প্রযুক্তি, পাইরেসি ও কপিরাইট

কপিরাইট বললেই একই সঙ্গে চলে আসে ‘পাইরেসি’ শব্দটিও। প্রযুক্তিনির্ভর এ বাস্তবতায় পাইরেসিকে কি আমরা ‘না’ বলতে পারছি? আজ বিশ্ব পুস্তক ও কপিরাইট দিবসে কথা হোক এ বিষয়ে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ রমরমা সময়ে পাইরেসি প্রতিরোধে কি কপিরাইট আইনের সংরক্ষণ ও প্রয়োগ সম্ভব? সোজা কথায়, সাংস্কৃতিক পণ্যের পাইরেসি কি নিশ্চিতভাবে ঠেকানো যায়?

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইন প্রবর্তন করতে হয়েছিল ‘পাইরেসি’ নামের অপরাধ ঠেকানোর জন্য। এ জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন পড়েছিল পাইরেসিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার। সে অবশ্য আজকের নয়, ইউরোপে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সময়কার কথা। পনেরো বা ষোলো শতকে প্রকাশিত কোনো বই ব্যবসাসফল হলে অনেকে ছাপাখানা ভাড়া নিয়ে তার বহু কপি ছেপে ফেলতেন। কিন্তু যখন দেখা গেল গ্রন্থের লেখক বা প্রকাশক বিক্রীত সেসব বাড়তি কপি থেকে লাভবান হচ্ছেন না, তখনই বিষয়টি হয়ে দাঁড়াল সমস্যা। বিক্রির আয় মৌলিক চিন্তাপ্রসূত গ্রন্থের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকাশক ও লেখকের আয়ত্তে রাখার উদ্দেশ্যে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ১৭১০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে, আমেরিকায় ১৭৯০ সালে আর ভারতে ১৯৫৭ সালে কপিরাইট আইন প্রবর্তিত হয়। সুতরাং পাইরেসি নতুন কোনো বিষয় নয়, ‘কপিরাইট’ শব্দের আবিষ্কারের আগেও পাইরেসি ছিল, এখনো আছে।

কপিরাইটের প্রয়োগ

কপিরাইট আইনের দুটো দিক সাদা চোখে দৃশ্যমান—এ আইন লেখক ও প্রকাশককে প্রথমত অর্থনৈতিক এবং দ্বিতীয়ত নিশ্চিত করে নৈতিক সুরক্ষা। তবে ‘প্যাটেন্ট’ বা কপিরাইট আইনের অন্তর্নিহিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আইনটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার মাধ্যমে উৎপাদিত সৃজনশীল কর্মকে উৎসাহিত করতে চায়। সামাজিক জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপকে বিক্রয়যোগ্য মনে করে পুঁজিবাদী সমাজ। এখানে আগে যে কাজের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ অপ্রয়োজনীয় বলে মানুষের ধারণা ছিল, পরিবর্তিত সমাজ ক্রমে তার মূল্য নির্ধারণ করেছে। কপিরাইট আইনের উদ্দেশ্য এ পরিবর্তনের সমার্থক।

সাংস্কৃতিক পণ্যকে যদি সম্পদ ভাবা যায়, তাহলে তাঁরাই এতে সবচেয়ে লাভবান হবেন, যাঁরা বেশি বেশি পণ্যের কপিরাইট জোগাড় করতে পারবেন, অর্থাৎ তাঁদের সম্পদ বেশি। তাই তাঁদের দিক থেকে কপিরাইট জোগাড়ের পরও পণ্যের বিক্রি থেকে আয় না হওয়াটা ক্ষতি। এ ক্ষতি মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলেই তাঁরা আইনের শরণাপন্ন হতে চান। অনেক সময় হতে পারেনও। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি পাইরেসির ক্ষেত্রে কি তা সম্ভব? কপিরাইট আইনটি যখন হয়েছিল, তখন কেবল কাগজে ছাপার যুগ ছিল। সংগীত বা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তা তখন কেবল নির্দিষ্ট টেপে সংরক্ষণ করা হতো। পরে আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় কপিরাইট আইনে নানান রকমের পরিবর্ধন এলেও বর্তমানের ডিজিটাল যুগে অভিনব ও দ্রুতগতির পাইরেসির ক্ষেত্রে কপিরাইট আইন সফলভাবে প্রয়োগ করা এক বড় চ্যালেঞ্জ।

পাঠকেরা কী করছেন?

কপিরাইট আইন প্রয়োগের আরেক প্রান্তে আছে ভোক্তার সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা। বিভিন্ন রকমের পাঠককে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, কেউ বই পাইরেসি নিয়ে একেবারেই সচেতন নন। পাইরেসির মাধ্যমে হাতে পাওয়া যেকোনো বই লুফে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আবার কেউ কাগুজে বই পাইরেসির ব্যাপারে অনেকটা সচেতন হলেও অন্য সব রকম পাইরেসিকে এখনো অপরাধ বলে মনে করছেন না; হয়তোবা বইটি ছোঁয়া যায়, স্পর্শ করা যায় বলেই। যাঁরা সচেতনভাবে পাইরেটেড বই কিনছেন না, তাঁরাই আবার অহরহ পাইরেসির মাধ্যমে পাওয়া চলচ্চিত্র দেখছেন বা গান শুনছেন। অন্যদিকে, যাঁরা পাইরেটেড বই কিনছেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ উচ্চ মূল্যে সব রকম শখ পূরণ এবং ইন্টারনেটের বাইট কেনার জন্য অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে তৈরি থাকেন, কিন্তু পড়ার বেলায় খোঁজেন ‘ফ্রি অনলাইন’।

পেঙ্গুইন প্রকাশনীর সমীক্ষায় দেখা যায়, এক পাঠক বলছেন, তিনি সপ্তাহে ৪০ পাউন্ড আয় করেন। তো কেমন করে একটা বইয়ের পেছনে ১০ পাউন্ড খরচ করবেন? কিন্তু পড়তে ভালোবাসেন বলে পাইরেসি সমর্থন করেন। কিছু পাঠকের মতে, একজনের বই আরেকজন ধার করে পড়া, সেকেন্ডহ্যান্ড বই কেনা আর পাইরেসির মাধ্যমে উৎপন্ন বই কেনার মধ্যে পার্থক্য নেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেখক-প্রকাশক বঞ্চিত হচ্ছেন। আরেকজন পাঠক জানাচ্ছেন, তিনি খাবার বা কাপড় কখনোই বিনা পয়সায় আশা করেন না, কিন্তু ইন্টারনেটে যেকোনো বই, গান বা চলচ্চিত্র বিনা মূল্যে উপভোগ করতে সচেষ্ট থাকেন। তাঁর ধারণা, আকার-আকৃতিসমেত পণ্য এক রকমভাবে অর্জন করতে হয় আর নিরাকার হলে আরেক রকম। ‘গুডরিডস’ সাইটের বহু পাঠকের মত, সাংস্কৃতিক পণ্য উন্মুক্ত ডোমেইনে প্রত্যেকের জন্য বিনা মূল্যে হাজির থাকা উচিত। কারও মতে, কপিরাইট একপ্রকার রক্ষণশীলতা। তাঁদের বেশির ভাগ চান প্রাথমিকভাবে বিনা পয়সায় পছন্দের লেখককে খুঁজে বের করতে। আশা রাখেন যে পরে প্রিয় লেখকের কপিরাইটকৃত বই কিনে পড়তে তাঁদের আপত্তি থাকবে না।

এ আলাপ থেকে এটুকু স্পষ্ট, খোদ পশ্চিমে তুলনামূলক উচ্চ আয়ের মানুষেরাও বিনা মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বই পেতে আগ্রহী। অধিকাংশ পাঠক একে কোনো অপরাধ বলে গণ্য করেন না। তবে সব পাঠকই যে পাইরেটেড বইয়ের নেশায় আক্রান্ত হন, তা ভাবার কারণ নেই। সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে প্রকৃত বই কেনা, মূল্য পরিশোধে ডাউনলোড করা এবং পাইরেসি প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টারত পাঠকও কম নয়।

প্রযুক্তি ও পাইরেসি

আজ আর আগের মতো ছাপাখানা নয়, ছোট্ট ঘরে বসেই শত কপি বই ছাপানো সম্ভব। যেকোনো ডিভাইসে মুহূর্তে আপলোড-ডাউনলোড করা সম্ভব হাজার ফাইল। যেমন যুক্তরাজ্য সরকারের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৭ শতাংশ ই-বুক আইন ভঙ্গ করে বিনা মূল্যে ডাউনলোড করা হয়। পৃথিবীব্যাপী এর হার আরও বেশি। আমাদের দেশের মতো আয়ের দেশগুলোতে পাশ্চাত্যের বই কম মূল্যে পাওয়ার ব্যাপারে পাঠকদের বিশেষ আকর্ষণ আছে। এখানে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় বইও। অন্যভাবে ভাবলে, পাঠের ক্ষেত্রে পাইরেসি পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের মতো দেশের আয়ের বৈষম্য দূর করে। আলোচনার বিস্তার আরও খানিক বাড়ালে বলা যায়, উইন্ডোজ প্রোগ্রামটি বাংলাদেশে কতজন ১০০ থেকে ২০০ মার্কিন ডলারে নিজের কম্পিউটারে সংযোজন করতেন, যদি নামমাত্র মূল্যে তার পাইরেটেড ভার্সন পাওয়া না যেত? দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া তখন স্বপ্নই থেকে যেত।

জ্ঞানের বিস্তার ঘটার ক্ষেত্রে বইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। বই বুদ্ধিবৃত্তিক পণ্য, যা যুগে যুগে মানুষের কাছে সহজলভ্য হলে সভ্যতার পথ মসৃণ হয়। বাংলাদেশে ২০১০ সালের জাতীয় শিল্পনীতির মাধ্যমে সরকার সৃজনশীল ও মেধাসম্পদের রক্ষায় অধিক মনোযোগকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। তারই সূত্র ধরে ট্রেডমার্ক ও কপিরাইট আইনের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও দেশের রাস্তায়, বইয়ের বাজারে, ইন্টারনেটে পাইরেসির মাধ্যমে উৎপন্ন প্রচুর বই, চলচ্চিত্র ও গান মেলে। কারণ, প্রযুক্তি পাইরেসিকে এত সহজসাধ্য করেছে যে এখন আর আগের মতো বইয়ের দোকানে বাহিনীসহ ম্যাজিস্ট্রেটের আগ্রাসন বইয়ের পাইরেসি রোধে যথেষ্ট নয়। এখন উন্মুক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো বহু উন্মুক্ত ডোমেইন আছে, যেখানে ক্রমাগত বই, গান বা চলচ্চিত্র আপলোড হচ্ছে। যেমন ‘পাইরেট বে’-এর মতো সাইটে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে লেনদেন করে পড়ছে, শুনছে, দেখছে। এ যেন ঠিক আশির দশক অবধি চালু থাকা নিয়ম—একটি বই কিনে পাড়াসুদ্ধ মানুষের পড়া। অস্ট্রেলিয়া সরকার ২০১৬-এর ডিসেম্বরে ‘পাইরেট বে’ সাইটটি নিষিদ্ধ করেছে। তারা আরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে টরেন্টজ, টরেন্ট হাউন্ড, আইসোহান্ট, সোলার মুভি, ইত্যাদি সাইটকেও। পাইরেটেড পণ্য সাইট নিষিদ্ধের ব্যাপারে অবশ্য চীন বরাবরই শ্রেষ্ঠ। গত পাঁচ বছরে সরকার সেখানে ৩ হাজার ৯০০ পাইরেসি সাইট নিষিদ্ধ করেছে। এটা করতে গিয়ে তাদের ২২ হাজার ৫৬৮টি মামলা চালাতে হয়েছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশটি ক্রমাগত তাদের সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো একদিক থেকে বন্ধ করতে থাকলেও আরেক দিকে রাতারাতি আরও বহু সাইট উন্মুক্ত হয়ে যায়।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাইরেসি হওয়া লেখক সবচেয়ে বেশি পঠিত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পাইরেসি লেখককে এমন পাঠকগোষ্ঠীর কাছে উপস্থাপন করে, যেখানে তাঁর পৌঁছানোর কথাই নয়। আমাদের দেশে ধরা যাক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি নীহাররঞ্জন—বড় দোকান থেকে শুরু করে ফুটপাত, সবখানে তাঁরা আছেন।

প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে সব ধরনের পাইরেসি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও উন্নত দেশগুলো অবস্থা বুঝে আইন সংশোধন এবং প্রয়োগের সংস্কৃতির চর্চা কিছুটা হলেও করতে পারে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালের জুলাই মাসে কিকঅ্যাস কোম্পানির টরেন্টস উন্মুক্ত ডোমেইনের মূল পরিকল্পনাকারী ও মালিককে আটক করে। মামলায় দেখা যায়, অবৈধভাবে বই ও চলচ্চিত্র আপলোড করে তাঁরা অল্প কিছুদিনে প্রকাশক ও লেখকের ৫৪ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতির কারণ হয়েছেন। আরেকটি ডোমেইন, ‘মেগা আপলোড’-এর মালিকের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল। এ রকম উন্মুক্ত ডোমেইন তো আছেই, সাধারণ যোগাযোগমাধ্যম, ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে মানুষ সরল মনে অহরহ কপিরাইটের তোয়াক্কা না করে প্রচুর সাংস্কৃতিক পণ্য আপলোড করেন। ফেসবুকের ট্রান্সপারেন্সি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে শুধু শেষ চার মাসেই ৩৭ হাজার সদস্যের অভিযোগের ভিত্তিতে তারা ২৮ লাখ পোস্ট পাইরেসির সমস্যার কারণে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে।

প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ বড় কোম্পানির বিরুদ্ধেই কখনো না কখনো কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। টেক জায়ান্ট, মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ আছে। তাদের বেশ কিছু অ্যাপের মাধ্যমে বই ও চলচ্চিত্র বিনা মূল্যে ডাউনলোড করা যায়।

ভোক্তার রুচি ও অভ্যাস পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি প্রভাবিত করে—ভোক্তার পছন্দ ও প্রয়োজন অনুযায়ী যথাক্রমে পণ্য প্রস্তুত ও সরবরাহ ব্যবসার মূলমন্ত্র। অন্যদিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি বিপুলসংখ্যক ভোক্তাকে নিয়ন্ত্রণ কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে সম্ভব কি না, এ অনিশ্চয়তা এখন গুরুতর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গেম অব থ্রোনস-এর সপ্তম সিজনে প্রতিটি পর্ব গড়ে ১ হাজার ৪৭০ কোটি বার অবৈধভাবে ডাউনলোড করা হয়েছিল। এ সিজনের গেম অব থ্রোনস কাহিনির চমক ছাড়াও মূলত হ্যাকিং ও পাইরেসির কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে। স্টার ইন্ডিয়া কোম্পানিও তখন একটি পর্ব হ্যাক করেছিল বলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে সাংস্কৃতিক পণ্য হ্যাকিং বা পাইরেসির অনেক বেশি সাড়া জাগানো ঘটনাটি ঘটেছিল নব্বই দশকের শুরুতেই। ইংল্যান্ডের একটি রেডিও স্টেশনের কিছু ক্ষমতা হ্যাক করে তাতে এফএম ব্যান্ডে দিনরাত হেভি মেটাল গান বাজানো হতো। বাজানোর কাজটা করা হতো আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার আওতায় বসে। তাই সেখানে যুক্তরাজ্যের আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হতো না। শেষে সরকার হার মেনে ২০০০ সালে রেডিও ব্যবস্থাটি আইনের মাধ্যমে সিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল।

আমাদের জীবনে বই পাইরেসি

আমাদের দেশে পথে–ঘাটে গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী বই পাইরেসির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে ওয়েবসাইটে তথ্য তথা আস্ত বই কপিরাইটের তোয়াক্কা না করে ভেসে বেড়াচ্ছে, সেখানে পাইরেসির মাধ্যমে হাতের কাছে পাওয়া দুর্লভ এবং সত্যিকার অর্থে মূল্যবান বইয়ে আমরা হাত দেব কি না, প্রশ্নটি আমাদের ক্ষেত্রে নৈতিক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি অর্থনৈতিক। সম্ভবত বইয়ের পোকা পাঠকের জন্য এ এক অর্থনৈতিক মুক্তি। আমাদের রাস্তার মোড়ে অল্প কয়েক কপি লং ওয়াক টু ফ্রিডম বা পুওর ইকোনমিকস বিক্রি হলে পশ্চিমের বড় প্রকাশনা সংস্থার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি ঘটে না। কিন্তু এ দেশে যার হাতে এ বইগুলো সহসা পৌঁছানোর কথা ছিল না, সে নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনকে জানতে পারে, দারিদ্র্য নিয়ে অভিজিৎ আর দুফলোর মতবাদ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। পাইরেসির সাহায্যে বানানো সস্তা কাগজে সিডনি শেল্ডন, ড্যান ব্রাউন বা ড্যানিয়েল স্টিলের উপন্যাস পড়লে সর্বভুক পাঠকের জীবনঘনিষ্ঠ ও কালজয়ী উপন্যাস পড়ার আগ্রহ মরে যাবে—এমন কথা নেই। আমাদের দেশের উন্মুখ পাঠক, বাস্তব জীবনে তিনি যদি লেখক বা প্রকাশকও হন, কখনো সবচেয়ে প্রয়োজনের কোনো বইয়ের পাইরেটেড কপি অপ্রত্যাশিত জায়গায় পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠেননি, এমনটা বিরল।

পাইরেসি ও লেখক

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাইরেসি হওয়া লেখক সবচেয়ে বেশি পঠিত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পাইরেসি লেখককে এমন পাঠকগোষ্ঠীর কাছে উপস্থাপন করে, যেখানে তাঁর পৌঁছানোর কথাই নয়। আমাদের দেশে ধরা যাক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি নীহাররঞ্জন—বড় দোকান থেকে শুরু করে ফুটপাত, সবখানে তাঁরা আছেন। আইনের মারপ্যাঁচে হালে রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট উঠে গেছে, কিন্তু তার আগেও বিচিত্র কায়দায় প্রকাশিত কয়টি বইয়ের দামের ভগ্নাংশ বিশ্বভারতীতে জমা হয়েছিল তা গবেষণার বিষয়। ভারত অবশ্য এমনিতেই পাইরেসির ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। শুধু বই বা চলচ্চিত্র কেন, যেকোনো পণ্য, যেমন গুরুত্বপূর্ণ নকশাকারীর নকশা করা পোশাক সেখানে রাতারাতি পাইরেসির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যাহোক, অনেক বিখ্যাত লেখক বই পাইরেসির ব্যাপারে নির্লিপ্ত কিংবা আগ্রহী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সালমান রুশদী একবার বলেছিলেন, শুধু ভারতে তাঁর বই প্রকৃতপক্ষে কত কপি বিক্রি হয়, তা অনুমান করা অসম্ভব। পাইরেসি হওয়া বইগুলো এমনভাবে বাজার দখল করেছে যে পাইরেসিতে নিয়োজিত কোম্পানিগুলো তাঁকে তাঁর জন্মদিন ও নববর্ষে কার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। তাঁদের শুভকামনা তিনি উপভোগ করেন। মূলত যত্রতত্র পাইরেসির ফলে আজ হ্যারি পটার-এর স্থান পৃথিবীর সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের প্রথম তিনটির মধ্যে। জে কে রাওলিং বা জর্জ আর আর মার্টিনকে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত লেখক হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে পাইরেসির অবদান অনস্বীকার্য। আমেরিকান গডস খ্যাত লেখক, নেইল গেইম্যানের মতে, ‘পাইরেসি হলো কাগজের বই ধার করে পড়তে নেওয়ার আধুনিক সংস্করণ। এ উপায়ে সরবরাহের অন্তর্জাল যত বিস্তৃত হবে, পাঠক ততই বাড়বে।’ উল্লেখ্য, নেইল গেইম্যান তাঁর সমগ্র সাহিত্য করোনাকালে পাঠকের কাছে সুলভ করতে একটি সাইটে উন্মুক্ত করেছেন। দ্য আলকেমিস্টখ্যাত লেখক পাওলো কোয়েলহো অবশ্য অনেক আগেই তাঁর বইয়ের ই-বুক ভার্সন একটি রাশান পাইরেসি সাইটে সবার জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন। আরেকবার ভারতের কোনো রাস্তার মোড়ে এক কিশোর বিক্রেতার হাতে পাইরেটেড বই, অ্যাডালটেরি—এ রকম ছবিসহ পাওলো এক টুইটার বার্তায় লিখেছিলেন, ‘পাইরেসি লেখকের জন্য এক বিশেষ মেডেল। লেখক পঠিত হচ্ছেন এর চেয়ে বড় পুরস্কার তার আর পাওয়ার নেই।’ টাইম ম্যাগাজিন–এর এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, পাইরেসির ফলে নতুন পাঠক সৃষ্টি হওয়ায় তাঁর কপিরাইটকৃত বইয়ের বিক্রি বেড়ে গেছে।

তাই-ই হওয়ার কথা—যত বেশি পাইরেসি, তত বেশি পরিচিতি, তত বেশি বিক্রি ও পাঠ। এদিকে, বাস্তবে বেশির ভাগ লেখক ও প্রকাশক তাঁদের বই পাইরেসি এবং অনুবাদের ব্যাপারে এখনো অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তবে প্রযুক্তির স্রোতের সঙ্গে ধাবমান পরিবর্তিত সংস্কৃতিতে আইনের মাধ্যমে তাঁদের অধিকার আদায় কতটুকু সম্ভব, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। কপিরাইট আইন প্রয়োগের সম্ভাব্যতা এবং পাইরেসির ব্যাপারে পাঠকের সচেতনতা বৃদ্ধি—দুটো বিষয়কে মাথায় রাখলেও অন্তত এটুকু বলা যায়, লেখকের জন্য যেকোনো উপায়ে বহুল পঠিত হওয়ার তুলনায় অপঠিত আর অলক্ষ্যে থেকে যাওয়া অনেক বড় হুমকি। ফলে প্রযুক্তির এ প্রবল উন্নতির প্রেক্ষাপটে কপিরাইট আইনের আরও সংস্কার নিয়েও হয়তো আমাদের অচিরেই ভাবতে হবে।