পাতার গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মায়ের নাম নন্দিনী৷ বাবা জাফরান৷ দুজনেই কবি৷ তাদের মেয়ের নাম পাতা৷ মানুষের নাম আবার পাতা হয় নাকি? হয় না কেন? দুজন কবি যদি একসঙ্গে এক ঘরে থাকে, তখন অনেক অসম্ভব ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলতে পারে তারা৷ পাতার নাম শুনে অনেকেই অবাক হয়৷ বেশির ভাগ মানুষ নামটা শুনে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে, ‘কী বললে? পাতা?’ তারপর নিশ্চিত হয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করে—বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো৷ পাতা এই মুগ্ধতা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত৷ নতুন কারও কাছে নিজের নাম বলে সে অপেক্ষা করে দ্বিতীয়বার প্রশ্নটি শোনার জন্য৷ তার পরে অপেক্ষা প্রশংসা শোনার৷ কিন্তু একদিন একটা অন্য ব্যাপার ঘটল৷ সেদিন তাদের বাসায় এল আরেকজন কবি৷ কিন্তু মা-বাবার মতো নয়৷ একটু অন্য রকম৷ কাঁধ অবধি লম্বা চুল৷ ঝুঁটি বাঁধা৷ কথা বলে চিৎকার করে৷ হাসে হো হো করে৷ ছোটদের মতো লাফায়৷ পাতাকে দেখেই মুগ্ধ৷ নাম জিজ্ঞেস করার আগেই পাতাকে বলল, ‘আমি কে জানো? আমি তোমার বন্ধু৷ আমার নাম আকাশ৷’ পাতা তো অবাক৷ তার নাম জানে না৷ আগে কোনো দিন দেখেওনি৷ অমনি বন্ধু হয়ে গেল? মনে মনে হাসল সে৷ কোনো জবাব না পেয়ে নতুন কবি আবার মুখ খুলল, ‘কী, আমার নামটা তোমার পছন্দ হয়েছে? খুব সুন্দর নাম, তাই না?’
এবার হেসে উঠল পাতা৷ নিজের নামের প্রশংসা কেউ এভাবে করে? এখনো তার নামটা শোনেনি৷ শুনলে বড় গলায় নিজেরটা আর বলত না৷ তাড়াতাড়ি তাই বলে উঠল, ‘আমার নাম পাতা৷’
অমনি চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে উঠল আকাশের৷ চুপ থেকে পাতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ৷ পরে বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও৷ তোমার নাম পাতা৷’ তারপর বেশ কয়েকবার বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, ‘পাতা...পাতা...পাতা...কিন্তু তুমি কোন পাতা?’
এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি কোনো দিন হয়নি দুই কবির মেয়ে৷ অবাক হয়ে তাই বলল, ‘মানে?’
‘মানে, তুমি কোন পাতা? বৃক্ষের? বইয়ের?’
এবার ভারি চিন্তায় পড়ে গেল পাতা৷ তাই তো, সে কিসের পাতা? এ কথা তো কোনো দিন ভাবেনি৷
আকাশ তাকে তাগাদা দিয়ে বলল, ‘আমার কান পাতা আছে তোমার উত্তর শোনার জন্য৷’
খুব বেশি সময় নেয়নি৷ দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল৷ তারপর জবাব দিল, ‘আমি হচ্ছি গাছের পাতা৷’
‘তাই, আমি মনে মনে ভাবছিলাম গাছের সবুজ পাতাই হবে৷ এবার বলো, তুমি কী ফুলগাছের পাতা, নাকি কোনো ফলের গাছের?’
নিজের নাম নিয়ে কেউ কি এত কিছু ভাবে? এখন যদি বলে সে ফুলগাছের পাতা, তখন হয়তো আবার জিজ্ঞেস করবে, সেটি কোন ফুল৷ তাই উত্তর দেওয়ার আগে খুব করে ভাবছে পাতা৷
কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করেই মুখে কথার খই ফুটিয়ে চলেছে মানুষটা, ‘আমার মনে হয়, তুমি ফুলগাছের পাতা৷ সেখানে আমার আবার অনেক প্রশ্ন আছে৷ তুমি কি বড় কোনো ফুলগাছ? যেমন: পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, কাঠগোলাপ৷ নাকি ছোট ছোট ফুলের গাছ? যেমন: গোলাপ, বেলি, টগর৷ তার পরও প্রশ্ন আছে৷ তুমি যে গাছের পাতা, সে গাছের ফুলে কি সৌরভ আছে, নাকি শুধু সৌন্দর্য আছে? সেই ফুল কি সারা বছর ফোটে, নাকি বছরের কোনো এক সময়ে ফোটে?’
এত প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না৷ তাড়াতাড়ি তাই সে বলে উঠল, ‘আমি আসলে বইয়ের পাতা৷’
‘ওহ তাই বলো’ বলেই উচ্চ স্বরে হেসে উঠল লোকটা—‘তুমি বইয়ের...বেশ বেশ, তা তুমি কি কোনো স্কুলের পাঠ্যবই? নাকি গল্প-ছড়ার বই৷’
এবার একটু রেগে গেল পাতা৷ তাতেও অনেক প্রশ্ন আছে, তাই না? গল্পের বই হলে কোন ধরনের গল্প৷ ভূতের গল্প, নাকি রাজার গল্প? সুখের গল্প, নাকি দুঃখের গল্প, তাই না?
‘আমি কোনো কিছুর উত্তর দেব না৷ তোমার সঙ্গে কোনো কথা নেই৷’
এমন সময় আরেক ঘর থেকে দৌড়ে এল বাবা৷ এসেই কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল—
‘বিশ্বপাতা আমায় দিল মনের মতো পাতা
এই হৃদয়ে তার জন্য একটি আসন পাতা’

এবারও হো হো করে হেসে উঠল আকাশ৷ বলল, ‘আচ্ছা! আমাদের দুজনের কথায় আড়ি পাতা হচ্ছে৷’
বাবা আর আকাশের কথার কিছুই বুঝল না পাতা৷ তাই জানতে চাইল বাবার কাছে, ‘তুমি কি আমাকে নিয়েই কবিতাটি লিখেছ? এত কঠিন কেন? বিশ্বপাতা আবার কী?’
এবার বাবাও জোরে জোরে হাসতে লাগল৷ তারপর পাতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বিশ্বপাতা মানে প্রভু৷ প্রভু আমায় তোমাকে দিয়েছে৷ তোমার জন্য আমার হৃদয়ে একটি জায়গা আছে৷ সেই কথায় বললাম কবিতায়৷’
একটু লজ্জা পেল, আবার খুশিও হলো বাবার কথায়৷ কিন্তু লোকটি এত প্রশ্ন করে তার মাথাটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে৷ আসলেই তো ঠিক৷ সে কোন পাতা৷ বাবার কাছে জানতে চায় সে৷
‘আমার মেয়ে গাছের পাতা নয়, বইয়ের পাতাও নয়’ ও ঘর থেকে মা এসে যোগ দেয় তিনজনের আড্ডায়৷ ওড়নায় হাত মুখ মুছতে মুছতে নন্দিনী বলল, ‘ও আমাদের চোখের পাতা৷’
অমনি মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটি৷