নীলের ঘাড় মটকে লালের উল্লাস

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
সময়টা কেমন যেন। একের পর এক আসছে দুঃসংবাদ। কারা যেন নীরবে ঘাড় মটকে চলেছে আমাদের।

লেখার শিরোনাম নিয়েই এগোনো যাক। কেন এ শিরোনাম মাথায় এল, তা নিয়েই কথা শুরু হোক। তবে ধীরে ধীরে। নানা চিন্তার ভিড়ে মস্তিষ্ক আর আগের মতো গতিশীল নয় বোধ হয়। আচ্ছা, উঁচু–নিচু বন্ধুর রাস্তায় কেউ কি আর হনহন করে হাঁটতে পারে? খুব হাঁপ ধরে যায় যে।

আগে রঙের প্রসঙ্গে আসি। নীল। রং হিসেবে এটি আকাশ আর সমুদ্রকে প্রতিনিধিত্ব করে। বোঝায় বিষয়বস্তুর গভীরতাকে। প্রতীকীভাবে নীল দিয়ে আস্থা,বিশ্বাস, সত্য—এসবের রূপ কল্পনা করা হয়। এই হলো নীল রঙের বিষয়ে মানুষের সাধারণ ভাবনা। নীল দেখে মানুষের আদিযুগ থেকে যা মনে হয়ে আসছে, তা–ই নিশ্চয় এসব শব্দের আকার নিয়েছে। আপাতত সেটাই ধরে নেওয়া যাক।

বেশ কিছুদিন ধরেই এই নীলকে আর আকাশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেমন যেন বিষণ্ন প্রকৃতি। চুপটি করে আছে। একদম ঘুটঘুটে কালো না হলেও ধূসর ভাব। বৃষ্টি হচ্ছে যখন–তখন। হয়তো গায়ের ময়লা ধুয়ে পরিষ্কার হতে চাইছে প্রকৃতি। কিন্তু পারছে কি? পারলে হয়তো ধবধবে সাদা মেঘের চারণক্ষেত্র সুনীল আকাশ আবার দেখা দেবে। তবে আপাতত নীলকে হারানোর বিরহে ভোগা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

নীল আকাশের মতোই নীলাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। নীলা রক্তে লাল হয়েছে। দোষী আছে, প্রশ্রয়দাতা আছে। আছে নীরব দর্শক। এই দর্শকদের হাততালি বা কান্না—দুটিতেই মানা। তবে শো শেষে হা-হুতাশ ভালোই পারেন। তাঁরা এখন মুখ খুলেছেন, কথা বলছেন। অথচ তাঁদের একসময়ের নীরবতা এক নীলাকে ছুটি দিয়ে দিল। এখন ছুটির ঘণ্টায় ঘা দেওয়া তস্করকে ধরতে সবাই গলদঘর্ম। সেই ঘাম হয়তো শিগগিরই শুকিয়ে দেবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র। যন্ত্রের রিমোট কন্ট্রোল আছে ক্ষমতার হাতে। আর কে না জানে, ক্ষমতা খুবই ভুলোমনের। কোনো কিছু ভুলে যেতে তার জুড়ি মেলা ভার। ইচ্ছা হলেই রিমোট কন্ট্রোলের লাল বোতাম টিপে বন্ধ করা হয় সব। টিভি স্ক্রিনে তখন নামে রাজ্যের আঁধার।

লাল বোতামের কথা যখন এলই, তখন রঙের কাছ থেকেও না হয় ঘুরে আসা যাক। প্রাগৈতিহাসিক যুগে আমাদের, অর্থাৎ দোপেয়ে মানুষদের পূর্বপুরুষেরা মনে করত, লাল মানে আগুন আর রক্ত। দুটোই আতঙ্কজাগানিয়া। লাল উদগ্র কামনা ও বিপদের জানানও দেয় বটে। লাল আসলে কোনো কিছুর সর্বোচ্চ মাত্রা।

আচ্ছা, সিলেটের এমসি কলেজের ওই কক্ষের সামনে কি লালরঙা প্রতীক ছিল কোনো? আগেভাগে বিপদের আঁচ পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল কি? কর্তৃপক্ষ কি সেসব তলিয়ে দেখছে? নাকি খুঁজছে ক্ষমতার রিমোট কন্ট্রোল? প্রশ্নটা মাথায় আসছে। কারণ, এ ঘটনার খবরে যে ‘ক্ষমতাসীন’ শব্দটি জুড়ে বসেছে। পাওয়া যাচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল নানা ছবি। ওসব দেখে আবার কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগের কোনো বিস্মৃত ঘটনার ঝলক ঝলসে ওঠে। স্মৃতির ফাইল থেকে ঘটনা বাছাই করাও কঠিন। ফাইল জমে জমে যে গোটাকয় মহাফেজখানা তৈরি হয়েছে, তাতে রোগের বিবরণ থাকলেও প্রেসক্রিপশন নেই কোনো।

প্রেসক্রিপশন তাই আর মেলে না। রোগের জট বাড়তেই থাকে। বুড়ো হয়। প্রাচীন হয়। একসময় উইপোকায় খুঁটে খায় সব। আমরাও স্বস্তি পাই। ভাবি, যাক একটা ফাইল তো কমল!

নীল আকাশের মতোই নীলাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। নীলা রক্তে লাল হয়েছে। দোষী আছে, প্রশ্রয়দাতা আছে। আছে নীরব দর্শক। এই দর্শকদের হাততালি বা কান্না—দুটিতেই মানা। তবে শো শেষে হা-হুতাশ ভালোই পারেন। তাঁরা এখন মুখ খুলেছেন, কথা বলছেন। অথচ তাঁদের একসময়ের নীরবতা এক নীলাকে ছুটি দিয়ে দিল। এখন ছুটির ঘণ্টায় ঘা দেওয়া তস্করকে ধরতে সবাই গলদঘর্ম। সেই ঘাম হয়তো শিগগিরই শুকিয়ে দেবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র।

এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে যায় মিসরীয় লেখক সাবরি মুসার লেখা একটি গল্প। সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছিল। অনুবাদ করেছিলেন এলিজাবেথ ব্লোয়েগার ও ভিভিয়ান আবাজিয়া, সঙ্গে ছিলেন আনা লিলিঅস। ইংরেজিতে গল্পটির নাম ছিল, ‘বেনেভোলেন্স’। ইন্টারনেটে খুঁজলে পাওয়া যায়।

কেন এ গল্পের কথা মনে পড়ল বলি এবার। গল্পে এক অসহায় মা ও তাঁর ততোধিক অসহায় মেয়ের কাহিনি বলা হয়েছে। কিশোরী মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।

গর্ভবতী হয়ে পড়ায় মায়ের চোখে ধরা পড়ে যায় সেই লুকিয়ে রাখা নির্মম সত্য। ভয়ে, আতঙ্কে ও তথাকথিত সমাজের লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েকে নিয়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন মা। চলতি পথে এক লোকের সাহায্য চান তিনি। মেয়ের ঘটনার সমাধান চান। সব শুনে লোকটির দয়া হয়। আশ্রয় দিয়ে বলেন, শিগগিরই সমাধান হবে, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মা ঘুমিয়ে যাওয়ার পরই শুরু হয় কাজ। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে! রাতের আঁধারে তাই কিশোরী মেয়েটির ঘাড় মটকে দেওয়া হয়। তারপর লাশ ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। হয়ে যায় সমস্যার ত্বরিত সমাধান।

আমরা এভাবেই চলছি অনেক দিন, অনেক মাস, অনেক বছর।

আকাশ তাই বিষণ্ন হয়েই থাকে। বাতাস বয় শনশন। মাঝেমধ্যে চমকে ওঠা বিজলি দেখিয়ে দেয়, কত আঁধার চারপাশে!

ঠিক তখনই নির্বিবাদে চলে নীলের ঘাড় মটকে লালের উল্লাস। রক্তে রাঙা হাতে চলে দেয়ালে ছাপ মারার উৎসব।

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]