‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’র অন্য রকম নিক্বণ

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

সৌম্য সালেকের তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’। এই বইয়ের কবিতায় অন্য রকম এক নিক্বণের সুর শোনা যায়। বইয়ের নাম ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’ দেওয়ার মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট বোঝা যায়, যে ঘটনা কবি দেখেন, হুবহু তা-ই প্রকাশ করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি প্রকাশ করেন সেই ঘটনার অন্তরালের অভিব্যক্তি। পতনোন্মুখ সহস্র পাতার প্রতিটি যে অভিন্ন মর্মর নিয়ে ঝরে না, বরং তার অন্তরালে বাজে নানান সুর ও স্বরের মূর্ছনা, অপার বিস্ময় নিয়ে সেটাই শোনেন তিনি। আর তাই তাঁর কবিতার শিরোনাম হয়ে যায় ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’। আলোচ্য গ্রন্থের নামকরণও করা হয়েছে একটি কবিতার শিরোনাম অনুযায়ী। কবিতার প্রথম স্তবক এমন:
‘নৈঃশব্দ্যের চেয়ে কিছু বেশি
খসে পড়ে হিম অনুপাতে
ইথারের সুমধুর তানে ছড়ায় মাধুরী
ঘাসে ঘাসে, জল ও মাটির কিনারে মনোহর...’
পরের স্তবকÑ
‘এসব পাখি শুনেছে আগে
মধুমাসে ভ্রমর শুনেছে
তারপর মেঘেরা বয়ে নিয়ে গেছে হিমাদ্রি-বাতাসে
উত্তর সাগরপারে তাই এত রাগের হিল্লোল’ (পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা, পৃষ্ঠা ১৪)
একজন সংবেদনশীল কবি বলেই সৌম্য সালেক ‘নৈঃশব্দ্যের চেয়ে কিছু বেশি’ কিংবা ‘এত রাগের হিল্লোল’ শুনতে পান।

গ্রন্থের প্রথম কবিতার শিরোনাম ‘ওরা দুজন সাগরে সূর্যডোবা দেখতে গিয়েছিল’। এ কবিতায় বিষণ্নতাবাদের প্রতি কবির পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রেমিকযুগল যারা সমুদ্রে সূর্যাস্ত উপভোগ করতে গিয়ে স্বেচ্ছায় সাগরের নীল-মত্ত-মজ্জনে ডুবে যায়, তা-ই বিবৃত হয়েছে কবিতাটিতে। দ্বিতীয় কবিতার শিরোনাম ‘সেই তুমুল অঘ্রাণলোকে’। এই কবিতায় কবির প্রত্যক্ষণ:
ওরা এসব আগলে রেখেছিল এত দিন
ওরা এসব স্বপ্রেমে পুষেছিল এত দিন
তারপর তুমুল ঘেমেছিল পরিপাশ
তার আগে ঘুমে ঘুমে কেটেছিল অধিবাস।’ (পৃষ্ঠা ১০)
সৌম্য সালেকের কবিতার বৈশিষ্ট্য হলো সহজগম্যতা ও গীতলতা। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং রাজনীতি ও সময়সচেতনতা সৌম্য সালেকের কবিতার অন্য এক অনুষঙ্গ। এ কবিতাগ্রন্থের বেশ কয়েকটি কবিতায় এই বক্তব্যের সত্যতা মেলে, যেমন ‘অসমতা’, ‘অধিবেশন’, ‘বস্ত্রহরণ’, ‘ফাঁস’, ‘সং অব ম্যাসাকার’, ‘মাতৃত্ব’, ‘মৃতের সরণি’, ‘সোনাবরু’, ‘জুয়েল গার্ডেনের লালগালিচায় প্রিয় লেবানিজ’, ‘রাজীবের জন্য গাথা’ প্রভৃতি। এর মধ্যে কয়েকটি কবিতা সার্থক স্যাটায়ার হিসেবে উত্তীর্ণ।

‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’লেখক: সৌম্য সালেকপ্রচ্ছদ: মোমিন উদ্দীন খালেদ, প্রকাশক: সময় প্রকাশন, প্রকাশকাল: একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০, দাম: ১৬০ টাকা।

‘নীল রাতে’, ‘অপ্রেমের পাঠ’, ‘আত্মজার জন্য গাথা’, ‘কতিপয় বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের টীকা’, ‘অদিতি মহসিন’, ‘উত্থিত ভূমির দেশে’, ‘বিধ্বস্ত ইমেজ’, ‘ঘুম’, ‘নগ্নবিষাদ’, ‘সংযোজিত সংলাপ’, ‘আহ্বান’, ‘বাঁশিয়াল’, ‘একটি পুরোনো গীত’, ‘আত্মপক্ষ’, ‘মেঠো স্বপ্নের পালা’, ‘মধুগ্রামের মেয়ে’, ‘পুরোনো মানুষ’ প্রভৃতি কবিতায় সময়ের সংরক্ত উদ্ভাসিত হয়েছে। তাঁর শব্দচয়ন এমন:
‘একদিন বর্শা হাতে দাঁড়াব কান্তারে
ঝরাপাতা আগুনে পোড়াব উগ্র শিখার পাশে ঘুমাব অশেষ
আমি এক পুরোনো মানুষ, পুরোনো দোহারা দেহ’ (পৃষ্ঠা ৫৮)
প্রচল ছন্দেও সৌম্য সালেক স্বচ্ছন্দ্য। বেশ কয়েকটি ছন্দের কবিতা ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’য় সন্নিবেশিত হয়েছে। বইয়ের শেষে ‘শৈল-জলের গান’ শিরোনামে ২২টি অণুকবিতার একটি গুচ্ছ সন্নিবেশিত হয়েছে। অন্য সব কবিতা থেকে এর বিষয়-বৈচিত্র্য একেবারেই আলাদা। ‘শৈল-জলের গান’ কবিতাগুচ্ছ তাই গ্রন্থটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে বলে মনে করি। এই কবিতাগুলোতে উঠে এসেছে পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবন, তাদের সুখ-দুঃখ, প্রেম, আবেগ-অনুভূতি, সারল্য, বীরত্ব, জীবনাচরণ, ঐতিহ্য, উপকথা, সংস্কৃতি, বাক্য, খাদ্যাভ্যাস, পাহাড় ও পাহাড়ি জনপদের বর্ণনা। কবিতায় ব্যবহৃত অনুষঙ্গ এবং এর বর্ণনা ও আদিবাসীদের জীবনসংশ্লিষ্ট নানা শব্দের ব্যবহার খুবই প্রাসঙ্গিক, জীবন্ত ও যথাযথ হয়ে উঠেছে। যেমন
জলকে এসেছে জুমিয়ার বেটি একা
ছড়া হতে নিবে ঠান্ডা জলের ভারা
দামাল গাবুর উঁকি দিল আড় থেকে
রিছং ঝরছে মেতে আছি দিন-সারা। (পৃষ্ঠা ৫৯)
‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’ পড়ার মধ্য দিয়ে পাঠক নতুন এক কবিকে চিনবেন বলেই আমার মনে হয়।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]