পুনশ্চ প্যারিসে হেমিংওয়ে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য ‘কোলিয়ার্স’ ম্যাগাজিন নিয়োগ করেছিল বিশ্ববরেণ্য লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে। তবে প্যারিসে পা দেওয়ার আগে থেকেই সাংবাদিক বা লেখকসুলভ আচরণ নয়, প্রশিক্ষিত সৈনিকের মতো আচরণ করতে শুরু করেন নোবেলজয়ী এই কথাসাহিত্যিক। এক অজানা অধ্যায়ের উন্মোচন।

প্যারিসে ঢোকার আগে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছবি অবলম্বনেকোলাজ: মনিরুল ইসলাম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ইউরোপ রণাঙ্গন থেকে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য ‘কোলিয়ার্স’ ম্যাগাজিন আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে নিয়োগ করেছিল। নর্ম্যান্ডিতে মিত্রবাহিনীর সফল অভিযানে কোনো বেসামরিক লোকের উপকূলে নামার অধিকার ছিল না, এমনকি সাংবাদিকদেরও নয়। সুতরাং ভূমিতে পা না রেখেই জাহাজ থেকে মিত্রবাহিনীর সেনাদলের ঝটিকা অবতরণের দৃশ্য দেখতে হয় হেমিংওয়ে এবং অন্য সাংবাদিকদের। এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই লন্ডনে ফিরে গিয়ে কাগজের জন্য রিপোর্ট লিখতে হয়েছিল তাঁকে। পরের মাসে ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে মিত্রবাহিনীর চতুর্থ গোলন্দাজ বাহিনীর সঙ্গে জুটে যান তিনি। তাঁর আপাতগন্তব্য স্মৃতিবিজড়িত শহর প্যারিস। আমরা জানি, প্রথম যৌবনে স্ত্রী হ্যাডলিকে নিয়ে প্যারিসে প্রায় সাত বছর অতিবাহিত করেছিলেন তিনি। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর লেখকজীবনের পথচলা। প্রথমবার প্যারিসে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর এখানে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর উপন্যাস ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ ও ‘দ্য টরেন্টস অব স্প্রিং’, গল্পগ্রন্থ ‘থ্রি স্টোরিজ অ্যান্ড টেন পোয়েমস’, ‘মেন উইদাউট ওমেন’ এবং নন-ফিকশন ‘ইন্ডিয়ান ক্যাম্প’।

প্যারিস অভিমুখে যাত্রাপথে ভিউদিউলি পোয়েল শহরে পৌঁছানোর পর সাইড কারসহ অধিকৃত একটা জার্মান মোটরসাইকেল পেয়ে যান তিনি। জার্মান সৈনিকেরা তখনো এখানে-সেখানে ঘাপটি মেরে ছিল। হেমিংওয়ে জার্মানদের অবস্থান সম্পর্কে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারেন যে এক বাড়ির সেলারে এসএস বাহিনীর কিছু সৈনিক লুকিয়ে থাকতে পারে। কয়েকটা গ্রেনেড হাতে সেই বাড়িতে গিয়ে সেলারের সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে হেমিংওয়ে ভাঙা জার্মানে চিৎকার করে বলেন, ‘মাথার ওপর হাত তুলে বেরিয়ে এসো।’ দুবার একই কথা বলার পরও নিচ থেকে কোনো সাড়া না এলে পিন খুলে হাতের গ্রেনেডগুলো একে একে সেলারের ভেতরে ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘তাহলে এগুলো ভাগ করে নাও তোমরা।’ সেই সেলারে কোনো জার্মান সৈন্য আদৌ ছিল কি না, জানা যায়নি, হেমিংওয়েও তাঁর হামলার ফলাফল দেখার জন্য নিচে নামেননি। পরে গর্ব করে বলতেন যে বহু নাৎসি হত্যা করেছেন তিনি। তাঁর হাতে জার্মান সৈন্য মারা পড়ুক বা না পড়ুক, শহরটিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য হেমিংওয়ের এহেন কাজ দেখে নগরের মেয়র তাঁকে কোনো মার্কিন জেনারেল মনে করে কয়েক বোতল শ্যাম্পেন উপহার দিয়েছিলেন। (সূত্র: স্টিভ নিউম্যান, ‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ে—গোয়িং দ্য আদারওয়ে ফ্রম হোম’, ‘মিডিয়াম’, ২৮ নভেম্বর, ২০১৮)

এভাবে প্যারিসের উপকণ্ঠে রামবুয়ে শহর পর্যন্ত পৌঁছে যান আর্নেস্ট। উদ্দেশ্য, মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে স্মৃতিবিজড়িত প্যারিসে ঢুকতে পারেন তিনি। এখানে স্থানীয় এক প্রতিরোধ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন বলে দাবি করেন হেমিংওয়ে। তবে দাবিটি একেবারেই অসার নয়, সে সময়কার সতীর্থ কয়েকজন সাংবাদিকের ভাষ্যে তার প্রমাণ মেলে। এই বাহিনীকে পশ্চাদপসরণরত জার্মান বাহিনীর গতিবিধির ওপর নজর রাখার কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি, সংগৃহীত সেই খবর পৌঁছে দিতেন অগ্রবর্তী মার্কিন বাহিনীর কমান্ডিং অফিসারের কাছে। এ ছাড়া তাঁর ভূমিকা ছিল প্রতিরোধ বাহিনী এবং মার্কিন নিয়মিত বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় রক্ষা, স্থানীয় মানুষ এবং মার্কিন বাহিনীর মধ্যে দোভাষীর কাজ এবং ধৃত জার্মান সৈনিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, জার্মান বাহিনী পশ্চাদপসরণ করলেও দলছুট শত্রুসৈন্যরা তখনো গ্রামাঞ্চলে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করছিল। সাংবাদিকতার কাজ বাদ দিয়ে হেমিংওয়ের এসব কার্যকলাপের কারণে তাঁর সতীর্থ সাংবাদিকেরা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন তাঁর ওপর। সেখানে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বলে তাঁর জেনেভা কনভেশনের নীতিমালা লঙ্ঘনের বিষয়টি ছিল আরও চোখে পড়ার মতো।

হেমিংওয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় কর্নেল চার্লস ল্যানহামের। এক রাতে ছোট একটা ফার্মহাউসের অস্থায়ী শিবিরে টেবিলের ওপর ম্যাপ বিছিয়ে পরদিন সামনে এগোনোর রাস্তা দেখছিলেন ল্যানহাম। এমন সময় তাঁর অপারেশনস অফিসার এসে খবর দেন যে ওয়াশিংটন থেকে কর্নেল কোলিয়ার্স বলে একজন দেখা করতে চান। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে দাড়িওয়ালা বিশালদেহী যিনি ঢোকেন, তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে জেনারেল ল্যানহাম বলেন, ‘কর্নেল কোলিয়ার্স?’ আগন্তুক বলেন, ‘আমি কোনো কর্নেল নই। আমি কোলিয়ার্স কাগজের প্রতিনিধি। আমার নাম হেমিংওয়ে।’ ল্যানহাম একটু মজা করেই বলেন, ‘আর্নেস্ট নিঃসন্দেহে, তাই না?’ আগন্তুক বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার নাম আর্নেস্ট।’

এ সময় হেমিংওয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় কর্নেল চার্লস ল্যানহামের। এক রাতে ছোট একটা ফার্মহাউসের অস্থায়ী শিবিরে টেবিলের ওপর ম্যাপ বিছিয়ে পরদিন সামনে এগোনোর রাস্তা দেখছিলেন ল্যানহাম। এমন সময় তাঁর অপারেশনস অফিসার এসে খবর দেন যে ওয়াশিংটন থেকে কর্নেল কোলিয়ার্স বলে একজন দেখা করতে চান।

ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে দাড়িওয়ালা বিশালদেহী যিনি ঢোকেন, তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে জেনারেল ল্যানহাম বলেন, ‘কর্নেল কোলিয়ার্স?’ আগন্তুক বলেন, ‘আমি কোনো কর্নেল নই। আমি কোলিয়ার্স কাগজের প্রতিনিধি। আমার নাম হেমিংওয়ে।’ ল্যানহাম একটু মজা করেই বলেন, ‘আর্নেস্ট নিঃসন্দেহে, তাই না?’ আগন্তুক বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার নাম আর্নেস্ট।’ ল্যানহাম এবার চিনতে পারেন লেখক হেমিংওয়েকে। তিনি নিজেও ছোটগল্প লেখেন, কবিতাও ছাপা হয়েছে কিছু। সেই দেখা থেকে দুজনের মধ্যে সৃষ্টি হয় বন্ধুত্ব। যুদ্ধ শেষে ল্যানহাম সাহিত্য ও নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলতে চাইতেন তাঁর সঙ্গে। অন্যদিকে হেমিংওয়ে চাইতেন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে। লেখক হেমিংওয়ের আগ্রহ ছিল যুদ্ধে, আর যোদ্ধা ল্যানহাম চাইতেন লিখতে। সদ্য পরিচিত এই বন্ধুর কনভয়ের সঙ্গে প্যারিসের দিকে কিছুদূর এগোনোর সুযোগ পেয়েছিলেন হেমিংওয়ে। (সূত্র: স্টিভ নিউম্যান, প্রাগুক্ত)

পরে অবশ্য বিচ্ছিন্নভাবে নানান কায়দায় স্থানীয় মানুষ এবং বেসামরিক প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে মিশে গিয়ে নানান শহর ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন হেমিংওয়ে। পথে পথে নানান পানশালা ও ক্যাফেতে যাত্রাবিরতি করার কারণে স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছিল তাঁদের। এ সময় হেমিংওয়ের বেশভূষাও ছিল চোখে পড়ার মতো। মাথায় হেলমেট, মিলিশিয়াদের মতো পোশাকে তাঁকে বিশ্ববিখ্যাত লেখকের চেয়ে বেশি মনে হচ্ছিল সেনাবাহিনীর কোনো নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার মতো। একটা অস্ত্রও বহন করতেন তিনি। এই অস্ত্র দিয়ে বহু জার্মান সৈনিক মেরেছেন বলে দাবি করলেও তাঁর সঙ্গে থাকা কেউই এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি।

প্যারিসের নিকটবর্তী হওয়ার পর মার্কিন বাহিনীর কনভয় ছেড়ে কিছু সাংবাদিক ও তাঁর ‘অধীন’ প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মেশিনগান লাগানো জিপে চড়ে রিৎজ হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হন হেমিংওয়ে। ভেতরে ঢোকার মুখে হোটেলের ম্যানেজার এগিয়ে এলে তিনি জানতে চান, জার্মান সেনারা কোথায়, হোটেলটি মুক্ত করতে এসেছেন তিনি। ম্যানেজার তাঁকে ভালো করেই চেনেন, তাই বিনীত কণ্ঠে জানান, ‘মসিঁয়ে, ওরা তো বহু আগেই হোটেল ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আমি অস্ত্র নিয়ে আপনাকে হোটেলে ঢুকতে দিতে পারি না।’ (এ ঘটনাটি বিভিন্ন ভাষ্যে অবিকল এ রকমই পাওয়া গেছে, তবে মূল উৎসের উল্লেখ পাওয়া যায়নি)।

প্যারিসের উপকণ্ঠে আলোকচিত্রী রবার্ট কাপা ও জিপ ড্রাইভারের সঙ্গে
ছবি: সংগৃহীত

অগত্যা অস্ত্র বাইরে রেখে বারে ঢুকে মুক্ত প্যারিসে প্রথম শ্যাম্পেন খান হেমিংওয়ে। মিত্রবাহিনীর মধ্যে সমঝোতা ছিল যে প্যারিসে বিজয়ী হিসেবে প্রথমে ঢুকবে ফরাসি বাহিনী। হেমিংওয়ে এই সমঝোতার কথা জানতেন না বলেই সবার আগে তাঁর পুরোনো ঠেক রিৎজ মুক্ত করার এই কসরত। রিৎজ কেবল তাঁর স্মৃতিবিজড়িত জায়গাই নয়, জার্মান অধিকৃত অবস্থায় গোয়েরিং ও গোয়েবলসের মতো সেনাকর্তারাসহ নাৎসি বাহিনীর বড় চাঁইরা নিত্য গলা ভেজাতে আসতেন এখানে। তাই এটি মুক্ত করার অভিপ্রায় একটা প্রতীকী ব্যাপারও ছিল।

রিৎজ হোটেলে ঘাঁটি গাড়ার পরদিন পরিচিত লেখক ও সাংবাদিকদের লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানান হেমিংওয়ে। মিত্রবাহিনী ঢোকার আগেই তাঁর কথিত বাহিনী নিয়ে প্যারিসে ঢুকে পড়া, সাংবাদিক হিসেবে বেসামরিক ব্যাজ খুলে ফেলে অস্ত্র বহন করা—এসবই ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি একপর্যায়ে তিনি নিজেকে কর্নেল বলে পরিচয় দিয়েছেন—এমন অভিযোগও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তাঁর সতীর্থ সাংবাদিকেরা এসব বিষয়ে কিছুটা বিব্রতও ছিলেন, কিন্তু তাঁর মাপের খ্যাতিমান একজন লেখকের মুখের ওপর তো আর কিছু বলা যায় না! তবে এসবে হেলদোল ছিল না তাঁর। মজার ব্যাপার, হেমিংওয়ের তৃতীয় স্ত্রী মার্থা এবং নতুন প্রেমিকা মেরি ওয়েলশ দুজনই এ সময় প্যারিসে এসে পৌঁছান।

প্যারিসে পৌঁছে মেরি তাঁর সতীর্থ সাংবাদিক ও বন্ধুদের সঙ্গে অ্যালায়েড প্রেসের হেডকোয়ার্টার হোটেল স্কিবেতে ওঠেন। কাজে নামার আগে হেমিংওয়ের খোঁজে তিনি রিৎজ হোটেলে ঢুঁ মারেন একবার। কয়েক মাস পর দেখা হওয়ার পর দুজনই উচ্ছ্বসিত, তাঁকে জড়িয়ে ধরে মাটি থেকে তুলে কয়েক পাক ঘুরে নেন হেমিংওয়ে। সেদিন কোনোরকমে স্কিবে হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন রিৎজে এসে উঠেছিলেন মেরি, তবে হেমিংওয়ের রুমে নয়, চারতলা ওপরের আলাদা রুমে। অবশ্য তাতে তাঁদের মেলামেশার ঘনিষ্ঠতায় কোনো বাধা হয়নি। যৌবনের শহর প্যারিসে মেরি ওয়েলশের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে হেমিংওয়ে যেন ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর প্রথম প্রেমের স্মৃতি। মেরিকে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান গারট্রুড স্টাইনের বাড়ি, পিকাসোর স্টুডিওসহ তাঁর স্মৃতিবিজড়িত প্রিয় জায়গাগুলোতে। এমনকি কোমর থেকে ওপরের দিকে মেরির একখানা ন্যুড ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য পিকাসোকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি। শিল্পী রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি আর। যদি হতো, তাহলে পিকাসোর আরেকখানা ঐতিহাসিক ছবি দেখতে পেতাম আমরা।

নর্ম্যান্ডি অপারেশনের পর মিত্রবাহিনীর অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক হিসেবে তিনি যখন প্যারিস অভিমুখে রওনা হন, তখন অসাংবাদিকসুলভ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের জন্য তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মার্কিন বাহিনীর থার্ড আর্মির ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল ক্ল্যারেন্স পার্ক তাঁকে তলব করেন, যাতে নির্দিষ্ট তারিখে (৪ অক্টোবর ১৯৪৪) শুনানির জন্য উপস্থিত থাকেন তিনি। হেমিংওয়ে যে জেনেভা কনভেনশনের নীতিমালা ভেঙে অস্ত্র বহন করেছেন এবং একজন নিয়মিত সৈনিকের মতো যুদ্ধে পক্ষাবলম্বন করেছেন, এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। হেডকোয়ার্টার থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল যাতে ঠিকমতো ধরা হয় হেমিংওয়েকে, কিন্তু পরে বলা হয়, এ ঘটনা নিয়ে যাতে বাড়াবাড়ি করা না হয়। এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে আমেরিকান বাহিনীর বদনাম হয়।
প্যারিসের রিৎজ হোটেলের মূল দরজা
ছবি: সংগৃহীত

এ সময় একদিন ফোনে মার্থা গেলহর্নকে খুব আন্তরিকভাবে ডিনারের আমন্ত্রণ জানান হেমিংওয়ে, সঙ্গে আরও কিছু বন্ধুকেও বলেছিলেন। মার্থা বেশ অবাক, কিন্তু লোকটির জন্য ভেতরে তখনো কিছু দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল তাঁর। ভেবেছিলেন স্বামীর যৌবনের শহরে এসে আট বছর আগে প্রথম দেখা সেই পরিচিতরূপেই পাবেন লোকটিকে। তাই সব বিতৃষ্ণা ভুলে গিয়ে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন মার্থা। যুদ্ধবিধ্বস্ত নিঃসঙ্গ এই শহরে সে মুহূর্তে হেমিংওয়ে ছাড়া তাঁর কাছের আর কেউ ছিল না।

সন্ধ্যার ছোট সম্মিলনটি ঠিকমতোই চলছিল। যুদ্ধের মজার সব অভিজ্ঞতা এবং ল্যানহামের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি হেমিংওয়ে।

তারপর একসময় প্রসঙ্গ বদলে যায়, ক্রমে মার্থার প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে ওঠেন, ব্যক্তি, স্ত্রী ও লেখিকা মার্থাকে আক্রমণ করতে শুরু করেন তিনি। এমনও বলেন যে ভালো নারী লেখক বলে আসলে কোনো কিছু নেই। পরিবেশটা এমন হয়ে ওঠে যে তাঁর অতিথিরা একে একে উঠে চলে যান। ওঁদের চলে যাওয়ার জন্যও মার্থাকে দোষারোপ করেন হেমিংওয়ে। মার্থার জেগে ওঠা ভালোবাসা ক্রোধ ও ঘৃণায় পরিণত হতে সময় লাগে না। ওঁরা একা হয়ে যাওয়ার পর অপমানিত মার্থা আবারও একবার ডিভোর্স চাইলে হেমিংওয়ে যথারীতি অস্বীকার করেন। মার্থার করণীয় কিছুই ছিল না, তাই কিউবাতে যেমন করেছিলেন, সেভাবে গ্লাসের ড্রিংকসের বাকিটুকু হেমিংওয়ের মাথায় ঢেলে দিয়ে চলে আসেন তিনি। বিপর্যস্ত ও হতাশ মার্থা হোটেলে ফেরেন, বুঝতে পারছিলেন না কেন তাঁকে ডিনারে ডেকেছিলেন হেমিংওয়ে, কেনই-বা তাঁর প্রতি এমন আক্রমণ? লোকটি কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? মার্থা তখনো জানতেন না, পরিকল্পিতভাবে আত্মঘাতী হওয়ার মতো মানসিক উপাদান হেমিংওয়ের মাথায় ছিল।

হোটেলের বারে ফটোসাংবাদিক রবার্ট কাপার সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। হেমিংওয়ের কাণ্ডকারখানার সঙ্গে কাপা খুব ভালোভাবেই পরিচিত, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়ে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। মার্থা কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না, কান্নাজড়িত কণ্ঠে সন্ধ্যার সবকিছু খুলে বলেন কাপাকে। কাপা সে সময় পোকার খেলায় বিরাট দান মেরে পাওয়া টাকা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি মার্থাকে বলেন, রিৎজ হোটেলে মেরির রুমে যাতে একটা ফোন করেন তিনি। ফোনটা যদি হেমিংওয়ে ওঠান, তাহলে কী করতে হবে, সেটা তখন ঠিক করা হবে। মার্থা ফোন করলে ওপাশ থেকে হেমিংওয়ে ফোন ওঠান, মার্থা বলেন, ‘হ্যালো আর্নেস্ট।’ তারপর কাপার ইশারায় ফোনটা নামিয়ে রাখেন। কাপা বলেন, ‘এখন দেখেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ হয়েছিলও তা-ই, কয়েক দিনের মধ্যেই হেমিংওয়ে ডিভোর্সে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। (সূত্র: স্টিভ নিউম্যান, প্রাগুক্ত)
যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউরোপীয় রণাঙ্গন সম্পর্কে হেমিংওয়ে যে বিশেষ কোনো খবর রাখেন না, সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে মেরি ওয়েলশের সঙ্গে তাঁর প্রথম একান্ত সাক্ষাতে। তবু নর্ম্যান্ডি অপারেশনের পর মিত্রবাহিনীর অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক হিসেবে তিনি যখন প্যারিস অভিমুখে রওনা হন, তখন অসাংবাদিকসুলভ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের জন্য তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মার্কিন বাহিনীর থার্ড আর্মির ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল ক্ল্যারেন্স পার্ক তাঁকে তলব করেন, যাতে নির্দিষ্ট তারিখে (৪ অক্টোবর ১৯৪৪) শুনানির জন্য উপস্থিত থাকেন তিনি।

হেমিংওয়ে যে জেনেভা কনভেনশনের নীতিমালা ভেঙে অস্ত্র বহন করেছেন এবং একজন নিয়মিত সৈনিকের মতো যুদ্ধে পক্ষাবলম্বন করেছেন, এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। হেডকোয়ার্টার থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল যাতে ঠিকমতো ধরা হয় হেমিংওয়েকে, কিন্তু পরে বলা হয়, এ ঘটনা নিয়ে যাতে বাড়াবাড়ি করা না হয়।

এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে আমেরিকান বাহিনীর বদনাম হয়। কিন্তু তাঁর কী করার আছে? সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যাচ্ছে হেমিংওয়ে নিঃসন্দেহে অপরাধী। অস্ত্র বহন করার ব্যাপারে হেমিংওয়ের একটা যুক্তি হয়তো থাকতে পারে যে কিউবার উপকূলে জার্মান ইউবোট খোঁজার কাজে এফবিআই তাঁকে ফিল্ড এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল বলে অস্ত্র বহন করার অধিকার তিনি পেয়ে গেছেন, এমনটি ধরে নিতে পারেন।

অভিযোগগুলো যেহেতু মিথ্যা ছিল না, হেমিংওয়ে আশঙ্কা করেন যে তাঁকে হয়তো বহিষ্কার করা হতে পারে। তাই তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তি খাড়া করতে হয়।

তিনি জানান যে প্রতিরোধ বাহিনীর অস্ত্রগুলো তাঁর কাছে রাখতে হয়েছিল, কারণ, সেসব রাখার মতো কোনো উপযুক্ত জায়গা তাঁদের ছিল না। সঙ্গে যে বন্দুক রাখতেন, সেটা অস্বীকার করা যায় না, তাই বলেন যে অস্ত্র রাখলেও কখনোই কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি তিনি। প্রতিরোধ বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল যে তিনি কেবল বাহিনীর উপদেষ্টা ছিলেন। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী হেমিংওয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলেও শেষাবধি তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছিল। কারণ, তাঁর মতো একজন বিশ্ববরেণ্য লেখকের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন মনে করেনি মার্কিন বাহিনীর হাইকমান্ড। বহু বছর পর (১৯৫১) ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় নিজের সে সময়কার ভূমিকার সমর্থনে তিনি লিখেছিলেন যে গেরিলাযুদ্ধ এবং প্রথাবিহীন সমর কৌশল সম্পর্কে তাঁর কিছু পরিমাণ জ্ঞান ছিল, সঙ্গে প্রচলিত যুদ্ধের কিছু প্রাথমিক জ্ঞানও।

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]