
‘হুযুর কেবলা’ আবুল মনসুর আহমদের (১৮৯৮-১৯৭৯) একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। উনিশ শ বিশের দশকে রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে আলোচ্য গল্প। প্রকাশের পর প্রায় শত বর্ষ কেটে গেছে, তবু এখনো অভিন্নমাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে গল্পটি। সমকালীন বাংলাদেশকে বুঝতে এ গল্প এখনো সমানমাত্রায় আলোকসম্পাত করতে পারে। ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীর স্বরূপ উন্মোচনের এ গল্প বাঙালি পাঠকের কাছে পেয়েছে বিপুল জনপ্রিয়তা।
‘হুযুর কেবলা’ গল্পে বাংলাদেশের গ্রামজীবনে প্রবলভাবে জেঁকে-বসা পীর ব্যবসার বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। এক ভণ্ড পীর, পীরের কতিপয় সাগরেদ, তাঁদের ভণ্ডামি ও মিথ্যাচার, পীরের রিরংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার শঠ-কৌশল এবং এক প্রতিবাদী যুবকের আখ্যান শিল্পিত হয়েছে আলোচ্য গল্পে। গল্পের অভ্যন্তরে প্রবেশের আগে একবার সংক্ষেপে চোখ ফেরানো যাক গল্পের ঘটনাংশের দিকে। দর্শনের ছাত্র এমদাদ হঠাৎ করেই যোগ দেয় অসহযোগ আন্দোলনে। কলেজজীবনে এমদাদ ছিল আধুনিক জীবনচেতনায় উদ্বুদ্ধ। এমদাদ পাঠ করত মিল, হিউম, স্পেন্সার, কোঁতের রচনা। এ কারণেই ধর্মীয় কোনো বিষয়ে তার বিশ্বাস ছিল না। আল্লাহ, রাসুল, খোদার আরশ, অহি, হজরতের মেরাজ—এর কোনো কিছুতেই তার বিশ্বাস নেই। এমদাদের কাছে এর সবকিছুই অলীক ও অসত্য—এ কারণে এসব বিষয় নিয়ে সে প্রায়ই হাসি-তামাশা করত। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের পর এমদাদ আমূল পাল্টে গেল। নামাজ আদায় করা, তসবি জপ করা—এসব কাজ সে পালন করতে লাগল নিষ্ঠার সঙ্গে। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো তসবির কারণে তার আঙুলে ক্ষত সৃষ্টি হলো, তবু সে ক্ষান্ত হলো না। কিন্তু এবাদতে এমদাদ কিছুতেই একাগ্র হতে পারল না। এ সময় এমদাদ সন্ধান পায় এক সুফির। সুফি সাহেব এমদাদের সমস্যা বুঝতে পারলেন। তিনি এমদাদকে পীরের মুরিদ হতে বললেন। সংসারের একমাত্র বন্ধন ফুফুকে কাঁদিয়ে সুফি সাহেবের সঙ্গে এমদাদ পীরের বাড়িতে চলে গেল।
পীর, যিনি এই গল্পের হুযুর কেবলা, নানা উপায়ে-কৌশলে এমদাদকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেন। পীরের আচরণ, ক্রিয়াকলাপ ও কল্পকাহিনি এমদাদকে বিস্ময়াভিভূত করে রাখে। পীরের মুরিদ হওয়ার পর সে পুনরায় এবাদত শুরু করে। সংযম ও কৃচ্ছÊসাধনায় তার শরীর দিনে দিনে ক্ষয়ে যেতে থাকে। পীরের বাড়ি থেকে চলে যাবে—এমন ভাবনা দেখা দেয় এমদাদের মনে। এ সময় ইংরেজি জানার কারণে পীরের সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ আসে এমদাদের। পীরের সঙ্গে মুরিদদের বাড়ি যাওয়ার পর গুরু ভোজনের কারণে এমদাদ অল্প দিনেই আগের স্বাস্থ্য ফিরে পেল। পীরের নানা কর্ম-কাণ্ডে সে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল পীরের আচার-আচরণ। পীর সাহেবের ভাত ভাঙার কসরত, অন্দরমহলে নারীদের ধর্মকথা শোনানোর কৌশল, বাড়িওয়ালার ছেলে রজবের সুন্দরী স্ত্রী কলিমনের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত, ফানাফিল্লার সময় ‘জ্বলিয়া গেলাম, পুড়িয়া গেলাম’ চিৎকার, নারী মহলে ওয়াজের সময় দাড়িতে চিরুনি ও কাপড়ে আতর লাগানো, সুফি বদরুদ্দীনের সঙ্গে মাঝেমধ্যে পীরের একান্ত কানাকানি—এসব ঘটনা ও দৃশ্য দেখে এমদাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে।
মুরিদদের পৌনঃপুনিক অনুরোধে পীর সাহেব একসময় তাঁর কেরামতি দেখাতে রাজি হলেন। মোরাকাবায় বসার জন্য মুরিদদের অনুরোধ করলে এমদাদ এগিয়ে আসে। কিন্তু উদ্দেশ্য সফল হবে না, তাই জিকরেখফা-আম না-করার অজুহাতে এমদাদকে মোরাকাবায় বসতে দিলেন না পীর সাহেব। শেষ পর্যন্ত সুফি বদরুদ্দীন মোরাকাবায় বসলেন। বদরুদ্দীনের দেহে আনা হলো হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর রুহ। এই রুহই বলেন যে, পীর সাহেবের আরও একটা বিয়ে করা প্রয়োজন এবং তাঁর চতুর্থ বিবি হবে রজবের স্ত্রী কলিমন। কী কারণে পীরের উদ্দেশ্যে মুহম্মদ (সা.)-এর রুহ এ কথা বললেন, তা জানতে চাইলে রুহ জানায় এই কথা:
আমি শরিয়তে চার বিবি হালাল করিয়াছি। কিন্তু তোমার মাত্র তিন বিবি। যারা সাধারণ দুনিয়াদার মানুষ, তাদের এক বিবি হইলেও চলিতে পারে। কিন্তু যারা রুহানি ফয়েজ হাসিল করিতে চায়, তাদের চার বিবি ছাড়া উপায় নাই। আমি চার বিবির ব্যবস্থা কেন করিয়াছি, তোমরা কিছু বুঝিয়াছ? চার দিয়াই এই দুনিয়া, চার দিয়াই আখেরাত। চারদিকে যা দেখো সবই খোদা চার চিজ দিয়া পয়দা করিয়াছেন।...এভাবে মানুষকে চারের ফাঁদে ফেলিয়া খোদাতায়ালা চার কুরসির অন্তরালে লুকাইয়া আছেন। এই চারের পর্দা ঠেলিয়া আলমে আমরে নূর-ইয়দানিতে ফানা হইতে হইলে, দুনিয়াতে চার বিবির ভজনা করিতে হইবে। (‘হুযুর কেবলা’)
রুহের বিধান-অনুসারে ভণ্ড-পীর বিয়ে করেন রজবের স্ত্রী কলিমনকে। বদরুদ্দীন আর পীরের এসব কর্মকাণ্ড সহ্য করতে না পেরে একসময় এমদাদ আক্রমণ করে বসে পীর সাহেবকে: ‘...একলাফে বরাসনে উপবিষ্ট পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাঁর মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি ধরিয়া হ্যাঁচকা টান মারিয়া বলিল: রে ভণ্ড শয়তান, নিজের পাপবাসনা পূর্ণ করিবার জন্য দুইটা তরুণ-প্রাণ এমন দুঃখময় করিয়া দিতে তোর বুকে বাজিল না?’ পীরের মুরিদেরা শেষ পর্যন্ত এমদাদকে নিবৃত্ত করল এবং মাতব্বরের নির্দেশে গ্রাম থেকে বের করে দিল।
—উপযুর্ক্ত ঘটনাংশকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে বাংলাদেশের গ্রাম-শহর-গঞ্জ-সর্বত্র বিস্তারী ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে এ দেশে প্রবলভাবে জেঁকে বসেছিল পীরপ্রথা। সমাজে ব্যাপকভাবে চলত পীরতোষণ। ‘নামাজ না পড়লেও পীর মানতে হবে’ বলে একটা কথা সে সময় বেশ চালু ছিল। অন্ধত্ব গোঁড়ামি কুসংসার আর কূপমণ্ডূকতার সুযোগে ভণ্ড পীরেরা খুব সহজেই সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করত।
সমাজে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে-বসা পীর ব্যবসার শিল্পিত আলেখ্য ‘হুযুর কেবলা’ ছোটগল্প। ভণ্ড পীরেরা মিথ্যা কথা বলত, নিজের কেরামতি দেখানোর জন্য নানা ছলনার আশ্রয় নিত, ফারসি-উর্দু-আরবি-বাংলার মিশেলে একধরনের অদ্ভুত অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলত—তাঁদের মুখে থাকত সর্বদা ধর্মকথা, কিন্তু ভেতরে থাকত ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার বাসনা। হুযুর কেবলা খুবই চতুর এবং অভিনয়নিপুণ। মুরিদদের বিভ্রান্ত করার জন্য হুযুর কেবলা অবলীলায় মিথ্যা কথা বলেন। হুযুর কেবলা কামুক, নারীলোলুপ। তাই নারীমহলে বয়ান করতে তিনি বেশি সময় দিতেন, গায়ে-পোশাকে সুগন্ধি মেখে যেতেন। ভণ্ড পীরের এসব আচরণের বিরুদ্ধে প্রবল, প্রতাপ ও পরাক্রমে বিদ্রোহ করেছে এমদাদ।
‘হুযুর কেবলা’ গল্পে আবুল মনসুর আহমদের আত্মজৈবনিকতার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে। দ্রোহী যুবক এমদাদের সঙ্গেও তাঁর খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর মতোই এমদাদ দর্শনের ছাত্র, তাঁর মতোই রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি। সমাজে প্রচলিত পীরপ্রথার ভয়ংকরতা যেভাবে এই গল্পে শিল্পিতা পেয়েছে, তা একটা ব্যাধি থেকে মুক্তির বাসনায় আকুল। এই মিথ্যাচার, ভণ্ডামি ও ধর্মব্যবসা থেকে সমাজ এখনো মুক্ত হয়নি। তাই উত্তরকালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে লিখতে হয়েছে বুঝি লালসালুর (১৯৪৮) মতো উপন্যাস। লালসালু র মজিদ ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের ভণ্ড পীরেরই উত্তর-প্রতিনিধি যেন।
আবুল মনসুর আহমদ রাজনীতি ও সমাজসচেতন লেখক। রঙ্গব্যঙ্গ ও হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি সমাজের নানামাত্রিক গলদ, অসংগতি ও ভণ্ডামি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। যেসব অপপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি লেখনী চালনা করেছেন, সেসব অপপ্রথা এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বেড়েছে বলেই মনে হয়। সে সূত্রে আবুল মনসুর আহমদের ‘হুযুর কেবলা’ এখনো আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। এই অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতাই আবুল মনসুর আহমদের রচনার প্রধান শিল্প-সার্থকতা। প্রসঙ্গত, কাজী নজরুল ইসলামের অভিমত দিয়েই শেষ করি ‘হুযুর কেবলা’র এই পাঠ:
...হাসির পিছনে যে অশ্রু আছে,...কামড়ের পিছনে যে দরদ আছে, তা যাঁরা ধরতে পারবেন, আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের সত্যিকার রসোপলব্ধি করতে পারবেন তাঁরাই। বন্ধুবরের এ রসাঘাত কশাঘাতেরই মত তীব্র ও ঝাঁঝালো।
কাজেই এ-রসাঘাতের উদ্দেশ্য সফল হবে, এটা নিশ্চয়ই আশা করা যেতে পারে।