পারের প্রতীক্ষা

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ঠাকুরদার বয়স হয়েছে। দুমড়েমুচড়ে গেছেন। নতুন হাঁটতে শেখা শিশুর মতো কাঁপতে কাঁপতে উঠানে এসে বসেন। আগে চোখে চশমা ছিল, এখন পরেন না। গ্লুকোমায় চোখ দুটো গেছে। ঘন ঘন চোখের জল আর পিঁচুটি মোছেন। দাঁতমুক্ত কপাটি দুটো সামনে-পেছনে আসা-যাওয়া করে। এদের নিয়ন্ত্রণ হয়তো তার হাতে নেই। থোবড়ানো গালে মাছি বসার মতো জায়গা পায় না। শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত গায়ে একটা কাশ্মীরি শাল আর মাথায় ওলের টুপি।

‘মনু নি বে।’

‘অয়।’

‘কবে আইলি?’

‘কাইল।’

‘ছুটি নি?’

‘অয়।’

‘কিতার ছুটি।’

‘ব্যামার লাগছে। ব্যামারোর ছুটি।’

এভাবে উঠান দিয়ে যে আসে-যায়, তাকেই প্রশ্ন করেন। পায়ের শব্দ শুনেই তিনি বুঝে যান কে এসেছে। এখন বাড়িভর্তি মানুষ। তাই তার খনখনে গলার আওয়াজ সর্বক্ষণ শোনা যায়। মানুষজন বিরক্ত হয়। তিনি গ্রাহ্য করেন না।

এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। নিবারণের পোয়াতি বউ ঢাকা থেকে এসে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। করোনার জন্য হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধ। অনেক কষ্টে নিবারণের বউ এ যাত্রায় উদ্ধার পেয়েছে। সদর থেকে গুড়ের সন্দেশ আনা হলো। টের পেয়ে ঠাকুরদাও চেয়ে বসলেন কার কাছে যেন।

‘কিতার মিষ্টি বে?’

‘নিবারণের পুত হইছে।’

‘ও! এর লাগি নি?’

তারপর নিজের মধ্যে ডুব গিয়ে বলতে থাকেন, ‘এ তো বড় দুঃখের বিষয়। একটা আত্মা জীবন-মৃত্যুর শৃঙ্খল থাকি মুক্তি ফার না...জন্ম মিথ্যা। মৃত্যু সইত্য। মুক্তি সইত্য।’

ঠাকুরদা ভেঙেচুরে যাওয়া মুখখানা নিয়ে আপনমনে কথা বলে যান। কেউ তার কথায় কান দেয় না।

একসময় ঠাকুরদা সারা দিন লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা আর রামকৃষ্ণ কথামৃত নিয়ে বসে থাকতেন। কী সব গ্রহ-নক্ষত্র, কালবেলা-বারবেলা, প্রতিপদ-পূর্ণিমার হিসাব কষতেন। কেউ ঘর থেকে বেরোনোর আগে লগ্ন দেখতেন। অবশ্য কেউ তার গায়েপড়ে দেওয়া পরামর্শ গ্রহণ করত না। তিনি আপনমনে ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে...’ বলে পঞ্জিকার পাতা ওলটাতেন।

দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার পর তার সেই আত্মমগ্ন হওয়ার কাজগুলোতে ছেদ পড়েছে। মধ্যে খুব অসুখ হয়েছিল। যমে-মানুষে টানাটানি। বিছানায় শুতে শুতে গায়ে-পিঠে ঘা হয়ে গিয়েছিল।

নন্দ জেঠা সম্পর্কে ঠাকুরদার ছোট হলেও বয়সে বড়। ঠাকুরদার বাবার বিয়ের ফিরা-যাত্রার সময় তার বয়স নাকি দুই। তিনি ন্যাংটা অবস্থায় পুরোনো শেভ্রলেট গাড়ির ডিকিতে চড়ে বসেছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছার পর এই নগ্ন বরযাত্রী উদ্ধার পায়। সেসব গল্প বলে এখনো জেঠা হাসাহাসি করেন।

নন্দ জেঠা এসে প্রস্তাব দিলেন, ‘কাকা, প্রায়শ্চিত্ত করো। মুক্তি নেও।’

‘পাপ লইয়া যাইতাম না বা। মুক্ত অইয়া যাইমু।’

ঠাকুরদা প্রায়শ্চিত্ত না করেই জীবনে ফিরে এলেন। কিছুদিনের মাথায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসলেন।

সারা দিন একটা মানুষ কীভাবে উঠানে বসে থাকে, একসময় আমাদের কাছে ব্যাপারটা বিস্ময়ের মনে হতো। কোনো কাজকর্ম নেই। শুধু নিয়ম করে তিন বেলা খাওয়া। অনির্দিষ্টকালের ছুটি পেয়ে এখন সবাই আমরা গ্রামের বাড়িতে। বাড়িভর্তি মানুষ অনেকটা ঠাকুরদার মতো শুয়ে-বসে সময় কাটায়।

এখন ঠাকুরদার মাথায় বাই উঠেছে, তিনি বাইরে যাবেন। কী এক মুসিবতের কথা! সবাই যখন ঘরে আটক, তিনি যাবেন বাইরে। আমরা মৃদু তিরস্কার দিয়ে তাকে নিবৃত্ত করি।

তিনি বিড়বিড় করে বলে চলেন, ‘হরি আইছুন, আমারে একটু দেখা করাইয়া দে। যাইতাম গিয়া।’

নাতি-নাতনিরা তার হঠকারিতায় বিরক্ত হয়। এর মধ্যে ঘটল আরেক ঘটনা। পাশের ঘরের নন্দ জেঠার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলো। হাসপাতালে নেওয়ার সময় হয়নি। বাড়িতেই মারা গেলেন। আমরা সবাই ছুটে গেলাম। ঠাকুরদা ছাড়া। তাকে জানানোও হলো না। শৈশবের খেলার সাথি। একে হারানোর শোক তিনি সামলাতে পারবেন না। এক বাড়িতে দুই মড়া নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে কে?

বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে খাটিয়ার মতো বানানো হলো শব নিয়ে যাওয়ার জন্য। একটা আমগাছ কাটা হলো। ক্রিয়া করার জন্য ডাকা হলো ব্রাহ্মণ। আলুর মধ্যে ধূপকাঠি গেঁথে জেঠার মাথার কাছে রাখা হলো। সঙ্গে একটা তুলসীর চারা। বুকে রাখা হলো গীতা। বাড়ির সবাই শব ঘিরে কাঁদছে। স্নানের আয়োজন শুরু হবে। শব নিয়ে যাওয়া হবে খাটিয়ায় তুলে। এমন সময় বাচ্চাদের হাঁকডাকে সবাই চমকে উঠল।

আমাদের দোমড়ানো-মোচড়ানো ঠাকুরদা কাঠের পুতুলের মতো কেঁপে কেঁপে আমাদের দিকে আসছেন। কী ভয়ংকর ব্যাপার!

দৌড়ে গেলাম তার কাছে। দেখি তিনি হাসছেন।

‘উঠি আইলায় ক্যানে?’

‘হরি আইছইন হরি, দেখতাম।’