
আমি তখন স্কুলের নিচের ক্লাসে পড়ি। আমাদের স্কুলের পাশেই ছিল নুরু মিয়ার দোকান। আসলে দোকানের মালিক নুরু মিয়া নয়, তার মামা। রকমারি জিনিসপত্র সাজানো থাকত ওই দোকানে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে পুঁতির মালা এবং সেফটিপিন পর্যন্ত। বিস্কুট, লজেন্স, মোয়া—এসব খাবারদাবার তো ছিলই। প্রায় সারা দিনই নুরু মিয়া দোকানে বসে জিনিসপত্র বিক্রি করত। বিকেলের পর সেখানে বসত তার মামা। আমরা অবশ্য দিনের বেলা নুরু মিয়াকেই দেখতাম। স্কুল ছুটির পরে আর সেদিকে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। নুরু মিয়াকে আমরা ডাকতাম নুরু ভাই।
নুরু ভাই একদিন আমাকে ডেকে বলল, ‘এই, লেবেনচুষ খাবে?’
‘আমার কাছে তো পয়সা নেই।’
‘তোমার কাছে পয়সা চেয়েছি নাকি?’ নুরু ভাই আমাকে দোকানের ভেতরে নিয়ে এল। বয়াম থেকে লজেন্স বের করে দুটো প্যাকেট ভরে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘একটা তোমার, আরেকটা ডালিয়ার।’
‘ডালিয়া! আমি যেন ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
‘ডালিয়া, যে তোমাদের পাশের বাড়িতে থাকে। তোমার সঙ্গে খেলে।’
ডালিয়াকে আমি ডালিয়াবু ডাকি। বললাম, ‘ডালিয়াবু লজেন্স চেয়েছে নাকি?’
‘চায়নি। তবে লজেন্স সে খুব পছন্দ করে।’ নুরু ভাই বলল, ‘তোমাদের এমনি দিলাম। এ জন্য পয়সা দিতে হবে না।’
পয়সা কেন দিতে হবে না, তা আমার মাথায় এল না। তবে নুরু ভাইকে এমন উদার কখনো মনে হয়নি। তার দোকান থেকে সওদা কিনতে হলে অনেক মুলামুলি করলেও সে দাম কমায় না। সেই নুরু ভাই কিনা বিনা পয়সায় এতগুলো লজেন্স দিয়ে দিল! দুটো প্যাকেট পেয়ে একটা পকেটে ভরে ফেললাম। আরেকটা হাতে নিয়ে সরাসরি গেলাম ডালিয়াবুদের বাড়ি। ডালিয়াবু কাগজের ঠোঙা দেখে বলল, ‘ওতে কী?’
‘লেবেনচুষ!’
‘দে, আমাকে দে। আমার খুব পছন্দ।’
প্যাকেট খুলে দুটো লজেন্স আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘নে। এ দুটো তুই খা।’
ওগুলো যে নুরু ভাইয়ের কাছ থেকে বিনা পয়সায় আনা, আমার আর তা বলা হলো না। মনে হলো, এসব কথা বলে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমার হাতের লজেন্স দুটো তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘এগুলো তুমি খাও। আমার এখন খেতে ভালো লাগছে না।’
‘বলিস কি রে!’ হাত বাড়িয়ে লজেন্স দুটো নিয়ে নিল ডালিয়াবু।
কয়েক দিন পর নুরু ভাই আমাকে আবার তার দোকানে নিয়ে গেল। আমাকে কয়েকটা বিস্কুট খেতে দিয়ে বলল, ‘ডালিয়াকে লজেন্সের প্যাকেটটা দিয়েছিলে তো?’
‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম।
‘আজ ডালিয়াকে এক প্যাকেট চকলেট পাঠাব। লজেন্সের চেয়ে এগুলো অনেক ভালো। খেতে খুব মজা।’
আমি চুপ করে রইলাম।
‘চকলেটের সঙ্গে আজ একটা চিঠিও দেব।’
‘কিসের চিঠি?’
‘ওসব তুমি বুঝবে না।’
‘ডালিয়াবু যদি রাগ করে?’
‘রাগ করবে কেন? চিঠিতে সব ভালো ভালো কথা লেখা আছে। খারাপ কিছু না। আমার দোকানে আলতা, কাচের চুড়ি, চুলের ফিতা—সবকিছুই পাওয়া যায়। ডালিয়ার যা কিছু পছন্দ, তা নিতে পারে। পয়সা লাগবে না।’ নুরু ভাই প্রায় জোর করেই চকলেটের প্যাকেট আর চিঠিটা আমার হাতে তুলে দিল।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগুলো নিয়ে আমি বাসায় এলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। নুরু ভাই ডালিয়াবুকে চিঠি লিখবে কেন? নুরু ভাই তো কত বড়! আর ডালিয়াবু স্কুলে আমার চেয়ে দুই ক্লাস ওপরে। আরেকটা কথা আমার মাথায় এল। নুরু ভাই বেশি লেখাপড়া জানে না। তাহলে সে চিঠি লিখল কী করে? অন্যদিকে ডালিয়াবু স্কুলের পরীক্ষায় সব সময় ফার্স্ট হয়। কিন্তু সবকিছুর আগে আমাকে দেখতে হবে চিঠিতে কী লেখা আছে?
বাসার চিলেকোঠায় গিয়ে আমি খামের মুখটা সন্তর্পণে আলগা করলাম, যাতে আবার ওটা ঠিকমতো লাগানো যায়। খাম খুলতেই সেন্টের বোটকা একটা গন্ধ আমার নাকে এসে লাগল। চিঠির কাগজটা ছিল রঙিন, এক কোনায় রঙিন ফুলপাতা আঁকা। কাগজটা যত ভালো, হাতের লেখা ততটাই খারাপ। এত জঘন্য হাতের লেখা নুরু ভাই ছাড়া আর কারও হতে পারে না। নুরু ভাই লিখেছে: জানের ডাল, (ডালিয়া হবে) আমার দুকানে (দোকানে) ছনো (স্নো) পাউডার আলতা চুরি (চুড়ি) আছে। তোমার জন্য সবই ফিরি (ফ্রি)। এইবার ঈদে তোমারে শাড়ি উপহার দিব। কী রং পছন্দ, বলবা। আমার ভালোবাসা জানিবা। ইতি। তোমার নুরু মিয়া।’ নিচে লাল কালিতে লেখা: চিঠির জবাব দিবা।
চিঠিখানা পড়ে আমার মনমেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। নুরু ভাই লোকটা মোটেই ভালো নয়। ডালিয়াবু, আমি ও পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েরা যখন গোল্লাছুট ও দাঁড়িয়াবান্ধা খেলি, নুরু ভাই কাছে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। তখন কিছু মনে হয়নি। একদিন সে আমাকে বলেছিল হাডুডু খেলায় ডালিয়াকে কীভাবে জড়িয়ে ধরে রাখতে হবে। সেদিনও আমি কিছু বুঝিনি। আজ মনে হচ্ছে, নুরু মিয়া আসলেই খারাপ লোক। আমি আর তাকে কখনো ভাই বলে ডাকব না।
কিন্তু চিঠিটার ব্যাপার কী করা যায়? এই চিঠি ডালিয়াবুকে দেব কি না! চিঠিটা পেয়ে ডালিয়াবু যদি খুশি হয়? না, তা কিছুতেই হতে পারে না। আমার অবশ্য চিঠিটা দেখার কথা না। ভেতরে কী লেখা আছে, তা-ও জানার কথা নয়। চিঠিটা ডালিয়াবুকে দেওয়ার পর সে যদি আমার সামনেই কাগজটা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে, তাহলে আমি খুব খুশি হই। এসব কথা ভেবে রাতে আমার চোখে ঘুম এল না। পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, টের পাইনি।
পরদিন সকালেই ডালিয়াবুদের বাসায় গেলাম। ডালিয়াবু আমাকে দেখে বলল, ‘কি রে! এত সকালে? নাশতা করেছিস?’
‘না।’
‘আয় আমরা নাশতা করি।’
কিন্তু টেবিলে বসে নাশতার দিকে আমার মন নেই। চিঠিটা কীভাবে দেব এবং ঘটনাটা ডালিয়াবু কীভাবে নেবে, সেটা ভেবে ভেবে মনে ভাবনার জট পাকাতে থাকল। নাশতার পাট শেষ হলে ডালিয়াবু তার ঘরে নিয়ে এল আমাকে। বলল, ‘কী বলবি, বল।’
‘ডালিয়াবু, তোমাকে একজন চিঠি দিয়েছে।’
ডালিয়াবু হাসিমুখে বলল, ‘তুই না তো?’
আমি যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। বললাম, ‘নুরু দোকানদার।’
কিন্তু তার চকলেট দেওয়ার কথা বলতে একেবারে ভুলে গেলাম। ওগুলো বাসা থেকে আনাও হয়নি।
‘লোকটা আসলে খুব খারাপ। আমি সামনে পড়লে কেমন করে যেন তাকায়। এসব লোককে আমি মোটেই পছন্দ করি না। যারা লেখাপড়া শেখে না, জীবনে বড় হতে চায় না, তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।’ ডালিয়াবু একটু থেমে আবার বলল, ‘তুই এক কাজ কর। চিঠিটা টুকরা টুকরা করে বাস্কেটে ফেলে দে।’
ডালিয়াবুর নির্দেশ পালন করে চিঠিটা ছিঁড়ে বাস্কেটে ফেললাম। আমার মনের ভেতরটা অনেক হালকা হয়ে গেল।
‘লোকটা যদি কখনো কিছু দেয়, নিবি না।’
আমি মাথা ঝাঁকালাম। লজেন্স ও চকলেট নেওয়ার কথা বলা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারলাম না।
‘লোকটার কত সাহস, আমাকে চিঠি লেখে! তোর মতো একজন ভালোমানুষ যদি আমাকে চিঠি লিখত, তাহলেও কথা ছিল।’ বলে আমার দিকে তেরছা চোখে তাকিয়ে হাসল ডালিয়াবু।
বাসায় ফিরে গিয়ে আমার মনে অনেকগুলো ভাবনার জন্ম হলো। চিঠিতে কী লেখা ছিল, ডালিয়াবু তা-ও দেখল না, জানারও প্রয়োজন বোধ করল না। কিন্তু আমি যদি ডালিয়াবুকে চিঠি লিখতাম, তাহলে নিশ্চয়ই আমার চিঠি পড়ত ডালিয়াবু। ডালিয়াবু নিশ্চয়ই চায় আমি তাকে চিঠি লিখি। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ডালিয়াবুর চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কী সুন্দর চেহারা ডালিয়াবুর! তার চুলের দুই বিনুনি কাঁধের দুপাশে চমৎকার মানায়। মাঝেমধ্যে চোখে কাজল দেয় সে। একদিন গালে কী যেন মেখেছিল। গাল দুটো আপেলের মতো লাগছিল। কত সুন্দর করে কথা বলে ডালিয়াবু! হাসলে চোখমুখ খুশিতে ভরে ওঠে। তবে ডালিয়াবু শাড়ি পরলে আমার ভালো লাগে না। মনে হয়, সে যে আমার চেয়ে বয়সে বড়, সেটা বোঝাতে চাইছে।
রাতের বেলা আমি আবার পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম ডালিয়াবুকে একটা চিঠি লিখব ভেবে। কী লিখতে পারি আমি? নুরু দোকানদারের চিঠিটার কথা মনে হলো। ওর মতো করে চিঠি লেখার কথা ভাবতেই মন থেকে তা নাকচ হয়ে গেল। অনেক ভেবেচিন্তে চিঠিতে একটা লাইনই লিখলাম আমি: ‘ডালিয়াবু, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ রঙিন কোনো কাগজ নয়, চিঠির কাগজে ফুলপাতা আঁকা নয়, সেন্টের গন্ধ তো নয়ই। শুধু একটি কথাতেই আমার চিঠি শেষ।
পরদিন চিঠিটা হাতে নিয়ে ডালিয়াবু কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। বলল, ‘ভালোবাসার কী বুঝিস তুই? ভালোবাসা কাকে বলে, তা কি জানিস? যাক, তুই তোর জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটা আমাকে দিলি। এটা আমি যত্ন করে রেখে দেব।’
ডালিয়াবু এরপর এগিয়ে এল আমার কাছে। আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘আমিও তোকে খুউব ভালোবাসি রে।’