পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথামালা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সম্পর্কের কথা সাধারণভাবে আমাদের সবারই জানা। তবে বিশেষভাবে অনুধাবন আবশ্যক পূর্ববঙ্গে দেওয়া তাঁর বক্তৃতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।

১৯২৬ সালে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জে বেশ কটি বক্তৃতা প্রদানের পর রবীন্দ্রনাথ ‘পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন বলে তাঁর জীবনী ও চিঠিপত্র-সূত্রে জানা যায়। তবে তাঁর জীবদ্দশায় পরিকল্পিত সে বই আলোর মুখ দেখেনি। মৃত্যুর নব্বই বছর পর ২০১৬ সালে কবির সেই প্রিয় পূর্ববঙ্গ থেকেই রবীন্দ্র-গবেষক ভূঁইয়া ইকবালের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা ১৮৯২—১৯২৬ (প্রথমা প্রকাশন ২০১৬, পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ শিগগিরই প্রকাশিত হবে)। এটি রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত কোনো বই, যার প্রথম প্রকাশ হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।

বইয়ের ভূমিকায় ভূঁইয়া ইকবাল জানাচ্ছেন প্রাসঙ্গিক তথ্য:

‘এসব বক্তৃতার মধ্যে রাজশাহী কলেজে, পাবনায় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে প্রদত্ত দুটি ইংরেজি অভিভাষণ এবং কুমিল্লায় অভয় আশ্রমের বর্ষোৎসবে বক্তৃতাত্রয়ী ছিল লিখিত।

অন্যগুলো তাৎক্ষণিক মুখে-মুখে বলা; আয়োজকদের মধ্যে কয়েকজন অনুলিখন করেন; কবি পরে কয়েকটি পুনর্লিখন ও সংশোধন করেন।’

বক্তৃতাগুলোর সিংহভাগই বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়ে কিছু ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’তে অন্তর্ভুক্ত হয়, অগ্রন্থিতও ছিল কয়েকটি।

এই বইয়ের বক্তৃতামালা আমাদের সামনে উদ্ভাসিত করে অনন্য রবীন্দ্রনাথকে, যিনি আত্মশক্তির জাগরণের বাণীতে বাংলার সব প্রান্তের মানুষকে জাগাতে চেয়েছেন—শিক্ষায়, কর্মে, দেশচেতনায়, বিশ্বভাবনায়।

২.

সবচেয়ে পুরোনো বক্তৃতা ১৮৯২-এ রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন পঠিত ‘শিক্ষার হেরফের’। শিক্ষা-ভাবুক কবির ক্ষুব্ধ রসিকতা এখানে অপ্রকাশ্য থাকেনি মোটেও, ‘পৃথিবীর পুস্তকসাধারণকে পাঠ্যপুস্তক এবং অপাঠ্যপুস্তক, প্রধানত এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। টেক্সট বুক কমিটি হইতে যে-সকল গ্রন্থ নির্বাচিত হয় তাহাকে শেষোক্ত শ্রেণীতে গণ্য করিলে অন্যায় বিচার করা হয় না।’

পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা ১৮৯২–১৯২৬ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথমা প্রকাশন

এ কথার প্রায় ১৩০ বছর পর আমাদের বর্তমান শিক্ষা-বাস্তবতাতেও কি তা সমান সত্য নয়? একই বক্তৃতায় তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা-শিক্ষার শোচনীয় অবস্থার স্বরূপ উন্মোচন করেন এভাবে, ‘বাংলা তাঁহারা জানেন না সে কথা স্পষ্টরূপে স্বীকার না করিয়া তাঁহারা বলেন, “বাংলায় কি কোনো ভাব প্রকাশ করা যায়। এ ভাষা আমাদের মতো শিক্ষিত মনের উপযোগী নহে।” প্রকৃত কথা, আঙুর আয়ত্তের অতীত হইলে তাহাকে টক বলিয়া উপেক্ষা, আমরা অনেক সময় অজ্ঞাতসারে করিয়া থাকি।’
পাবনায় ১৯০৮ সালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মিলনীর সুদীর্ঘ বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ গ্রাম-সমবায় ও প্রান্তিক মানুষের উন্নতিবিধানে তাঁর রূপকল্প ঘোষণা করেন, ‘দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজনসাধনক্ষম করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। কতকগুলি পল্লী লইয়া এক-একটি মণ্ডলী স্থাপিত হইবে। সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের এবং অভাবমোচনের ব্যবস্থা করিয়া মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করিয়া তুলিতে পারে তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য হইয়া উঠিবে। নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাঙ্ক স্থাপনের জন্য ইহাদিগকে শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে।’

১৯১৯ সালে সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্রদের অভিনন্দনের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ‘আকাঙ্ক্ষা’ শিরোনামে এক স্মরণীয় বক্তৃতা প্রদান করেন (অনুষ্ঠানে কিশোর সৈয়দ মুজতবা আলীও ছিলেন একজন উৎসাহী শ্রোতা। বক্তৃতার অর্থ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য পরে তিনি কবিকে চিঠি লিখেন এবং কবি তাঁর উত্তরও দেন)।

‘আকাঙ্ক্ষা’ বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের মৌল কথা ছিল, ‘অন্য দারিদ্র্যের লজ্জা নেই, কিন্তু আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্যের মতো লজ্জার কথা মানুষের পক্ষে আর কিছুই নেই। কেননা অন্য দারিদ্র্য বাইরের। এই আকাঙ্ক্ষার দারিদ্র্য আত্মার।’

১৯২৬ সালের ঢাকা সফরে রবীন্দ্রনাথকে বাংলা ও ইংরেজিতে বেশ কটি বক্তৃতা করতে হয়। করোনেশন পার্ক, দীপালি সংঘ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মুসলিম হল সংসদে একাধিক সংবর্ধনা-সভা ও একক বক্তৃতানুষ্ঠানে ঢাকাবাসী তাঁর চিন্তার আভায় স্নাত হয়।

৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির অভিনন্দনের উত্তরে তাঁর বক্তৃতায় তাঁকে ‘ঋষি’ ভাবার ভ্রান্তি মোচন করেন, ‘কেউ কেউ কখনো কখনো আমাকে যখন ঋষি উপাধি দেন, তখন আমার সংকোচের সীমা থাকে না। আমি ঋষিদের বাণী চয়ন করেছি, কিন্তু আমি তো মন্ত্রদ্রষ্টা নই।...কবি বলে আমাকে যে সম্মান করেন তা গ্রহণ করতে আমি কুণ্ঠিত হই নে।’ একই সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ কলেজের বক্তৃতায় কবি শান্তিনিকেতনের মর্মবাণী তুলে ধরেন, ‘আমার শান্তিনিকেতনের জ্ঞান শিক্ষিতদের জন্যে রিজার্ভ নয়, তাতে সকল দেশের সকল লোকের সমান অধিকার। সকলে তা লাভ করুক, তাতে জেগে উঠুক এই আমার নিবেদন।’

পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে প্রদত্ত অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বেজে ওঠে সর্বধর্ম-সমন্বয়বাদী মানবতার সুর, ‘ঈশ্বর এক; তাঁর মধ্যে কোনো ভেদ নাই। যিনি সকল বর্ণের, সকল জাতির জন্যে নিত্য তাঁর গভীর প্রয়োজন প্রকাশ করছেন; তিনি আমাদের সকলের চিত্ত যুক্ত করুন; বাহিরের শক্তি দ্বারা নয়, শুভবুদ্ধি দ্বারা।’

ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রদের অভিনন্দনের উত্তরে ‘শিক্ষার ক্ষেত্র’ শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি দেশকে তার আপন পরিচয়ে আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমি অনেক পল্লীবাসীকে অনেক সময় জিজ্ঞেস করেছি, ওহে, ওটা কী গাছ? উত্তর পেয়েছি, ওর তো কোনো নাম নেই মশায়, ওটা বুনো গাছ। ওটা কী পাখি? আজ্ঞে, ওটা জঙ্গুলে পাখি। দেশের নিত্যগোচর জিনিষ, কিন্তু তার কোনো নাম নেই, বিবরণ নেই। দেশকে এত উদাসীনভাবে অর্ধেক চোখ বুজে দেখলে কি তাকে ভালোবাসা যায়?’

ময়মনসিংহে মহিলা সমিতির সংবর্ধনার উত্তরে কবি বাঙালি নারীর সংবেদী সত্তার প্রতি তাঁর অভিবাদন জ্ঞাপন করতে ভোলেননি, ‘মাতৃভাষার যথার্থ যে বাণী তা মেয়েদের কাছে যেমন সত্যভাবে পৌঁছায়, এমন আর কোথাও নয়।’

৩.
নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লায় প্রদত্ত একাধিক বক্তৃতায় পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা ও গভীর বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত হয়েছে। কুমিল্লার অভয় আশ্রমের বর্ষোৎসবে দেওয়া বক্তৃতার কথামালা যেন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র-অর্ঘ্য:

‘দেশের মধ্যে অনেকদিন থেকে কর্ম করার যে সংকল্প জেগে উঠেছে, তার সম্বন্ধে বলে যাবার এই উপযুক্ত ক্ষেত্র। কেননা পূর্ববঙ্গের লোক নিষ্ঠাবান, দৃঢ়সংকল্প, সরলচিত্ত, তারা বুদ্ধির অহংকারে বিদ্রূপের দ্বারা বড়ো বড়ো কথাকে দূর করে দেয় না—সেই জন্যে পূর্ববঙ্গ বাংলাদেশের মধ্যে বড়ো কাজের ক্ষেত্র।’