
ফুলতলা গ্রাম হঠাৎ নীরব হয়ে গেল। মানুষগুলো আগে থেকেই ভয়ে চুপ। সুনসান হয়ে গেছে গাছপালাও। কিচিরমিচির নেই। ঘটনা কী? ঘটনা হলো পাখিরা মিটিংয়ে বসেছে। জরুরি মিটিং। কেউ টুঁ শব্দ করছে না। হাঁড়িচাঁচা থেকে শুরু করে টুনটুনি, কাক থেকে কোকিল, এমনকি দিনের বেলায় নাক ডেকে ঘুমায় যে প্যাঁচা, সেও এসেছে খোপ ছেড়ে। সামনে বিশাল বিপদ। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। খবর এসেছে, আগামীকাল ভোরেই ফুলতলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা করবে।
‘আনন্দপুর গ্রামটারে পুড়াইয়া ছাই বানাইয়া ফেলছিল। আমি কোনোমতে বাঁইচা ফিরছিলাম। এখন ফুলতলাও...’ নিরবতা ভাঙল পিচ্চি ময়না। ছোট মুখে বড় কথা শুনেও খেপল না পাখিপাড়ার চেয়ারম্যান বৃদ্ধ কাক্কু মিয়া। বয়স হলেও চোখের জোর কমেনি। দূরে একটা চিল ঝিমোচ্ছিল। দেখেই চিৎকার ছুড়ল। ‘চিলু! ঘুমাচ্ছিস ক্যা! ক্যা! ক্যা!’ ধড়ফড় করে উঠল চিলু।
‘আমি আসলে ভাবছিলাম যে কী করা যায়? আমাদের হাতে গোলা নেই, বারুদও নেই।’
‘আমরা একটা জিনিস পারি, যেটা মানুষ পারে না। কী সেইটা?’ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল কাক্কু মিয়া।
গলার জোর বেশি মুনিয়ার। চিৎকার করে বলল, ‘ডিম পাড়া!’ কাক্কু মিয়া কটমট করে তাকাল। আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, ‘মানুষ উড়তে পারে না। আমরা পারি। এইটাই আমাদের ১ নম্বর অস্ত্র।’
বিষয়টা অনেকের মাথায় না ঢুকলেও সবাই বলল, ঠিক ঠিক। পাখিপাড়ার প্রবীণ সদস্য কাঠঠোকরা বলল, ‘ঠিক ঠিক ঠিক। আমরা উড়ে গিয়ে ওদের মাথায় ঠক ঠক ঠক, মানে ফুটো করে দেব।’
বুদ্ধিটা কাক্কু মিয়ার পছন্দ হলো কি না কে জানে। খানিক পর কোত্থেকে উড়ে এসে একটা শালিক বসল আমগাছের ডালে। এক শালিক দেখে সবাই চুপসে গেল। না জানি কী দুঃসংবাদ আছে! শালিকটা বলল, ‘খালের সেতু দিয়ে হানাদার বাহিনীর ট্যাংক আর জিপ আসবে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যাবে।’
‘এখন উপায়! কী হবে!’
শোরগোল লেগে গেল পাখিপাড়ায়।
‘সবাই চুপ! কাক্কু মিয়া একটা কিছু বলবে!’
বাজ পাখির বাজখাঁই গলা শুনে সবাই চুপ। প্রস্তুতি নিচ্ছে চেয়ারম্যান কাক্কু মিয়া। খ্যা খ্যা করে গলাটা পরিষ্কার করে নিল। ঝট করে ডান পাখাটা তুলে বলল, ‘সবাই ভোরে রেডি থাকবা। তারপর ব্রিজ থেইকা আধা মাইল দূরে গিয়া হামলা চালাবা। কীভাবে কী করবা, সেইটা শুইনা রাখো।’
প্ল্যান রেডি। সবাই তৈরি হতে গেল। খড়কুটো বাদ দিয়ে সবাই খুঁজতে লাগল ছোট পাথর। একসময় রাত হলো। সব পাখি ঘুমিয়ে পড়ল। তবে নীরবে একজন উড়াল দিল। আর কেউ নয়, কাক্কু মিয়া। তার নিজস্ব একটা পরিকল্পনা আছে। ভোর হওয়ার আগেই ১০ মাইল দূরের কুসুমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। সেখানে আছে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প।
ভোর হলো। কাক্কুর পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রামের সব পাখি জায়গামতো হাজির। কাক্কু এখনো ফেরেননি। সবাই চিন্তিত। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই ঠোঁটের আগায় ছোট ছোট পাথর নিয়ে এসেছে। বড় দু-একটা ধনেশ পাখিও আছে। ওদের ঠোঁটে অনেক জায়গা। বড় পাথর ধরে আছে। দূরে দেখা যাচ্ছে মিলিটারি জিপ। সেতুর দিকেই আসছে। পাখিদের মনে ক্ষীণ সন্দেহ। ওপর থেকে পাথর ছুড়ে কিছু করতে পারবে কি না। সেনাদের মাথায় হেলমেট। ছোট পাথরে কিছু হবে না। তবু যুদ্ধ হলো যুদ্ধ। পাখিপাড়ায় প্রবাদ আছে, যতক্ষণ আছে ডানা ততক্ষণ হার না-মানা।
জিপ আর ট্যাংক এখনো সেতু থেকে আধা মাইল দূরে। প্রথম ঢিলটা ফেলল চড়ুই। ঠুং করে একটা শব্দ হলো। টেরই পেল না সেনাটা। একে একে মুনিয়া, শালিক, ঘুঘুর দলও উঁচুতে উঠে মুখে রাখা পাথর ফেলল। আচমকা পাথরবৃষ্টি দেখে থমকে গেল গাড়ি দুটো। কিন্তু কিছুই হলো না। সব পাথর হেলমেটে পড়ছে। একটা ধনেশ ছুটে এসে ঠোকর লাগাল একজনের চোখে। দারুণ চোট লেগেছে। উর্দুতে চেঁচামেচি করতে করতে এগিয়ে চলল ওরা। জিপ আর ট্যাংক এগিয়ে চলল সেতুর দিকে। পাখিরা ভীষণ হতাশ।
‘আরে কাক্কু মিয়া আসতেছে!’ মুনিয়ার চিৎকারে সবাই তাকাল দূর আকাশে। একটু পরেই মিলিটারিদের গাড়ি সেতুতে উঠবে। কিন্তু কাক্কু কি পারবে কিছু করতে? তার মুখে ওই গোল পাথরটা দিয়ে কী হবে?
হানাদার বাহিনীর মাথার ওপর চক্কর খাচ্ছে কাক্কু। একজন গুলি ছুড়ল। লাগল না। সেতুর ওপর উঠছে গাড়ি দুটি। সেতুতে চাকা রাখতেই মুখ থেকে গোল পাথরটা ছুড়ে দিল কাক্কু মিয়া। বুমমমম! প্রচণ্ড শব্দে যেন কেঁপে উঠল গোটা ফুলতলা। উড়ে গেছে সেতুটা! সঙ্গে চুরমার দুটি গাড়িও। বিজয়োল্লাস করতে করতে পাখির দল ফিরে এল গ্রামে। সবাই কাক্কুকে ঘিরে উড়ছে। কাক্কু ঠিক করেছে, রহস্য এখনই ফাঁস করবে না। রাত হলে গল্পে গল্পে শোনানো যাবে। পাথরের বদলে সে যে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প থেকে একটা বোমা নিয়ে এসেছিল, এটা এখনো কেউ ধরতে পারেনি।