ক্যালিওগ্রাফার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে বাংলার ক্যালিওগ্রাফি বিষয়ে পিএইচডি গবেষণারত। লেখকদ্বয়ের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এটি প্রথম মুদ্রাবিষয়ক গবেষণা হলেও মো. শরিফুল ইসলামের এটি বাংলার মুদ্রাবিষয়ক দ্বিতীয় বই।

সুলতানি যুগের বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা বা প্রতিকূলতা হলো সমসাময়িক ইতিহাস বইয়ের অভাব। দিল্লির সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবি-ফারসি ভাষায় একাধিক ইতিহাসগ্রন্থ রচিত হলেও বাংলার সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় লিখিত এ রকম কোনো বই খুব একটা দেখা যায় না। লিখিত আকর সূত্রের এ ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে ইতিহাসবিদদের নির্ভর করতে হয় প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র, বিশেষত মুদ্রা ও শিলালিপির ওপর। বাংলার মুসলিম শাসকদের জারিকৃত মুদ্রা বা ‘ধাতব অর্থ’ ইতিহাস পুনর্গঠনের অন্যতম আকর সূত্র। ইতিহাসের এই আকর সূত্রগুলো ইতিহাসবিদদের কাছে তুলে ধরেন প্রত্নতাত্ত্বিক, মুদ্রা বিশারদ ও লিপি বিশারদেরা, যাঁদের রয়েছে ভাষাগত দক্ষতা ও লিপিবিষয়ক পাণ্ডিত্য। বইটিতে রয়েছে সে রকম একটি প্রচেষ্টা।

আলোচ্য বইয়ে ‘মুখবন্ধ’ এবং ‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’ অংশ দুটির পাশাপাশি ১২টি অধ্যায়, ৩টি পরিশিষ্ট ও সহায়ক গবেষণাগ্রন্থের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়—এ তিন অধ্যায়কে বিষয়বস্তু উপস্থাপনের পটভূমি এবং পরবর্তী নয়টি অধ্যায়ে মূল বিষয়ের উপস্থাপন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথম অধ্যায়টিতে লেখকদ্বয় সুলতানি বাংলার ভৌগোলিক পরিচয় বা যে ভূখণ্ডগত পরিসীমায় মুদ্রাগুলো প্রচলিত ছিল, সেটিকে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সুলতানি যুগের ইতিহাসের উৎসগুলো, রাজনৈতিক পর্যায়গুলো এবং সুলতানদের নাম ও তাঁদের কালানুক্রম উপস্থাপন করেছেন। সুলতানি বাংলার ভৌগোলিক পরিসীমা হলো ১৯৪৭-পূর্ব সময়ের একটি ভূরাজনৈতিক একক এবং এটি বর্তমানে আধুনিক বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত। এককটি মোগলদের সময়ে সুবাহ বাঙ্গালাহ এবং ব্রিটিশ যুগে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি হিসেবে পরিচিত ছিল। অধ্যায়টির শেষ তিন পৃষ্ঠায় সুলতানি বাংলার ১২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যিক ঐতিহ্যের, প্রধানত মসজিদ ও মাদ্রাসা-সচিত্র কিন্তু সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সুলতানি বাংলার মুদ্রার রহস্যময় জটিল দুনিয়াতে প্রবেশ করার আগে এ অংশ পাঠককে বিষয়বস্তুর সঙ্গে মানসিক সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

পরবর্তী অধ্যায়ে বাংলার সুলতানি যুগের মুদ্রাগুলোতে খোদিত বা উপস্থাপিত লেখমালার ভাষ্য, টাঁকশালের নাম ও মুদ্রায় উপস্থাপিত লেখমালার পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে একজন গবেষককে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন, সেগুলোকে সহজ ভাষায় সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে লেখা হয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্তু বাংলার সুলতানি আমলের মুদ্রায় খোদিত বা উপস্থাপিত লেখমালা। সুলতানি যুগে রাষ্ট্রীয় ভাষা আরবি হওয়াতেও মুদ্রায় লেখমালার ভাষাও ছিল আরবি। বাংলার মুদ্রায় আরবি ক্যালিওগ্রাফি রীতি অনুসারে ব্যবহৃত তুলত্ আল মদিনা, কুফিক আল বাঙ্গালিয়া, নাসখ, মুহাক্কক আল মাদিনা রীতিতে লেখা অক্ষরের পরিচয়, অক্ষরের বৈশিষ্ট্যাবলির সাবলীল উপস্থাপনের পাশাপাশি বাংলার ক্যালিওগ্রাফারদের আবিষ্কৃত তুঘরারীতির পরিচয় ও অক্ষরের বৈশিষ্ট্য এ অধ্যায়ে বিধৃত হয়েছে। বইটিতে উপস্থাপিত কুফিক, নাসখ, তুলত্‌, মুহাক্কাক, তাওক্বী ও নাসতালিক রীতিতে লিখিত ‘বাসমালাহ’-এর বিভিন্ন রূপসংবলিত তালিকাটি আগ্রহী পাঠক এবং লিপিবিদ্যায় উৎসাহী শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ অধ্যায়ে সংযোজিত আরবি বর্ণমালা, সংখ্যা এবং সংখ্যার শাব্দিক রূপের ওপর চারটি চার্ট বা তালিকা এবং প্রোটো-বাংলা অক্ষরে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের দুটি চার্ট সুলতানি বাংলার মুদ্রার পরিচায়, পাঠোদ্ধার ও বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হবে বলে অনুমান করা যায়।
চতুর্থ অধ্যায় থেকে দ্বাদশ অধ্যায় হলো বইটির দেহ। এ অধ্যায়গুলোতেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরব্যাপী সময়ে বাংলা অঞ্চলে প্রচারিত এবং ব্যবহৃত মুদ্রাগুলোর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়টিকে সর্বমোট ২৪ জন শাসকের একটি করে এবং কখনো কখনো একাধিক মুদ্রার পরিচায়, মুদ্রাগৎ, লেখরীতি তুলে ধরা হয়েছে।

দ্য সালতানাত পিরিয়ড কয়েনস অব বেঙ্গল: ফোকাস অন এপ্রিগ্রাফিক স্টাডি ক্যালিগ্রাফি অ্যান্ড হিস্ট্রি মো. শরিফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আবদুর রহিম প্রকাশক: ব্ল্যাক এন অরেঞ্জ, প্রকাশকাল ২০২০, পৃষ্ঠা: ২৮৮, দাম: ১৭৫০ টাকা।

পঞ্চম অধ্যায় থেকে নবম অধ্যায় পর্যন্ত লেখকদ্বয় বাংলার ইতিহাসের ‘স্বাধীনতার দু শ বছর’ আখ্যানপর্বের শাসকদের মুদ্রার বর্ণনা দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ, আলাউদ্দিন আলী শাহ, ইখতিয়ারউদ্দিন গাজি শাহ ও ইলিয়াস শাহি বংশের সুলতানদের মুদ্রা। ফিরোজ বিন বায়জিদ শাহ, কুতুব উদ্দিন আজম, সিরাজউদ্দিন সিকান্দার শাহ ও নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ—এই চারজন সুলতানের পাঁচটি মুদ্রার সঙ্গে পাঠকের পরিচিতি পর্ব হলো এ অধ্যায়ের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর উপস্থাপন। এই সুলতানদের মুদ্রার খবর বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধে পাওয়া গেলেও মুদ্রাবিষয়ক গ্রন্থে প্রথমবারের মতো এদের সরব উপস্থিতি পাওয়া গেল।
পরবর্তী অধ্যায়ের বিষয়বস্তু রাজা গণেশ, তাঁর ধর্মান্তরিত পুত্র যদু ওরফে জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ ও গিয়াসউদ্দিন নুসরত শাহ, মহেন্দ্রদেব, শামসউদ্দিন আহমদ শাহ এবং গিয়াসউদ্দিন নুসরত শাহের মুদ্রা। এ অধ্যায়ে (পৃ. ১৪০-৪৬) বাংলার কূটনৈতিক ইতিহাস এবং মুদ্রায় তাঁর প্রতিফলনের প্রাসঙ্গিক বয়ান দেওয়া হয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চিনের মিং বংশের সম্রাটদের সঙ্গে বাংলার সুলতানদের বন্ধুভাবাপন্ন কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাংলার একাধিক সুলতানের দরবারে চীনের রাষ্ট্রীয় বহর এসেছিল। বাংলা থেকেও উপঢৌকন নিয়ে বাংলার প্রতিনিধিরা চৈনিক সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। চৈনিক দরবারি সূত্রগুলোতে এ উপঢৌকন বিনিময়ের বিশদ বিবরণ রয়েছে। জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের মুদ্রায় চৈনিক নকশার প্রতিফলন এবং সিংহমূর্তির উপস্থিতি কি এই কূটনৈতিক সম্পর্কেরই একটি বহিঃপ্রকাশ? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা করেছেন লেখকেরা।

সপ্তম থেকে দশম অধ্যায়ে লেখক পরবর্তী ইলিয়াস শাহি সুলতানেরা, বশি শাসকেরা, হোসেন শাহী বংশের সুলতানেরা, মোগল বাদশাহ হুমায়ুন, শেরশাহ ও তাঁর উত্তরসূরি সুলতানদের ইস্যুকৃত মুদ্রার পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। বইয়ের একাদশ অধ্যায়ে মুহাম্মদ শাহ গাজি, গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ ও গিয়াসউদ্দিন জালাল বিন মুহাম্মদের মুদ্রার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।

শেষ অধ্যায়ে কররানি বংশের সুলতান দাউদখান কররানির মুদ্রা উপস্থাপন করে আলোচনার সমাপ্তি টানা হয়েছে।

বইটির বিশেষত্ব হলো উপস্থাপিত মুদ্রার ছবির পাশাপাশি গ্রে স্কেল ড্রয়িংয়ের উপস্থাপন। এর সঙ্গে প্রতিটি মুদ্রায় খোদিত চিত্র, প্রতীক এবং লেখমালার ড্রয়িং, টাইপ ফর্ম ও ইংরেজি অক্ষরে তার উচ্চারণ দেওয়া হয়েছে। বইটি বাংলার সুলতানি যুগের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস, ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে অদ্যাবধি জানা ইতিহাসের বাইরে নতুন তথ্য ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে।

গ্রন্থকারদের অন্যতম একটি স্বকীয়তা হলো, তাঁরা মুদ্রার ক্যাটালগ তৈরির চেনা রাস্তায় না হেঁটে কিছুটা ব্যতিক্রমী মাধ্যমে বাংলার সুলতানি যুগের মুদ্রার ভাষ্য উপস্থাপন এবং তা উদ্‌ঘাটনের রোমাঞ্চকর প্রক্রিয়া পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।

মুদ্রাবিদ পরমেশ্বরলাল গুপ্ত বলেছিলেন, ‘সিক্কা বলতে হ্যায় সুননে আনা চাহিয়ে’, অর্থাৎ মুদ্রা কথা বলে এবং সেটি শোনার যোগ্যতা থাকা চায়। এটি তেমন এক বই, যা আগ্রহী পাঠক, সংগ্রাহক, গবেষক বা মুদ্রাতত্ত্বে শিক্ষানবিশকে সুলতানি বাংলার মুদ্রার পাঠোদ্ধার করার পদ্ধতি শিখিয়ে দিতে পারে। এ বই পড়তে পড়তে পাঠক কান পাতলে শুনতেও পারবেন নিথর মুদ্রার ফিসফিসানি।
অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]